বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/একাদশ পরিচ্ছেদ

একাদশ পরিচ্ছেদ

নবীন বাহন

 রজনী নির্ব্বিঘ্নে কাটিয়া গেল। প্রভাতে মেঘনির্ম্মুক্ত পরিচ্ছন্ন আকাশে সূর্য উদিত হইল। মন্দ মন্দ পবন বহিল। ফার্গুসন্ নিম্নে অবতরণ করিয়া উত্তরমুখগামী বায়ুপ্রবাহের সন্ধান করিতে লাগিলেন। কখনো উচ্চে উঠিয়া কখনো নিম্নে নামিয়া, তিনি কিছুতেই অভীপ্সিত প্রবাহের সন্ধান পাইলেন না। বাতাস তাঁহাকে পশ্চিম মুখে লইয়া যাইতে লাগিল। ক্রমে দূরে চন্দ্র-পর্ব্বতের ধূসরবর্ণ শৃঙ্গ দেখা দিল। এই পর্ব্বতমালা টাঙ্গনিকা হ্রদ বেষ্টন করিয়া অবস্থিত।

 ফার্গুসন্ কহিলেন—

 “এখন আমরা আফ্রিকার যে স্থানে এসে পড়েছি কোনো দিন সেখানে কেউ আসেনি।”

 ডিক্ কেনেডি বলিলেন, “আমরা কি চন্দ্র-পর্ব্বতমালা অতিক্রম করবো?”

 “না—বোধ হয় দরকার হ’বে না। আমরা যাতে আবার ফিরে বিষুবরেখার দিকে যেতে পারি, তারই চেষ্টা করতে হ’বে। যদি আবশ্যক হয়, নোঙ্গর করে’ এখানেই সুবাতাসের অপেক্ষা করা যাবে।”

 সত্বরেই ফার্গুসনের আশা পূর্ণ হইল। তিনি যে বায়ুপ্রবাহের সন্ধানে ফিরিতেছিলেন, তাহা মিলিল। ভিক্টোরিয়া দ্রুতগতি অগ্রসর হইল। ফার্গুসন্ হৃষ্টচিত্তে বলিলেন, “আমরা এখন ঠিক পথেই চলেছি। বেশ হয়েছে। এই অপরিজ্ঞাত জনপদটা দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে।”

 “আমরা কি দীর্ঘকাল ধরে’ এমনি করে উড়ে উড়েই যাব?”

 “ডিক্, নীল নদীর জন্মস্থান ত দেখতেই হ’বে। সেই তীর্থদর্শনের জন্যই ত আমাদের এত আয়োজন। আমার বোধ হয়, আরো ছয় শ’ মাইল যেতে হ’বে।”

 “তা’ যাও না-ছয় শ’ কেন ছ’ হাজার মাইল চল না। কিন্তু ধরার ধূলায় দু’একবার কি নামবে না? হাত পা সব আড়ষ্ট হয়ে গেল!”

 ফার্গুসন্ হাসিয়া বলিলেন, “নামতে ত হ’বেই, হাওয়ায় ত পেট ভরে না—রসদ সংগ্রহ করা চাই। তোমার হাতে বন্দুক, আর কাননপথে নিঃশঙ্ক বন্যপশু। কিছু মাংসের যোগাড় হবে না?”

 “কেন হবে না? আমি ত প্রস্তুত।”

 “কিছু জলও নিতে হ’বে।”

 দ্বিপ্রহর কালে বেলুম কতকগুলি গ্রাম অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল। এ স্থানের কাফ্রিরা কতকাংশে সভ্য। তাহাদের মধ্যে রাজতন্ত্রশাসনপ্রণালী প্রচলিত। রাজার ক্ষমতা অসীম। ফার্গুসন্ ধীরে ধীরে বেলুনের উত্তাপ কমাইলেন এবং নোঙ্গর নিক্ষেপ করিলেন। ভাবিলেন কোনো অপেক্ষাকৃত উচ্চ ভূমিতে অথবা বৃক্ষশাখায় নোঙ্গর অবশ্যই আবদ্ধ হইবে। উহা সুদীর্ঘ তৃণের ভিতর লুক্কায়িত হইল। তৃণের শির স্পর্শ করিয়া বেলুন দুলিয়া ভাসিয়া চলিল।

 কেনেডি ক্রমেই অধীর হইতে লাগিলেন। শেষে হতাশভাবে বলিলেন, “নোঙ্গর ত ধরে না দেখছি, শিকার করা আর হ’লো না।”

