বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ





“রক্ষা কর, রক্ষা কর”
রজনী ভীষণ অন্ধকার। কিছুই নয়নগোচর হইতেছিল না। ফার্গুসন্ একটী বৃক্ষ-শিরে বেলুন আবদ্ধ করিলেন!
রাত্রি বারটার সময় যখন কেনেডি শয্যা ত্যাগ করিয়া প্রহরীর কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন তখন ফার্গুসন্ কহিলেন—
“ডিক্, বেশ সাবধানে থাক—বড় অন্ধকার।”
“কেন? কিছু বিপদের আশঙ্কা আছে কি?”
“এখনো কিছু নাই বটে—কিন্তু হ’তে কতক্ষণ! আমার বোধ হয়, কি একটা গুণ্ গুণ্ ধ্বনি হচ্ছে। বাতাসে আমাদের কোথায় যে টেনে এনেছে অন্ধকারে তা’ কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনে।”
“ও সব কিছু নয়। বোধ হয় বন্যপশুর দূরাগত হুঙ্কার মাত্র।”
“তা’ যা’ হোক—খুব সাবধানেই পাহারা দিও। সামান্য শঙ্কার কারণ দেখলেই আনার ডেকে তুলো।”
“আচ্ছা। তুমি নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাও।”
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়াছিল। বাতাসের চিহ্নমাত্রও ছিল না। কেনেডি সেই নীরব অন্ধকার মধ্যে বিশেষ মনোযোগের সহিত ইতস্ততঃ দেখিতে লাগিলেন। চিত্ত যখন উৎকণ্ঠিত থাকে, তখন মানুষ কত কি দেখে—তাহাদের কোনোটার অস্তিত্ব থাকে—কাহারো কিছুই থাকে না। হঠাৎ একবার বোধ হইল কেনেডি যেন একটা ক্ষীণ আলোক-রেখা দেখিতে পাইলেন। তিনি বিশেষ মনোযোগপূর্ব্বক চাহিয়া রহিলেন। আলোক-রশ্মি আর দেখা গেল না। কেনেডি ভাবিলেন, এ কি তবে মায়া?
তিনি উৎসুক হইয়া চাহিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ গেল। আলোক-রেখা আর দেখা গেল না। কেনেডি তখন নিচিন্ত হইলেন।
ও কি—ও? কেনেডি চমকিয়া উঠিলেন। এ বংশীধ্বনি কোথা হইতে হইল? নিশ্চয়ই বংশীধ্বনি। তাই কি? এ কি কোন নিশাচর পক্ষীর কণ্ঠ? বন্যপশুর চিৎকার নয় ত? আবার মনে হইল, এ বুঝি মনুষ্যের কণ্ঠ! কেনেডি বন্দুকটা পরীক্ষা করিয়া হাতের কাছে রাখিলেন। ভাবিলেন পশু হোক, পক্ষী হোক, মনুষ্য হোক, বেলুন অনেক উপরে আছে। চিন্তা কি?
মুহূর্ত্তের জন্য মেঘমুক্ত চন্দ্রালোকে তিনি দেখিলেন, কতক গুলি অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি নড়া-চড়া করিতেছে! ভাল করিয়া দেখিতে না দেখিতেই মেঘে চন্দ্র ঢাকিয়া গেল। কেনেডি আর বিলম্ব না করিয়া ফার্গুসনের গাত্র স্পর্শ করিয়া তাঁহাকে জাগ্রত করিলেন। কহিলেন, “চুপ, ধীরে কথা কও।”
“কি হ’য়েছে, ডিক্?”
“জোকে ডেকে তোল।”
জো উঠিল! কেনেডি সকল কথা প্রকাশ করিলেন। জো বলিল, “ও কিছু নয়। সেই যে একবার বানর দেখেছিলাম, বোধ হয় তাই।”
কেনেডি গম্ভীর ভাবে বলিলেন,—“হ’তে পারে। কিন্তু সাবধান হওয়াই ভাল। আমি আর জো মই ব’য়ে নীচে নামি। গাছের উপর গেলেই বোঝা যাবে!”
