বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

নীল নদী

 প্রভাতে জো ফার্গুসনের হস্তমুক্ত কুঠার-খানি খুঁজিয়া বাহির করিল। ফার্গু সন্ বেলুন ছাড়িলেন। উহা ঘণ্টায় ১৮ মাইল বেগে চলিতে লাগিল। তিনি আজ বড় চঞ্চল হইলেন। ক্ষণে ক্ষণেই দূরবীক্ষণ দ্বারা চতুদিক্ দেখিতে লাগিলেন। ভিক্টোরিয়া রুবেমি-পর্ব্বত-শৃঙ্গ অতিক্রম করিয়া কারাগোয়া শৈলমালার প্রথম পর্ব্বত টেঙ্গার সমীপবর্ত্তী হইল। প্রাচীন কাহিনী পাঠে ফার্গুসন্ জানিয়াছিলেন যে, কারাগোয়া শৈলমালাই নীল নদীর প্রথম ক্রীড়া-ক্ষেত্র। তাঁহার মনে হইতে লাগিল এ কাহিনী সত্য, কারণ এই সকল পর্ব্বতই ইউকেরিউ হ্রদ পরিবেষ্টিত করিয়া রাখিয়াছে। আরো কিছুদূর অগ্রসর হইতেই ফার্গুসনের বোধ হইল যেন দূরে দিগ্বলয়ের নিকটে সেই বিশ্ববিশ্রুত হ্রদের উজ্জল বারিরাশি দেখা যাইতেছে!

 ফার্গুসন্ বিশেষ মনোযোগ সহকারে সেই প্রদেশ পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। তিনি দেখিলেন চরণনিম্নে অনুর্বর ক্ষেত্র। কয়েকটা গিরিসঙ্কটে সামান্য কিছু শস্য জন্মিয়াছে। ক্রমেই উচ্চভূমি পর্বত-শিখরবৎ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে।

 দেখিতে দেখিতে কারাগোয়ার প্রধান নগর নিকটবর্ত্তী হইল। ৫০ খানি কুটীর লইয়া নগর। পীত ও পিঙ্গল বর্ণের কাফ্রিগণ বিস্মিত হইয়া ভিক্টোরিয়ার দিকে চাহিয়া রহিল। সে দেশের রমণীগণ অস্বাভাবিক রূপে স্থূলাঙ্গী। তাহারা কোন প্রকারে আপন আপন স্থূল দেহ বহন করিয়া উপনিবেশ মধ্যে ভ্রমণ করিতেছিল। ফার্গুসন্ সঙ্গীদিগকে কহিলেন, “স্থূলাঙ্গই এ দেশের রমণী-কুলের লাবণ্যের লক্ষণ। রমণীদিগকে স্থূলাঙ্গী করিবার নিমিত্ত এক প্রকার ঘোল পান করিতে দেওয়া হয়।”

 বেলুন ভিক্টোরিয়া-নায়াঞ্জা হ্রদের নিকট দিয়া উত্তরদিকে যাইতেছিল। পর্য্যটকগণ দেখিলেন সেদিকে জন-মানবের চিহ্ন পর্য্যন্তও নাই। হ্রদের তীর কণ্টকবনে সমাকীর্ণ। কোটী কোটী পিঙ্গল বর্ণের মশক সেই সকল কণ্টক বৃক্ষ ও লতাদি আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। শত শত সিন্ধুঘোটক হ্রদের মধ্যে ক্রীড়া করিতেছে। হ্রদ পশ্চিমদিকে সমুদ্রতুল্য বিস্তৃত।

 সন্ধ্যা-সমাগমে ফার্গুসন্ একটী দ্বীপের উপর নোঙ্গর করিয়া বলিলেন, “এই হ্রদের মধ্যে যে সকল দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, সে সমস্তই হ্রদগর্ভস্থ পর্ব্বতের চূড়া। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা একটা পাথরের গায়ে নোঙ্গর বাঁধতে পেরেছি। হ্রদের তীরে যে সকল জাতি বাস করে, তারা বন্য পশুর চেয়েও হিংস্র। এখন তোমরা নির্বিবাদে নিদ্রা যাও রাত্রে আর কোনো বিপদের আশঙ্কা দেখছিনে।”

 কেনেডি বলিলেন, “তুমি ঘুমুবে না?”

