বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ

অনল-মধ্যে

 আকাশ ক্রমেই মেঘাচ্ছন্ন হইতেছিল। বাতাস প্রবলবেগে বহিতে লাগিল। বায়ুতাড়িত হইয়া ভিক্টোরিয়া ঘণ্টায় ৩৫ মাইল পথ অতিক্রম করিতেছিল। ফার্গুসন্ কহিলেন—

 “আমরা এখনো চন্দ্ররাজ্যেই আছি। এ দেশে চন্দ্র পূজিত হ’য়ে থাকেন বলে’ দেশের নামও চন্দ্ররাজা। এমন উর্বর ভূমি পৃথিবীতে বিরল।”

 জো দুঃখ করিয়া কহিল, “ভগবানের কি বিচার! এমন অসভ্য দেশেও এমন স্থান থাকে!”

 ফার্গুসন বলিলেন “কে জানে যে এই দেশ একদিন শিক্ষায় সভ্যতায় পৃথিবীর সকল সুসভ্য দেশের সমান হ’বে না!”

 কেনেডি হাসিয়া বলিলেন “তুমি কি তাই বিশ্বাস কর?”

 “করি বৈ কি! কালের স্রোত কেমন করে’ বয়ে’ যাচ্ছে দেখ। পৃথিবীর আদি থেকে আজ পর্য্যন্ত চেয়ে দেখ—মানুষ কেমন করে’ এক দেশ থেকে আর এক দেশে এক রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে ভ্রমণ করে’ বেড়াচ্ছে। এসিয়াই কি একদিন সমগ্র মানবজাতির আবাসভূমি ছিল না? চার হাজার বৎসর ধরে’ এসিয়াই কি সমগ্র মানবজাতিকে পুত্রের মত স্নেহে লালন পালন করে নাই? এসিয়ার অরণ্য এসিয়ার উষর ক্ষেত্র কি একদিন এই মানবজাতিই উর্বর করে’ তোলে নি? কিন্তু এসিয়ার সুবর্ণখনি যখন নিঃশেষে ফুরিয়ে গেল——যখন সেখানে সোণা তুলতে পাথর উঠতে লাগল, তখন এসিয়ারই বড় আদরের সন্তান-সন্ততি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল। এখন দেখ ইউরোপও দিন দিন উষর ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে—আর সেখানে আগেকার মত শস্য ফলে না। তার বৃক্ষে আর এখন আগেকার মত মধু-ফল হয় না—তার বুকে আর এখন আগেকার মত মাণিক জ্বলে না। ইউরোপের জীবনী-শক্তি ফুরিয়ে আসছে দেখে গতিশীল মানবজাতি আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকারও আবার এই দশাই ঘটবে। আর অরণ্য উর্ব্বর শস্যক্ষেত্র হ’বে—তার বক্ষ চিড়ে মানুষ এখন যে ক্ষীর পান করছে, তা এক সময়ে ফুরিয়ে যাবেই যাবে! আজ তার যে ক্ষেত্রে বৎসরে দু’বার শস্য ফলে, কালে সেখানে তৃণও জন্মাবে না। তখন দেখো আফ্রিকাই মানবের আশ্রয়স্থল হ’বে। আজ আফ্রিকার জলে বিষ, স্থলে বিষাক্তবাণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে— আজ তার বিপুল অরণ্যে সিংহ ব্যাঘ্র ভল্লুক অবাধে বিচরণ করছে, কিন্তু কালে সেই বিষ অমৃত হ’বে, অরণ্য সুসংস্কৃত নগরে পরিণত হ’বে, মরুভূমে উর্বর শস্যক্ষেত্র হাসবে। এখন আমরা যে জনপদের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি, কে জানে কালে সেখানে এমন মানুষ আসবে না যে, তাদের নব নব আবিষ্কারের কাছে বর্ত্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার শিশুর খেলার মত বোধ হ’বে না?”

 উত্তেজিত কণ্ঠে জো কহিল, “হায়, সেদিন যদি দেখে যেতে পারি!”