ফার্গুসন্ কহিলেন, “আচ্ছা নাম। আমি গ্যাসটা ঠিক করে’ নি। নিতান্ত দরকার না হ’লে বন্দুক আওয়াজ করো না।”
উভয়ে বৃক্ষোপরি অবতরণ করিয়া একটা সুদৃঢ় শাখার উপর বসিলেন। কিছুক্ষণ পরই জো ধীরে ধীরে কহিল—
“শুনছেন?”
“হাঁ—শুন্ছি। কিসে যেন গাছটা আঁচড়াচ্ছে না?”
“শব্দটা নিকটে আসছে না? বোধ হয় বড় একটা সাপ!”
“সাপ! না―তা’ নয়। ওই শোন শব্দটা বেশী হচ্চে। বোধ হয় মানুষ!”
জো মনোযোগপূর্ব্বক শুনিয়া কহিল, “আমারও তাই সন্দেহ হচ্ছে। কে যেন গাছে উঠছে।”
“তুমি গাছের ওদিকটা দেখ—আমি এদিক্ দেখি।”
উভয়ে বন্দুক হস্তে নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। একেই মেঘের জন্য চতুর্দ্দিক্ অন্ধকার ছিল। ঘন বৃক্ষপত্র সে অন্ধকারকে আরও বাড়াইয়া তুলিয়াছিল। কিছুক্ষণ যাইতে না যাইতেই জো বেশ দেখিল যে, কয়েকজন কাফ্রি গাছে উঠিতেছে। জো কেনেডির বাহু টিপিয়া সঙ্কেত করিল। তখন কাফ্রিদিগের মৃদু কণ্ঠধ্বনি শুনা যাইতেছিল। জো বন্দুক তুলিয়া সন্ধান করিল।
কেনেডি কহিলেন—“থাম।”
কতকগুলি কাফ্রি সত্যই বৃক্ষারোহণ করিতেছিল। ধীরে—অতি ধীরে—ঠিক যেন সরিসৃপের ন্যায় তাহারা উঠিতেছিল। অল্পক্ষণ মধ্যেই অন্ধকার ভেদ করিয়া দুইটী মনুষ্যমূর্ত্তি দেখা দিল। জো বৃক্ষের সেইদিকে বসিয়াছিল।
কেনেডি হাকিলেন—“মার!”
উভয়ের বন্দুক বজ্রের ন্যায় একসঙ্গে ধ্বনিয়া উঠিল। আহত কাফ্রিদিগের আর্ত্তনাদের সহিত মিশিয়া সেই ধ্বনি কাঁপিতে কাঁপিতে আকাশে মিলাইয়া গেল। অন্যান্য কাফ্রিগণ হুঙ্কার করিয়া উঠিল এবং বোধ হইল যেন পলায়ন করিল। কিন্তু সেই হুঙ্কার ও আর্ত্তনাদের মধ্যে জো এবং কেনেডির কর্ণে এ কার কণ্ঠ বাজিল? তাঁহাদের সন্দেহ হইল, বুঝি শুনিতে ভ্রম হইয়াছে! নতুবা ইহাও কি সম্ভব? আফ্রিকার মহারণ্যে—এই নরখাদক অসভ্যদিগের মধ্যে— সুসভ্য ফরাসীর কণ্ঠ! ইহাও কি সম্ভব? না-ভ্রম নয়! ওই যে আবার সেই ঘোরতর আর্ত্তনাদ শ্রুত হইল—“রক্ষা কর-রক্ষা কর!”
কেনেডি এবং জো ক্ষিপ্র চরণে মই বহিয়া বেলুনে উঠিলেন। ফার্গুসন্ কহিলেন—
“ডিক্, শুনলে?”