 যোজনের পর যোজনবিস্তৃত সুদীর্ঘ শ্যামতৃণাকীর্ণ ভূমি যেন বাতান্দোলিত শ্যামসাগরের ন্যায় শোভা পাইতেছিল। কোথাও বা নানা বর্ণের বিহঙ্গমগণ কলরব করিয়া উড়িয়া পলায়ন করিতে লাগিল। কোথাও গুচ্ছ গুচ্ছ প্রস্ফুটিত পুষ্পরাশি ছিন্ন করিয়া বেলুনের সঙ্গে সঙ্গে নোঙ্গর চলিতেছিল, অকস্মাৎ একটী ধাক্কা লাগিল। জো কহিল, “পাহাড়ের গায়ে নোঙ্গর ধরেছে।” কেনেডি বলিলেন, “মই ফেল।”

 কেনেডির কথা মুখে থাকিতে থাকিতেই তাঁহারা একটী গভীর চিৎকারধ্বনি শুনিলেন। সকলেই সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “ব্যাপার কি?”

 “কি ভয়ানক চিৎকার—এমন ত কখনো শুনি নাই!”

 কেনেডির কথায় বাধা দিয়া জো বলিল, “এ কি আমরা যে আবার চলতে আরম্ভ করলেম।”

 “নোঙ্গরটা বুঝি খুলে গেছে।”

 জো রজ্জু ধরিয়া টানিয়া কহিল, “না—খোলে নাই।”

 “তবে কি পাহাড়টাই চলছে?”

 নিম্নের তৃণরাশি তখন যেন মথিত হইতেছিল। অকস্মাৎ জো দেখিল তাহার মধ্যে কি যেন একটা নড়িয়া উঠিল। সে ভীত কণ্ঠে কহিল, “বাপরে! প্রকাণ্ড সাপ!”

 কেনেডি বন্দুক তুলিলেন। কহিলেন, “সাপ! কৈ দেখি।” ফার্গুসন্ বলিলেন, “সাপ নয়—সাপ নয়—হাতীর শুঁড়!”

 “হাতী?” কেনেডি পুনরায় লক্ষ্য করিয়া বন্দুক উঠাইলেন।

 “ডিক্, থাম থাম। একটু অপেক্ষা কর।”

 “হাতীটা যে আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে!”

 “ভয় কি তাতে। আমরা যেদিকে যাব, সেই দিকেই ত নিয়ে যাচ্ছে।”

 হস্তী দ্রুতবেগে অগ্রসর হইল এবং সত্বরেই তৃণের বন পার হইয়া একটি পরিচ্ছন্ন স্থানে আসিয়া উপনীত হইল। ফার্গুসন্ দেখিলেন উহার শ্বেত দত্তদ্বয় প্রায় পাঁচ হস্ত পরিমিত দীর্ঘ, তাহাদের মধ্যে নোঙ্গরটী বাধিয়া গিয়াছে!

 নোঙ্গর খুলিয়া ফেলিবার জন্য হস্তী নানারূপ চেষ্টা করিল। শুণ্ড আস্ফালন করিতে লাগিল। কিন্তু নোঙ্গর খুলিল না।

 জো হি হি করিয়া হাসিতে লাগিল। বলিল, “এ অবাার এক নূতন বাহন! আর ঘোড়া চাই না—এখন হাতীতেই যাতায়াত চলবে।”

 কেনেডি বড়ই ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। তিনি বারংবার বন্দুক নাড়িতে লাগিলেন।

 হস্তী ক্ষিপ্র চরণে যাইতেছিল, দৌড়াইতে আরম্ভ করিল। দক্ষিণে ও বামে শুণ্ডদারা আঘাত করিতে লাগিল। আবশ্যক মাত্রেই যাহাতে নোঙ্গরের দড়ি কাটিয়া দিতে পারেন, ফার্গুসন্ সেইজন্য কুঠার হস্তে দণ্ডায়মান হইলেন। কহিলেন, “নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে আর নোঙ্গরের আশা ছাড়ছিনে।”

 প্রায় দেড় ঘণ্টা চলিয়া গেল। হস্তী ছুটিল, সেই সঙ্গে সঙ্গে বেলুনও ছুটিল। ফার্গুসন্ দেখিলেন দূরে একটা নিবিড় বন দেখা যাইতেছে, সুতরাং বেলুনটা রক্ষার নিমিত্তই হস্তিদন্ত হইতে নোঙ্গর মুক্ত করা প্রয়োজন হইয়া পড়িল।

