বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ





সব শেষ
প্রভাত। বিপদের রজনীশেষে অতি সুন্দর উজ্জ্বল প্রভাত। প্রভাতে পাদরীকে পরীক্ষা করিয়া ফার্গুসন্ কহিলেন—
“এখনো ভরসা আছে। খুব যত্ন চাই ডিক্।”
পাদরী নিরুদ্বেগে নিদ্রা যাইতেছিলেন। ফার্গুসন্ তাঁহাকে জাগরিত করিলেন না। জো এবং ডিক্ পাদরীর শুশ্রূষায় নিযুক্ত হইলেন। এইরূপে সে রজনী অতিবাহিত হইল। পরদিন প্রভাতে ফার্গুসন্ জিজ্ঞাসা করিলেন—
“এখন কেমন বোধ হচ্ছে?”
“একটু ভাল। আমার মনে হচ্ছে যেন আমি স্বপ্ন দেখছি। যেন স্বপ্নঘোরেই আপনাদের দেখছি। আপনারা কে? ভগবানের কাছে আমার শেষ প্রার্থনার সময়েও যেন আপনাদের কথা নিবেদন করতে পারি।”
“আমরা তিন জন ইংরাজ-পর্যটক। বেলুনে চড়ে’ আফ্রিকা অতিক্রম করছি। পথে আসতে আসতে ভগবানের কৃপায় আপনাকে রক্ষা করেছি। অনুমান হয় আপনি একজন পাদরী।”
“হাঁ। ভগবান্ আপনাদের আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! আমার জীবন শেষ হয়েছে। আপনারা ত য়ুরোপ থেকে এসেছেন? আমাকে য়ুরোপের কথা বলুন—ফ্রান্সের কথা বলুন। আমি পাঁচ বৎসর ফ্রান্সের নাম শুনি নাই।”
“আপনি এতদিন ধরে' এই রাক্ষসদের মধ্যে বাস করছেন?”
“ওদেরও ত মুক্তির উপায় করতে হ’বে। ওরা অজ্ঞ অসভ্য বর্ব্বর। কিন্তু ওরাও আমাদের ভাই।”
ফার্গুসন্ পাদরীর নিকট ফ্রান্সের গল্প করিতে লাগিলেন। জো তাঁহার জন্য চা প্রস্তুত করিয়া দিল। বহুদিন পর চা পান করিয়া মুক্ত পবনে মুক্ত গগনে ভাসিতে ভাসিতে তাঁহার মনে হইতে লাগিল যেন শরীরে শক্তি ফিরিয়াছে। তিনি শয়ন করিয়াছিলেন, উঠিয়া বসিলেন এবং সকলের সহিত কর মর্দ্দন করিলেন। কহিলেন—
“আপনারা খুব সাহসী পর্য্যটক। এমন অসম্ভব পর্য্যটনকেও আপনারা সম্ভব করে’ তুলতে পেরেছেন। আবার আপনারা হর্ষে গৌরবে স্বদেশের মুখ দেখতে পাবেন। আত্মীয়-স্বজনদের সহাস্যবদন দেখে পরিতৃপ্ত হ’তে পারবেন, আপনাদের—”
পাদরী আর কথা কহিতে পারিলেন না। এতই দুর্ব্বল হইয়া পড়িলেন যে, সকলে ধরাধরি করিয়া তাঁহাকে সাবধানে শয্যার উপর স্থাপন করিলেন। ফার্গুসন্ বুঝিলেন, সেই শীর্ণ দেহের ভিতর যে প্রাণ স্পন্দিত হইতেছিল, তাহার শেষ সময় নিকটবর্ত্তী হইতেছে। তিনি পুনরায় রোগীর ক্ষতগুলি ধৌত করিয়া দিলেন, তাঁহার উষ্ণদেহে শীতল বারি সিঞ্চন করিলেন; সঙ্গে যে অধিক জল ছিল না সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করিলেন না। বহুক্ষণ পর পাদরীর জ্ঞান-সঞ্চার হইল। তিনি ধীরে ধীরে আত্মকাহিনী বর্ণনা করিতে লাগিলেন। বলিলেন—
“ব্রিটানি প্রদেশের আরাডন নামক ক্ষুদ্র গ্রামে আমার বাস। আমরা বড় দরিদ্র। বিশ বৎসর বয়সের সময় আমি গৃহ ত্যাগ করে’ এই বান্ধবহীন আফ্রিকায় এসেছি। কতবার বাধার পর বাধা এসে আমার যাত্রাপথ রোধ করে’ দাঁড়িয়েছে। তৃষ্ণা ক্ষুধা শ্রান্তি রোগ কিছুতেই আমাকে নিবৃত্ত করতে পারে নাই। ধীরে ধীরে অগ্রসর হ’তে হ’তে আমি এতদূর পর্যন্ত এসেছি।” পাদরী একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিতে লাগিলেন—