“ফার্গুসন্ এ কি সত্য? যেন কোন ফরাসী ডাকছেন—রক্ষা করা—রক্ষা কর।”
“নিশ্চয়ই কোনো ফরাসী পাদরী। বোধ হয় কাফ্রিরা তাকে হত্যা করছে!”
কেনেডি রোষে জ্বলিয়া উঠিলেন। কহিলেন, “ফার্গুসন্ বল কি! যাতে তাঁ’র রক্ষা হয় তাই কর। আমরা তোমার আদেশের অপেক্ষায় আছি।”
“ওরা যেমন করে’ পালালো তা’ দেখে মনে হয়, কখনো বন্দুকের শব্দ শোনেনি। কিন্তু কি করি—দিন না হ’লে ত কোনো উপায় হয় না!”
“পাদরী যে বড় বেশী দূরে আছেন তা’ত বোধ হচ্ছে না। কারণ—”
ও কি! আবার সেই করুণ কণ্ঠের কাতর প্রার্থনা—“রক্ষা কর—-রক্ষা কর।” সে ধ্বনি আকাশে বাতাসে কম্পিত হইতে লাগিল। স্বর শুনিয়া মনে হইতে লাগিল তাঁহার দেহ যেন ক্রমেই অবসন্ন হইয়া আসিতেছে!
জো দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করিয়া কহিল—“যদি এই রাত্রেই কাফ্রিরা তাঁকে হত্যা করে—”
ফার্গুসনের হস্ত সজোরে ধরিয়া কেনেডি কহিলেন—
“ফার্গুসন্ শোন—শোন। যদি আজ রাত্রেই তিনি নিহত হন!”
“সেটা সম্ভব নয় ডিক্। কাফ্রিরা উজ্জ্বল সূর্য্যালোকেই বন্দীদের হত্যা করে’ থাকে। বধ করার সময় সূর্য্য চাই-ই চাই।”
কেনেডি উত্তেজিত হইয়া কহিলেন, “আমি যদি এখনই বন্দুক নিয়ে যাই— ”
জো কহিল, “আমিও যাব—আমিও যাব।”
ফার্গুসন্ বাধা দিয়া কহিলেন “তোমরা থাম—অত উত্তেজিত হ’য়ো না। তোমরা গেলে ফল ত কিছুই হ’বে না, বরং আমরা যে এখানে আছি তা’ প্রকাশ হ’য়ে পড়বে। আমাদের ত বিপদ্ হ’বেই, আর যাঁকে বাঁচাতে চাও—তাঁরও বিপদ্ হবে।”
“কেন? কাফ্রিরা ত ভয়ে পালিয়েছে। তা’রা কি আর ফিরবে?”
“ডিক্ একটিবার দয়া করে’ আমার কথা মান। তোমরা যদি বন্দী হও, তবেই ত সর্বনাশ!”
“কিন্তু ভাব দেখি ফার্গুসন্—একবার পাদরীর কথা ভাব দেখি। তিনি যে সাহায্যের আশায় ব্যাকুল হ’য়ে আছেন। আমরা এখানে মরার মত নীরব হয়ে পড়ে’ থাকবো? তাঁর করুণ রোদন বিফল হ’বে? তিনি ভাববেন মরার আগে পাগল হয়েছেন—যাকে বন্দুকের শব্দ মনে করে’ আশান্বিত হয়েছিলেন, সেটা বন্দুকের শব্দ নয় তাঁর বিকৃত মস্তকের—”
বাধা দিয়া ফার্গুসন্ কহিলেন, “আমরা এখনই তাঁকে অভয় দিচ্ছি।”
মুখের উভয় পার্শ্বে করতল স্থাপিত করিয়া তিনি উচ্চকণ্ঠে কহিলেন—“আপনি যিনিই হউন, ধৈর্য্য ধরুন। তিনজন বন্ধু আপনার রক্ষার নিমিত্ত প্রাণপণ করেছে। সাহস হারাবেন না!”