 “এখনো তার অনেক দেরি আছে জো—অনেক দেরি।” পর্য্যটকদিগের মধ্যে যখন এইরূপ কথাবার্ত্তা হইতেছিল, তখন উজ্জ্বল তপন-কিরণে মেঘমণ্ডল স্তরে স্তরে আলোকিত হইতেছিল। মেঘরাশির প্রান্তদেশ আলোক-সম্পাতে সমুজ্জ্বল হইতেছিল। সুবৃহৎ বৃক্ষ, বৃক্ষের ন্যায় বৃহৎ লতা মসৃণ গালিচার ন্যায় সুবিস্তৃত শৈবালাচ্ছন্ন ভূমিতল সবই যেন কি এক অভিনব শোভা ধারণ করিয়াছিল। স্থানে স্থানে উচ্চ ভূপৃষ্ঠ, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্ব্বতবৎ প্রতীয়মান হইতে লাগিল। দুর্ভেদ্য কানন, দুরতিক্রম্য কণ্টকময় বনভূমি, মধ্যে মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামসমূহ যন্ত্রচালিত চিত্রের পর চিত্রের ন্যায় চক্ষের সম্মুখ দিয়া ভাসিয়া যাইতেছিল।

 জগানিকা হ্রদ হইতে জন্মলাভ করিয়া যে মালাগাজারি নদী কত ক্ষেত্র ধৌত করিয়া, কত প্রান্তরের পার্শ্ব দিয়া, কত অরণ্যের চরণ চুম্বন করিয়া খরবেগে অগ্রসর হইয়াছে, তাহা যেন প্রবহমান জল-প্রপাতের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তাহারই তীরে শত সহস্র স্থূলকায় গো-মেষ-মহিষাদি নিঃশঙ্কচিত্তে বিচরণ করিতেছিল, কখনো বা সুদীর্ঘ তৃণের মধ্যে লুক্কায়িত হইতেছিল। কোথাও আবার সুগন্ধময় বৃক্ষ-লতাপরিপূর্ণ বিস্তৃত ক্ষেত্র, ক্ষুদ্র কুসুমস্তবকের ন্যায় দৃষ্ট হইতেছিল। তাহার মধ্যে নানাস্থানে কোথাও সিংহ, কোথাও ব্যাঘ্র, কোথাও হায়েনা প্রভৃতি অনায়াসে গমনাগমন করিতেছিল। কোন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃক্ষাদি চূর্ণ করিয়া, লতাগুল্মাদি পদ-দলিত করিয়া, সুবৃহৎ বৃক্ষের সুদৃঢ় শাখা-প্রশাখাগুলি অবনত করিয়া, কম্পিত করিয়া করিযূথ আহারান্বেষণে ভ্রমণ করিতেছিল।

 কেনেডি উল্লাসভরে কহিলেন “মৃগয়ার উপযুক্ত দেশ। এখানে শিকার করলে হয় না ফার্গুসন্?”

 “না ডিক্ আজ কাজ নাই। রাত্রি হ’য়ে আসছে। মেঘের অবস্থা দেখে বোধ হচ্ছে ঝড়ও হ’বে। এদেশের ঝড় বড় ভয়ানক। এখানকার ভূমি যেন বৈদ্যুতিক প্রবাহের আকর। বায়ুস্তরও বৈদ্যুতিক প্রবাহে পূর্ণ হয়েছে!”

 “নিচে নামলে হয় না?”

 “নিচে নামলেই বিপদ্ বেশী। বরং উপরে যাওয়াই ভাল। আমার কেবলই শঙ্কা হচ্ছে, প্রবল বাতাস এলে পথ-ভ্রষ্ট হ’য়ে না যাই।”

 “তবে কি করবে?”