 কেনেডি আর অপেক্ষা করিলেন না—পলায়মান হস্তীকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুড়িলেন। গুলি উহার শিরে লাগিয়া অন্যদিকে ছুটিয়া গেল, শির ভেদ করিল না। বন্দুকের শব্দ শুনিয়া হস্তী অধিক বেগে দৌড়াইতে লাগিল।

 কেনেডি উহার স্কন্ধদেশে আঘাত করিলেন। হস্তীর আর্ত্ত্নাদে প্রান্তর কম্পিত হইয়া উঠিল। উহা আরো বেগে ধাবিত হইল।

 জো কহিল—“আপনি একা পারবেন না, আমিও মারি।” তখন উভয়ে হস্তীকে আহত করিলেন। দুইটী গুলি উহার দুই পার্শ্ব ভেদ করিল।

 হস্তী মুহূর্ত্তের জন্য থামিল এবং পরক্ষণেই শুণ্ড উত্তোলন করিয়া উর্দ্ধশ্বাসে বনের দিকে দৌড়াইল। উহার ক্ষতমুখে হুহু করিয়া রুধিরস্রোত ছুটিল।

 ফার্গুসন্ দেখিলেন বনভূমি, সন্নিকট হইয়াছে, এখনই হয় ত বেলুন যাইয়া কোন বৃক্ষশাখায় প্রহত হইবে। তবেই সর্ব্বনাশ! তিনি উৎকণ্ঠিত হইয়া কহিলেন, “মার মার—আরো গুলি লাগাও। আমরা যে বনের কাছে এসে পড়েছি!”

 কেনেডি এবং জো হস্তীকে পুনঃ পুনঃ আঘাত করিতে লাগিলেন। দশটী গুলি উহার দেহ বিদ্ধ করিল। চীৎকারে বনভূমি কাঁপিতে লাগিল। শির ও শুণ্ড সঞ্চালনে মনে হইতে লাগিল, বেলুন হইতে দোলনাটী ছিঁড়িয়া পড়িবে—বেলুন টুকরা টুকরা হইয়া যাইবে। মধ্যে মধ্যে প্রবল ধাক্কা লাগিতেছিল। হঠাৎ একটা ধাক্কায় ফার্গুসনের হস্ত হইতে কুঠারখানি ভূপৃষ্ঠে পতিত হইল। তখন তিনি ছুরি দিয়া নোঙ্গরের বন্ধন-রজ্জু কাটিতে চেষ্টা করিলেন। চেষ্টা বিফল হইল। বেলুন তখন অতিবেগে বনের দিকে চালিত হইতেছিল।

 কেনেডি পুনরায় বন্দুক ছুড়িলেন। একটি গুলি হস্তীর নয়ন বিদ্ধ করিল। এইবার উহা থামিল। কোন্ দিকে যাইবে স্থির করিতে না পারিয়া ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। কেনেডির গুলি তখন হস্তীর হৃদয় বিদ্ধ করিল।

 অসহ্য যন্ত্রণায় হস্তী চীৎকার করিয়া উঠিল এবং মুহূর্ত্তমাত্র দণ্ডায়মান থাকিয়াই শৈলচ্যুত বিশাল প্রস্তরখণ্ডের ন্যায় ভূতলে পতিত হইল। সেই পতনেই উহার বৃহৎ দত্ত দুইটী দ্বিধাভগ্ন হইয়া গেল। হস্তীর জীবলীলা ফুরাইল।

 সকলেই বেলুন হইতে অবতরণ করিলেন। জো হস্তিশুণ্ডের কোমল অংশ কাটিয়া লইয়া রন্ধন করিতে আরম্ভ করিল কিছুক্ষণ পর কেনেডি যখন কতকগুলি পক্ষী শিকার করিয়া ফিরিলেন, তখন জো'র রন্ধন-কার্য্য সমাপ্ত হইয়াছে। ফাগু সন্ ততক্ষণ বেলুনটী পরীক্ষা করিতেছিলেন। সেই মুক্ত আকাশতলে, অজ্ঞাত দেশের নীরব প্রান্তর পার্শ্বে, সেই মনুষ্য-সমাগমবিরহিত অরণ্য-পরিবেষ্টিত পরিচ্ছন্ন ভূমিতলে বসিয়া তিনজনে তখন আহার করিতে লাগিলেন।