ফার্গুসনের কণ্ঠ ডুবাইয়া দিয়া কাফ্রিগণের গর্জ্জন সেই বনভূমি আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল।
কেনেডি অস্থির হইয়া কহিলেন—ফার্গুসন্—ফার্গুসন— ওই বুঝি তাঁকে হত্যা করছে! আমরা সাড়া দিয়েই আরো সর্ব্বনাশ করলেম। যা’ হয় এখনই কর।”
জো একান্ত হতাশ হইয়া বলিল, “হায়, এটা যদি দিন হতো—”
ফার্গুসন্ অস্বাভাবিক কণ্ঠে কহিলেন, “তা হ’লেই বা কি করতে?”
কেনেডি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। বন্দুক লইয়া বলিলেন “আমি নামি ফার্গুসন্। এই বন্ধুকের মুখে শত্রু তাড়াবো।”
“”দি তুমি না পার তা হ’লে তোমার মৃত্যু ত সুনিশ্চিত! তখন তোমাকে আর পাদরীকে, দু’জনকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হ’বে! সেটা কত কঠিন, ভাব দেখি। অন্যপথ অবলম্বন করলে হয় না?”
“যাতে হয়—তাই কর। এখনই কর—দেরি আর সয় না!”
“আচ্ছা ভালো—”
ফার্গুসন্কে বাধা দিয়া জো কহিল, “আপনি কি কোন উপায়ে এই অন্ধকারটা দূর করতে পারেন না। তা’ হ’লে একবার দেখি—
ফার্গুসন্ কিছুক্ষণের জন্য নীরব রহিলেন। তিনি চিন্তামগ্ন হইলেন। কিছুক্ষণ পরে বন্ধুদিগের দিকে চাহিয়া কহিলেন—
“শোন বলি। আমাদের উপযুক্ত পরিমাণ ভার আছে। মনে কর পাদরীর ওজন আমাদেরই একজনের সমান হ’বে। কিছু কম হওয়ারই কথা, কারণ অনাহারে, যন্ত্রণায় তিনি নিশ্চয়ই শুকিয়ে উঠেছেন। যা হোক আমাদের সমান ওজন ভার ফেলে দিলেও আরো প্রায় ৩০ সের থাকবে। সেটাও যদি ফেলে দি, তা’ হ’লে সাঁ করে’ উপরে উঠতে পারবো।”
“তোমার মতলব কি?”
“শোন। যদি বেলুনটা বন্দীর কাছে নিয়ে যেতে পারি, আর তাঁর ওজনের সমান ভার ফেলে দিয়ে তাঁকে তুলে নি, তা’ হলেও বেলুন বাতাসে ভাসবে। বাকী ভারটাও তখন ফেলে দেওয়া চাই, নইলে কাফ্রিদের হাতে পড়তে হ’বে। সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসে তাপ দিয়ে উপরে উঠতে হ’বে।”
“ঠিক উঠতে পারা যাবে—আর দেরি নয় ফার্গুসন্।”
“একটা অসুবিধা আছে, ডিক্। যখন আবার নামতে হ’বে, তখন খানিকটা গ্যাস ছেড়ে না দিলে আর নামা যাবে না। ৩০ সের ভারের মত গ্যাস ছাড়তেই হ’বে। জ্ঞান ত ভাই, গ্যাস তোমার বেলুনের প্রাণ! যাক অত ভাবলে আর চলবে না।”
“ঠিক বলেছ ফার্গুসন্। বন্দীর প্রাণ আমাদের হাতে—যেমন করে’ই হোক তাঁকে বাঁচাতেই হবে।”
“ভার গুলো হাতের কাছে রাখ। একসঙ্গে ফেলা চাই।”
“অন্ধকারটার কি হবে?”