 “যদি পারি, আরো উপরে উঠব।”

 প্রকৃতি ক্রমেই স্তব্ধ হইতেছিল দেখিয়া ফার্গুসন্ বুঝিলেন অবিলম্বে ঝড় হইবে। নিষ্কম্প বৃক্ষপত্র, নিশ্চল মেঘমালা, নিস্তব্ধ প্রকৃতি তাঁহাকে একান্ত শঙ্কান্বিত করিয়া তুলিল। বিমান-বিহারী পক্ষিগণ দেখিতে দেখিতে বৃক্ষকোটরে আশ্রয় লইল। রাত্রি নয়টার সময় দেখা গেল বেলুন আর চলিতেছেই না।

 উদ্বিগ্ন হইয়া ফার্গুসন্ কহিলেন, “ডিক্, ঝড় ত আসবেই, এখন কি করি?”

 জো বলিল, “এখনো মেঘ উঁচুতে আছে, আমার মনে হয় আজ রাত্রে ঝড় হ’বে না।”

 “মেঘেরই চেহারা ভাল নয়। হয়ত ঘূর্ণী বাতাসও হ’তে পারে। তা’ হ’লে দেখছি এই মহাশূন্যে আমাদের বন্ বন্ করে’ ঘুরতে হ’বে। মেঘে বিদ্যুৎ ভরা। বেলুনে আগুনও লেগে যেতে পারে! যদি গাছের সঙ্গে নোঙ্গর বাঁধি, তা’ হ’লে বাতাসের বেগে হয় ত গাছের উপরই আছাড় খেয়ে পড়বো!”

 ভিক্টোরিয়া তখন মেনে হ্রদের উপর নিশ্চল ভাবে অবস্থান করিতেছিল। নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহ মৃতবৎ সুপ্ত বলিয়া মনে হইতে লাগিল। সেই বিপুল অন্ধকার ভেদ করিয়া কদাচিৎ দুই একটা আলোকরশ্মি হ্রদের মধ্যে জলের সহিত ক্রীড়া করিতেছিল।

 কেনেডি চিন্তিত হইয়া কহিলেন, “তবে উপায়?”

 “ভিক্টোরিয়াকে এখন মাঝামাঝি পথে রাখতে হ’বে। তোমরা ঘুমাও। আমিই জেগে আছি।”

 “আমরাও তোমার সঙ্গে সঙ্গে জেগে থাকি। কি জানি হঠাৎ যদি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়।”

 জো কহিল “এখনো তো কোনো বিপদ্ আসে নাই, আমি বেলুন পাহারা দি—আপনারা বিশ্রাম করুন।”

 ফার্গুসন্ তাহাতে স্বীকৃত হইলেন না। বলিলেন, “আমাকে পাহারা দিতেই হ’বে। তোমরা নিদ্রা যাও। আবশ্যক হ’লেই ডেকে তুলবো।”

 কেনেডি এবং জো শয়ন করিলেন, ফার্গুসন্ একাকী প্রহরার কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। অল্পক্ষণ পর ঊর্দ্ধে সঞ্চিত মেঘরাশি ধীরে ধীরে নিম্নে নামিতে লাগিল। অন্ধকার আরও গভীর হইয়া উঠিল। আঁধার—আঁধার—আঁধার! সূচীভেদ্য অন্ধকারে বিশ্ব ছাইল। ফার্গুসন্ আরো চিন্তিত হইলেন।

 অকস্মাৎ আকাশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত বিদ্যুৎ ঝলসিল। সঙ্গে সঙ্গে বিপুল গর্জ্জনে দিঙ্মণ্ডল কম্পিত হইয়া উঠিল।

 ফার্গুসন্ ডাকিলেন, “ওঠো—হুসিয়ার হও।”

 কেনেডি ত্রস্তে শয্যা ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “আমরা কি তবে বেলুন ছেড়ে নিচে নামবো?”

 “না—না—তা’ হ’লে বেলুন টিকবে না, ঝড় বৃষ্টি সঙ্গে নিয়ে মেঘ নামতে না নামতে চল আমরা উপরে উঠি।”

 ফার্গুসন্ অবিলম্বে গ্যাস-নলে তাপ দিতে আরম্ভ করিলেন। আবার বিদ্যুৎ খেলিল। আবার গভীর শব্দে মেঘ ডাকিল। ঐ আবার—ঐ আবার—ঐ আবার! মুহূর্ত্তে ২01২৫ বার বিদ্যুৎ জ্বলিল-গগন বিদীর্ণ করিয়া বিপুল নিনাদে মেঘ গর্জ্জিল! পর্য্যটকগণ প্রমাদ গণিলেন। বৃষ্টি নামিল—মুষলধারে বৃষ্টি। এক একটা ফোঁটা যেন শিলার ন্যায় পতিত হইতে লাগিল। সমস্ত আকাশ জুড়িয়া দারুণ অগ্নিকাণ্ড উপস্থিত হইল!