 “আমার ঘুম আসরে না ডিক্। চিন্তায় আমার মস্তিষ্ক আলোড়িত হচ্ছে। যদি সুবাতাস পাই, তা’ হ’লে নিশ্চয় কালই নীল নদীর জন্মক্ষেত্র দেখতে পাব। যে তীর্থ দর্শন করতে বেরিয়েছি, তার সিংহদ্বারের নিকট এসে কি আর আমার ঘুম আসবে।”

 কেনেডি এবং জো নীল নদীর জন্মস্থান দেখিবার জন্য কিছুমাত্র ব্যস্ত ছিলেন না। ফার্গুসনকে প্রহরী কার্য্যে নিযুক্ত করিয়া তাঁহারা স্বচ্ছন্দে নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন।

 ভোর চারিটার সময় বেলুন আবার চলিতে লাগিল। বাতাস তখন প্রবল বেগে উত্তর মুখে বহিতেছিল। বেলুন ঘণ্টায় ৩০ মাইল বেগে চলিতে লাগিল। তখন পদনিম্নে বায়ুতাড়িত নায়াঞ্জা হ্রদে বিপুল তরঙ্গোচ্ছ্বাস হইতেছিল। তরঙ্গশিরে ফেনপুঞ্জ তপন কিরণে বড় উজ্জল দেখাইতেছিল। বেলুন বেলা ৯টার সময় হ্রদের পশ্চিম তীরে উপনীত হইল। সেদিকে কেবল মরুভূমি ও কোন স্থানে ঘন বন ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। বেলুন আরো অগ্রসর হইল। তখন দূরে নায়াঞ্জা হ্রদের প্রান্তদেশে উচ্চ গিরিমালার শুষ্ক কঠিন চূড়াগুলি দেখা যাইতে লাগিল। বোধ হইল যেন তথা হইতে একটী বেগশালী নদী বক্রপথে প্রবাহিত হইয়াছে। ফার্গুসন্ বলিলেন “দেখ—দেখ। আরবরা যা বলছে তা’ ঠিক। তারা বলেছে একটা নদী আছে, ইউকেরিও হ্রদের বারিরাশি সেই নদী দিয়ে উত্তরমুখে বয়ে যায়। ওই ত সে নদী। নিশ্চয়ই এই নদী নীল নদী।”

 “নীল নদী!” কেনেডি বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “নীল নদী।”

 বেলুন তখন নদীর উপর দিয়া শূন্য-পথে ভাসিয়া যাইতেছিল। বিশাল পর্ব্বতশ্রেণী স্থানে স্থানে নদীর মুক্ত পথ রুদ্ধ করিয়া দণ্ডায়মান ছিল। প্রহৃত বারি-রাশি ফুলিয়া ফাঁপিয়া গর্জ্জন করিয়া কখনো ভীম জলপ্রপাতবৎ কখনো বা পর্ব্বতরন্ধের ভিতর দিয়া সহস্র ধরে’ বহিয়া যাইতেছিল। পর্ব্বত হইতে শত সহস্র ধারা নামিয়া সেই বেগশালী বারিপ্রবাহের সহিত মিলিত হইতেছিল।

 ফার্গুসন্ বলিলেন, “এইটাই নীল নদী। নদীর নাম নিয়েও যেমন গোলযোগ, উৎপত্তি-স্থান নিয়েও তেমনি গোলযোগ।”

 কেনেডি বলিলেন, “এটা যে সত্যই নীল নদী তার প্রমাণ কি?”

 “তার অভ্রান্ত প্রমাণ আছে।”

 “এখানে অবতরণ করা সম্ভব হ’বে না। ওই দেখ কাফ্রিরা বেলুন দেখে কেমন কুপিত হয়েছে।”

 “তা’ হো’ক্। আমাকে নামতেই হ’বে।”

 “এখানে নামলে বিপদ্ ঘটিতে পারে।”

 “যদি ঘটে, তার উপায় নাই। যদি বন্দুকের মুখে শত্রু তাড়িয়েও নামতে হয়, তাও স্বীকার।”

 ফার্গুসন্ বেলুনকে ঊর্দ্ধে তুলিলেন। ২৫০০ ফিট উপরে উঠিয়া তাঁহারা দেখিলেন যে, চতুদ্দিক্ হইতে শত সহস্র ক্ষুদ্রশরীরা তরঙ্গিণী আসিয়া নীল নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে। তাহাদের অধিকাংশই পশ্চিমদিকের শৈলমালা হইতে বহির্গত হইয়াছে। ফাগুসন্ মানচিত্র আলোচনা করিয়া বলিলেন “উত্তর থেকে যাঁরা এ দিকে এসেছিলেন, আমরা এখনো তাঁদের আবিষ্কৃত স্থানে যেতে পারিনি। গণ্ডরোকা এখান থেকে ৯০ মাইল হ’বে। এখন ধীরে ধারে নামা যাক। তোমরা সাবধান হও।”

 বেলুন নামিতে লাগিল। এখানে নীল নদীর বিস্তার অধিক ছিল না। পার্শ্ববর্ত্তী গ্রামসমূহের অধিবাসিগণ বেলুনকে একটা দৈত্য মনে করিয়া চঞ্চল হইয়া উঠিল। ফার্গুসন্ দেখিলেন অল্প দূরেই নীল নদী ৭/৮ হস্ত মাত্র গভীর জল-ধারা বহিয়া অগ্রসর হইয়াছে।

 তিনি হর্ষোৎফুল্ল হইয়া বলিলেন, “ওই তো সেই জলপ্রপাত! পর্য্যটক ডিবোনা ওর কথাই বলে গেছেন।”

 বেলুন যতই অগ্রসর হইতে লাগিল, নদীর বিস্তার ততই অধিক হইতে লাগিল। ক্রমেই নদীমধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ-পুঞ্জ দেখা যাইতে লাগিল। ফার্গুসন্ বিশেষ মনোযোগের সহিত দ্বীপগুলি দেখিতে লাগিলেন। কতকগুলি কাফ্রি একখানি ডোঙ্গায় আরোহণ করিয়া বেলুনের তলদেশে আসিবামাত্র কেনেডি বন্দুকের গুলি চালাইয়া তাহাদিগের অভ্যর্থনা করিলেন। তাহারা প্রাণভয়ে পলায়ন করিল।

 ফার্গুসনের দৃষ্টি এদিকে ছিল না। তিনি দূরবীক্ষণ লইয়া নদীর ঠিক মধ্যস্থলে স্থিত একটা ক্ষুদ্র দ্বীপ বিশেষ অভিনিবেশ পূর্ব্বক দেখিতেছিলেন। দেখিতে দেখিতে কহিলেন,

 “ওই না চারটা গাছ দেখা যাচ্ছে? ওই দ্বীপের নাম বেঙ্গল দ্বীপ। আমাদের ওইখানে নামতে হবে।”

 “কতকগুলো কাফ্রিদের ওখানে বাস আছে ব’লে বোধ হচ্ছে না?”

 “তা’ হো’ক ডিক্। ওরা দেখছি জন কুড়ি হ’বে। বন্দুক থাকতে কুড়ি জন কাফ্রি তাড়িয়ে দিতে কত সময় লাগবে!”

 তখন মধ্যাহ্ন-সূর্য্য ঠিক মস্তকোপরি অগ্নি বর্ষণ করিতেছিল। বেলুন দ্বীপের সমীপবর্ত্তী হইতেছে দেখিবামাত্রই কাফ্রিগণ চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। তাহাদের মধ্যে এক জন বৃক্ষ ত্বকে নির্ম্মিত টুপী আপন মস্তক হইতে লইয়া নাড়িতে লাগিল। কেনেডি টুপী লক্ষ্য করিয়া গুলি করিলেন। উহা শতখণ্ডে চূর্ণ হইয়া গেল। কাফ্রিগণ ক্ষিপ্রচরণে পলায়ন করিল। কতক বা নদী মধ্যে ঝম্প প্রদান করিল। নদীর উভয় তীর হইতে শত সহস্র গুণমুক্ত শর বৃষ্টির ধারার ন্যায় পতিত হইতে লাগিল।

 কেনেডি ও ফার্গুসন্ অবতরণ করিলেন।

 দ্বীপের প্রান্তদেশে কয়েকটী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্ব্বত ছিল। ফার্গুসন্ বন্ধুকে সেই দিকে টানিয়া লইয়া গেলেন। তথাকার কণ্টকময় লতা-গুল্মাদি সরাইতে সরাইতে ক্ষত বিক্ষত হইয়া ফার্গুসন্ একবার হর্ষে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন—

 “এই দেখ ডিক্—প্রমাণ দেখ।”

 “তাই ত পাথরের গায়ে লেখা দেখছি।”

 “দেখ, দেখ। দু’টী অক্ষরই ইংরাজী!”

 ডিক্ অপেক্ষাকৃত উচ্চ কণ্ঠে পাঠ করিলেন—“এ, ডি।”

 ফার্গুসন্ বলিলেন, “এ ডি আর কিছুই নয়, আন্দ্রিয়া ডিবোনো। ইনিই নীল নদীর সর্ব্ব উত্তর সীমা দেখে গেছেন।”

 দুই বন্ধু আনন্দে কর মর্দ্দন করিলেন।