“অন্ধকার! বেশ ত এখন থাকুক না। আমাদের সব আয়োজন হ'য়ে যাক, তার পর দেখা যাবে। এখন ত অন্ধকার আমাদের ঢেকে রেখে উপকারই করেছে। বন্দুক ঠিক করে' -রাখ জো,—তোমরা প্রস্তুত হও।”
জো এবং কেনেডি ক্ষিপ্র হস্তে সকল বন্দোবস্ত করিলেন।
ফার্গুসন বলিলেন—“জো, তুমি ভার ফেলবে। ডিক্, তোমার উপর গুরুতর কার্য্যভার। তুমি বন্দীকে মুহূর্তে বেলুনের উপরে তুলে নেবে। এইটিই তোমার প্রধান কাজ। জো কাছে থাক। বেলুনের নোঙ্গর খুলে দাও। ”
নোঙ্গর খোলা হইল। অতিশয় ধীরে বাতাস বহিতেছিল বলিয়া বেলুন ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। জলকে গ্যাস করিবার নিমিত্ত জলের মধ্যে যে দুইটি বৈদ্যুতিক তার ছিল, ফার্গুসন্ তাহা বাহির করিলেন এবং ব্যাগের ভিতর হইতে দুই খণ্ড কয়লা লইয়া উহাদের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ করিলেন। আবশ্যক মত তীক্ষ্ণ হইলে পর কয়লা দুইখানি তার দুইটিতে বাঁধিলেন। কয়লার দুইটা তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ মিলিত হইবামাত্র মুহূর্ত্তে তীব্র আলোকরাশি বিচ্ছুরিত হইয়া চতুর্দ্দিক্ উদ্ভাসিত করিয়া দিল— অন্ধকারের লেশমাত্র রহিল না।
জো বিস্মিত হইয়া কহিলেন—“ধন্য কৌশল, ধন্য আপনি—”
গম্ভীরকণ্ঠে ফার্গুসন্ বলিলেন—“চুপ।”
তিনি হস্ত ঘুরাইয়া সেই আলোকরাশি চারিদিকে সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন এবং যেদিক্ হইতে আর্ত্তনাদ সমুত্থিত হইয়াছিল সেইদিকে পরিচালিত করিলেন।
বৈদ্যুতিক আলোকে তাঁহারা দেখিলেন যে, যে বৃক্ষচূড়ায় বেলুনটি আবদ্ধ ছিল, উহা একটি মুক্ত প্রান্তর মধ্যে অবস্থিত। নিকটবর্ত্তী ইক্ষু-ক্ষেত্র মধ্যে প্রায় ৪০খানি কুটীর দেখা যাইতেছিল। সেই কুটীরগুলি ঘিরিয়া অসংখ্য কাফ্রি দণ্ডায়মান ছিল। বেলুনের প্রায় ৫০।৬০ হস্ত নিম্নে প্রান্তর মধ্যে একটা শূল প্রোথিত ছিল। সেই শূলের পাদমূলে খ্রীষ্টের ক্রুশ বক্ষে ধরিয়া একজন ত্রিংশৎবর্ষীয় অর্দ্ধ-নগ্ন ফরাসী ধর্ম্মযাজক নিপতিত ছিলেন। তাঁহার দেহ রুধিরাপ্লুত। অসংখ্য ক্ষতমুখে শোণিত ঝরিতেছিল।
কাফ্রিগণ দেখিল এক বিপুল ধূমকেতু যেন অগ্নিতুল্য উজ্জ্বল পুচ্ছ বিস্তার করিয়া আকাশ হইতে নামিতেছে! তাহারা ভয়ে চিৎকার করিতে লাগিল। তাহাদিগের চিৎকার শুনিয়া সেই মরণোন্মুখ পাদরী একবার মস্তক উত্তোলন করিলেন। ফার্গুসন্ বলিয়া উঠিলেন—“আছে—আছে—এখনো বেঁচে আছে। তোমরা প্রস্তুত হয়েছ?”