 ফার্গুসন্ বলিলেন,“আমাদের অনেক আগেই উপরে যাওয়া উচিত ছিল। এখন দেখছি এই অগ্নিস্তর ভেদ করে’ উঠতে হ’বে। বেলুন ত দাহ্য পদার্থে পরিপূর্ণ—মুহূর্ত্তে আগুন ধরে’ যেতে পারে—”

 “তবে চল ফার্গুসন্, নামি।”

 “তা’তে কি ভাই বজ্রাঘাতের ভয় যাবে? গাছের ডালে লেগে কেবল বেলুনটা ছিঁড়বে।”

 অবিলম্বে ভীম বেগে বায়ু বহিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল যেন সেই ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশি বায়ুতাড়িত হইয়া কেবল অগ্নি উদ্গীরণ করিতেছে। বেলুন ক্রমে উর্দ্ধে উঠিতে লাগিল। কখনো ঘুরিতে আরম্ভ করিল—কখনো বা ঘুরিতে ঘুরিতে ঊর্দ্ধে উঠিতে লাগিল, বাতাস প্রবলবেগে বেলুনগাত্রে প্রহত হইয়া ফিরিতে লাগিল। বোধ হইল যেন বেলুনের সে রেশমের আবরণ এখনই ছিন্ন হইয়া যাইবে। উহা দমিতে লাগিল—কুঞ্চিত হইতে লাগিল—স্থানে স্থানে চাপিয়া বসিতে লাগিল! তখন শিলাবৃষ্টি আরম্ভ হইল। ফার্গুসন্ তখনো গ্যাসে তাপ দিতেছিলেন—ভিক্টোরিয়া তখনো উপরে উঠিতেছিল। বেলুনের ঊর্দ্ধে নিম্নে দক্ষিণে বামে তখনো লকলক করিয়া বিদ্যুৎ জ্বলিতেছিল। দশদিক্ কম্পিত করিয়া তখনো বজ্র ডাকিতেছিল!

 ফার্গুসন্ ক্ষান্ত হইলেন না। কহিলেন, “এখন ভগবান্ ভরসা। তিনি রাখেন বাঁচিব—নহিলে আর কোনো উপায় নাই।”

 ফার্গুসনের সঙ্গীদ্বয় তখন একেবারেই হতবুদ্ধি হইয়াছিলেন। তাঁহার কথা কাহারো কর্ণে প্রবেশ করিল না। বেলুন উর্দ্ধে উঠিতেছিল। সেই অন্ধকারের ভিতর দিয়া দারুণ শিলাবৃষ্টি কর্ত্তৃক প্রহত হইয়া ভিক্টোরিয়া অগ্নি-রাজ্যের ভিতর দিয়া ক্রমেই উচ্চে—আরো উচ্চে উঠিতেছিল।

 পনের মিনিটের মধ্যেই উহা ঝড়ের সীমা অতিক্রম করিল। আহা কি সুন্দর দৃশ্য! মস্তকের উপর উজ্জ্বল নক্ষত্রখচিল নির্ম্মল আকাশ, আর পদতলে প্রলয়ের বায়ুপ্রবাহ সহস্র মুখে অগ্নি ঢালিতে ঢালিতে দিক্ হইতে দিগন্তে ছুটিয়া চলিয়াছে! চন্দ্রের শীতল উজ্জ্বল কনক কিরণরাশি কালো মেঘের উপর পতিত হইয়া আলো করিয়া তুলিয়াছে। এ দৃশ্য মানব-নয়নের অতীত।

 তাঁহারা নির্ব্বাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন।