বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

রাক্ষসের রাজ্য

 নির্বিঘ্নে দুই দিবস অতিবাহিত হইল। পর্য্যটকগণ নির্বিঘ্নে অগ্রসর হইতে হইতে তৃতীয় দিবসে একটী গ্রামের নিকটে আসিয়া উপনীত হইলেন। গ্রামটী বৃত্তাকার। তাহার মধ্যস্থলে একটী বিরাট বৃক্ষ আকাশে মস্তক ঠেকাইয়া দণ্ডায়মান ছিল। তাহার পত্র-বহুল অগণিত শাখাৱ নিম্নে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটীর নির্ম্মিত ছিল।

 জো কহিল, “দেখুন দেখুন—গাছের ডালে ডালে কত সাদা ফুল ফুটেছে।”

 মনোযোগপূর্ব্বক দেখিয়া ফার্গুসন্ বলিলেন, “ও সব ফুল নয় জো—ফুল নয়। নর-কঙ্কাল! মানুষের মাথা! ছোরা দিয়ে গাছের গায়ে বিদ্ধ করে রেখেছে!”

 জো শিহরিয়া উঠিল।

 দেখিতে দেখিতে সে গ্রামখানি চক্ষুর অন্তরাল হইল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই আর একখানি দেখা দিল। ফার্গুসন্ দেখিলেন অর্দ্ধভুক্ত নরদেহ, ছিন্ন নরবাহু,খণ্ডিত চরণ-সমূহ, শুভ্র নরকঙ্কাল গ্রামের চতুর্দ্দিকে বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে! দেখা দিল। বন্য জন্তুগণ সেই সকল নরদেহ লইয়া টানাটানি করিতেছে। ফার্গুসন্ বলিলেন—

 “ওই যে নরকঙ্কাল দেখছ, ও সমস্তই দণ্ডিত অপরাধীদের শেষ চিহ্ন। বন্দীদের ধরে’ এনে বনে ছেড়ে দেয়। অমনি হিংস্র পশুরা এসে তাদের আক্রমণ করে। আফ্রিকার দক্ষিণাংশে কি করে জান? অপরাধীদের ধরে’ একটা ঘরে বন্ধ করে। তারপর তাদের স্ত্রী পুত্র পরিবার—এমন কি পালিত পশুপক্ষী পর্য্যন্ত সেই ঘরের ভিতর বন্ধ করে’ আগুন জ্বালিয়ে দেয়।”

 কেনেডি বলিলেন, “কি নিষ্ঠুর প্রথা! এও ফাঁসীর মতই নৃশংস ব্যাপার।”

 জো এতক্ষণ নীরবে আকাশের দিকে চাহিয়াছিল। কতকগুলি পক্ষী দেখাইয়া বিস্ময়ের সহিত কহিল—“ওগুলো কি পাখী? কত উপরে উঠছে দেখুন।”

 কেনেডি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া দেখিয়া কহিলেন— “ও সবই ঈগল পাখী। কি সুন্দর পাখী। আমারাও যেদিকে যাচ্ছি ঈগলও সেই দিকেই যাচ্ছে।”

 ফার্গুসন্ ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “ভগবান্ যেন ওদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেন। নরমাংসভুক্ কাফ্রিদের হাতে পড়লেও আমাদের তত চিন্তার কারণ নাই। কিন্তু ঈগলের কাছে আমাদের নিস্তার নাই, ডিক্!”

 “পাগল আর কি!” হাসিয়া কেনেডি বলিলেন, “পাগল আর কি! আমাদের হাতে বন্দুক থাকতে আবার ভয়!”

 কেনেডি বন্দুক উঠাইলেন।

 বাধা দিয়া ডাক্তার বলিলেন, “থাম ডিক্, থাম, তুমি খুব শিকারী তা’ জানি। ঈগলের ঠোট কত ধারালো তা’ জান? একবার ঠোকর দিলেই বেলুন ছিঁড়ে যাবে।”

 জো হাসিয়া কহিল, “বেলুনের সঙ্গে কতকগুলো ঈগল পাখী বেঁধে দিলে হয়। আমাদের টেনে নিয়ে যেতে পারে।”

 জো’র কথা শুনিয়া ফার্গুসন্ এবং কেনেডি উভয়ে হাস্য করিয়া উঠিলেন। কেনেডি বলিলেন—

 “তোমার প্রস্তাবটা বেশ ভাল বটে, কিন্তু ঈগল কি আর পোষ মানবে!”

 “মান্‌বে না? শিখিয়ে নিতে হ’বে। ঘোড়ার যেমন লাগাম থাকে, তার বদলে ঈগলের চোখে ঠুলি দিয়ে দিলেই হয়। যখন যে চোখ খোলা থাকবে, ঈগল নিশ্চয়ই সেই দিকে যাবে।”

 যখন এইরূপ কথাবার্ত্তা হইতেছিল তখন বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর হইয়াছিল। বাতাস মৃদু ছিল বলিয়া ভিক্টোরিয়া অপেক্ষাকৃত ধীরে ধীরে যাইতেছিল। হঠাৎ বংশীধ্বনি শ্রুত হইল। সকলে বিস্মিত হইয়া নিম্নে চাহিয়া দেখিল, দুই দলে ভীষণ যুদ্ধ হইতেছে। উভয় পক্ষের শরজালে তখন আকাশ সমাচ্ছন্ন হইয়াছিল। যুদ্ধে মত্ত ছিল বলিয়া কাফ্রিগণ বেলুন দেখিতে পাইয়াছিল না। বেলুনের উপর দৃষ্টি পতিত হইবা মাত্র কিছুক্ষণের জন্য যুদ্ধ থামিয়া গেল। চীৎকার প্রবল হইল। অবিলম্বে বেলুন লক্ষ্য করিয়া তীর নিক্ষিপ্ত হইল। একটা তীর বেলুনের এত নিকটে আসিয়াছিল যে, জো ক্ষিপ্র করে উহা ধরিয়া ফেলিল।

 ফার্গুসন্ বলিলেন—“চল আরো উপরে উঠি। যুদ্ধ দেখতে যেয়ে নিজেদের সর্ব্বনাশ ঘটা’তে পারি না।”

 তখন পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছিল। পূর্ববৎ শোণিতস্রোত ছুটিতেছিল। একজনের অস্ত্রাঘাতে পূর্ব্ববৎ অপরের ছিন্নশির ভূতলে পড়িতেছিল। একজন ধরাশায়ী হইবামাত্র তাহার শত্রু আসিয়া শির কাটিয়া লইতেছিল। রমণীগণও যুদ্ধে যোগ দিয়াছিল। তাহারা সেই সকল ছিন্নশির আহরণ করিয়া সমর-প্রাঙ্গণের উভয় পার্শ্বে রক্ষা করিতেছিল। একজন অপরের নিকট হইতে ছিন্ন নরশির সবলে কাড়িয়া লইতেছিল। আবশ্যক হইলে তাহার জন্য অস্ত্রাঘাত করিতেও কুণ্ঠিত হইতেছিল না।

 কেনেডি কহিলেন—“কি ভয়ানক দৃশ্য!”

 ফার্গুসন্ বলিলেন—“ওদের যদি একটা করে’ পোষাক থাকতো, তা’ হ'লে এই অসভ্য কাফ্রি আর অন্য দেশের সুসভ্য সৈনিকের মধ্যে প্রভেদ কোথায়?”

 বন্দুক তুলিয়া কেনেডি বলিলেন, “আমার ইচ্ছা হচ্ছে যুদ্ধে বাধা দি।”

 বাধা দিয়া ফার্গুসন্ বলিলেন—“সে সবে কাজ নাই ডিক্। এস, আমরা নিজের পথ দেখি। এ দৃশ্য—এ নরহত্যা—আর দেখা যায় না। যারা যুদ্ধ-ব্যবসায়ী, তারা যদি এমনি করে’ বেলুনে উঠে’ নরহত্যা দেখতো, তা হ’লে বোধ হয় তাদের শোণিত-তৃষ্ণা, রাজ্যজয়ের স্পৃহা সবই মুহূর্ত্তে দূর হ’য়ে যেত।”

 যুদ্ধরত দুই দলেরই নেতা ছিল। তাহাদের মধ্যে একজন অতিশয় বলশালী ও স্থুল। যে দিকে শত্রুসংখ্যা অধিক, সে ক্ষিপ্ত হস্তে সেই দিকেই তীক্ষ্ণ বর্শা চালিত করিতেছিল এবং অপর হস্তে ক্ষুরধার কুঠারের আঘাতে শত্রু নিপাত করিতেছিল। কখনো বা রুধিরাক্ত দেহে আহত শত্রুর উপর পতিত হইয়া কুঠারের আঘাতে তাহার বাহু ছিন্ন করিয়া সে সগর্ব্বে চর্ব্বণ করিতে লাগিল।

 কেনেডি এই দৃশ্য দেখিয়া বলিয়আ উঠিলেন—”রাক্ষস! রাক্ষস! ওই দেখ ফার্গুসন্! মানুষ খাচ্ছে!”

 তন্মুহূর্ত্তেই কেনেডির বন্দুকের গুলিতে সেই নরখাদক সর্দ্দারের মস্তক বিচূর্ণিত হইয়া গেল।

 অকস্মাৎ সর্দ্দারকে নিহত হইতে দেখিয়া যোদ্ধাদিগের বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। বিপক্ষদলের উৎসাহ ও উত্তেজনা আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল। অপর পক্ষ ভয়ে পলায়ন করিতে লাগিল।

 ফার্গুসন্ তখন বেলুন লইয়া উর্দ্ধে উঠিতেছিলেন। উঠিতে উঠিতে দেখিলেন বিজয়িগণ অপর পক্ষের আহত ও নিহত যোদ্ধৃগণের হস্ত পদ প্রভৃতি লইয়া নিজেদের মধ্যেই বিবাদ বাধাইয়াছে এবং রুধিরসিক্ত নরদেহ পরমানন্দে ভক্ষণ করিতেছে।