“হা প্রস্তুত।” ডিক্ কেনেডি ও জো সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন “হাঁ প্রস্তুত।”
“জো গ্যাস নিবিয়ে দাও।”
গ্যাস নির্ব্বাপিত হইল। বেলুন তখন ধীরে ধীরে বন্দীর দিকে অগ্রসর হইতেছিল। কাফ্রিগণ ভীতচিত্তে কুটীর মধ্যে পলায়ন করিল—শূলের নিকট কেহই রহিল না।
বেলুন যথাসম্ভব নীচে নামিল। কয়েকজন সাহসী কাফ্রি দেখিল বন্দী পলায়ন করিতেছে—তাহারা চিৎকার করিতে করিতে অগ্রসর হইল। কেনেডি বন্দুক হস্তে লইলেন। ফার্গুসন্ বলিলেন—“মের না—থাম।”
ফরাসী পাদরী তখন বহু কষ্টে জানুর উপর ভর করিয়া বসিয়াছিলেন। তাঁহার দাঁড়াইবার শক্তি আর ছিল না। কেনেডি বন্দুক রাখিয়া চক্ষের নিমিষে পাদরাকে বেলুন মধ্যে তুলিয়া লইলেন, জো অমনি আড়াই মণ ভার নিক্ষেপ করিল।
বেলুন উপরে উঠিল না।
কেনেডি অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া কহিলেন—“বেলুন ত উঠে না!”
জো কহিল, “একটা কাফ্রি আমাদের টেনে ধরেছে!”
“ডিক্—ডিক্—জলের বাক্স—”
কেনেডি পরক্ষণেই জলপূর্ণ একটা বাক্স ভূমিতলে নিক্ষেপ করিলেন।
বেলুন চক্ষের নিমিষে প্রায় দুই শত হস্ত উর্দ্ধে উঠিয়া গেল।
জো এবং কেনেডি উল্লাসে জয়-ধ্বনি করিয়া উঠিলেন।
বেলুন অকস্মাৎ আরো ৬'৭ হস্ত উপরে উঠিয়া পড়িল।
কেনেডি পড়িতে পড়িতে বাঁচিয়া গেলেন! কহিলেন “এ আবার কি?”
ফার্গুসন্ বলিলেন “রাক্ষস কাফ্রিটা বেলুন ছেড়ে দিয়েছে!”
সকলে দেখিলেন সে চিৎকার করিতে করিতে, বাতাসে ঘুরিতে ঘুরিতে ভূতলে পতিত হইল।
ফার্গুসন্ বৈদ্যুতিক তার দুইটি পৃথক্ করিলেন। মুহূর্ত্তে সকল আলোক অন্তর্হিত হইয়া গেল। বিরাট অন্ধকার মধ্যে বেলুনের চিহ্ন পর্য্যন্ত কেহ আর দেখিতে পাইল না।
মূর্চ্ছিত ফরাসী যখন চক্ষু চাহিলেন তখন রাত্রি একটা। ফার্গুসন্ ফরাসী ভাষায় কহিলেন—“আপনি এখন মুক্ত। আর ভয় নাই।”
পাদরী ক্ষীণকণ্ঠে কহিলেন—“আপনাদের অনুগ্রহে আমি আজ অতি নিষ্ঠুর মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। ভ্রাতৃবৃন্দ, তজ্জন্য অশেষ ধন্যবাদ। কিন্তু আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আমি আর অধিকক্ষণ বাঁচবো না!” তিনি পুনরায় মূর্চ্ছিত হইলেন।
তাঁহারা অতি যত্নে অতি সাবধানে পাদরীকে শয়ন করাইলেন। তাঁহার দেহে প্রায় ২০|২৫টি অগ্নি-ক্ষত ও বর্শার চিহ্ন বর্ত্তমান ছিল। ক্ষতমুখে তখনো রুধির ঝরিতেছিল। ডাক্তার ফার্গুসন্ ক্ষতগুলি ধৌত করিয়া ঔষধ প্রয়োগ করিলেন।