“ন্যাম্বরা জাতির কাফ্রিগণ বড় নিষ্ঠুর। তাদের কাছে আমি অপরিসীম যাতনা পেয়েছি। গ্রাম্যকলহে লিপ্ত হ’য়ে ন্যাম্বরাগণ যখন আমাকে ত্যাগ করেছিল, তখন আমি প্রত্ত্যাবর্তন করলে করতে পারতেম। কিন্তু মনে হলো এদের মধ্যে ধর্ম্ম প্রচার করাই আমার কর্তব্য। তাই আর ফিরলেম না, ক্রমেই সম্মুখে অগ্রসর হ’তে লাগলেম। কাফ্রিরা মনে করলে আমি একটা পাগল। যতদিন তাদের এ ধারণা ছিল, ততদিন আমি অনেকটা শান্তিতেই ছিলাম। আমি এদের ভাষা শিখেছি। বারাফ্রি সম্প্রদায় ন্যাম্ন্যাম্ জাতির মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা নিষ্ঠুর ও হিংস্র। আমি অনেকদিন থেকে এদের মধ্যেই কাটাচ্ছিলেম। ওদের সর্দ্দার কয়েকদিন হ’লো মরে’ গেছে। ওরা মনে করলে আমি কোন মন্ত্র-তন্ত্র করে’ তাকে মেরে ফেলেছি! আমার বধাজ্ঞা প্রচার হ’লো। রজনী প্রভাতেই আমর দেহ শূলে বিদ্ধ হ’তো—দেবদূতের ন্যায় এসে আপনারা আমাকে বাঁচিয়েছেন।”
“আমি যখন বন্দুকের শব্দ শুনলেম তখনিই ‘রক্ষা কর’ বলে’ চিৎকার করেছিলাম। তার পর অনেকক্ষণ গেল, যখন আর কোন সাড়া পেলেম না, তখন মনে করলেম, ওটা বন্দুকের শব্দ নয়—ও আমার জাগ্রত স্বপ্ন মাত্র! আমি যে এখনো বেঁচে আছি, এ—ই আশ্চর্য্য।”
ফার্গুসন্ বলিলেন—
“চিন্তা কি। ধৈর্য্য ধরুন—সাহস করুন। আমরা ত কাছেই আছি। কাফ্রিদের কবল থেকে যখন আপনাকে রক্ষা করতে পেরেছি, মৃত্যুর হাত থেকে কি পারবো না?”
“আমি অত দূর আশা করি না। ভগবানের কাছে আমি অতটা চাই না। মৃত্যুর পূর্ব্বে যে বন্ধুর করস্পর্শ করতে পারলেম—স্বদেশের মধুর কথা শুনতে পেলেম এ-ই যথেষ্ট।”
পাদরী ক্রমেই দুর্ব্বল হইতে লাগিলেন। তাঁহার অবস্থা ক্রমেই শঙ্কটাপন্ন হইতে লাগিল।
বেলুন যেমন চলিতেছিল, তেমনি চলিল।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে দেখা গেল, পশ্চিমে ভীষণ অগ্নিকাণ্ড উপস্থিত হইয়াছে! সমস্ত আকাশ আরক্তিম হইয়া উঠিয়াছে!
মনোযোগ পূর্ব্বক দেখিয়া ফার্গুসন্ কহিলেন—“ওটা আগ্নেয়গিরির অগ্নিশিখা!”
কেনেডি ব্যস্ত হইয়া কহিলেন—“বাতাস যে আমাদের ওই দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।”
“ভয় নাই ডিক্। আমরা অনেক উপর দিয়ে চলে’ যাব। আগুন আমাদের স্পর্শ করিতে পারবে না।”
তিন ঘণ্টার পর ভিক্টোরিয়া সেই অগ্নিশিখার নিকটবর্ত্তী হইল। পর্ব্বতগর্ভ হইতে গলিত গন্ধকরাশি উৎসের ন্যায় উত্থিত হইয়া ভীষণ শব্দে চতুর্দ্দিকে পতিত হইতেছিল। মধ্যে মধ্যে উত্তপ্ত প্রস্তরখণ্ড বহু ঊর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত হইতেছিল। ফার্গুসন্ বেলুনের গ্যাসে তাপ দিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে ভিক্টোরিয়া ছয় সহস্র ফিট উচ্চে উঠিল এবং অনায়াসে আগ্নেয় পর্ব্বত অতিক্রম করিল।
পাদরীর প্রবল প্রতাপ তখন নির্ব্বাণোন্মুখ হইয়াছিল। তিনি দুই চারিটী অসংলগ্ন বাক্য উচ্চারণ করিলেন। তাঁহার নিশ্বাস ক্রমেই তীক্ষ্ণ হইয়া আসিতে লাগিল।
তখন মস্তকোপরি বিমল গগনে অসংখ্য তারকা জ্বলিতেছিল। পাদরী সেই তারকাখচিত আকাশের দিকে চাহিতে চাহিতে অতিশয় ক্ষীণকণ্ঠে কহিলেন—“বন্ধুগণ, আমি বিদায় হই। ভগবান্ যেন আপনাদের বাঞ্ছিত স্থানে নিয়ে যান। তিনিই যেন আমার ঋণ পরিশোধ করেন।”
কেনেডি কহিলেন, “এখনো ভরসা আছে। এমন সুন্দর রাত্রে কি কেউ মরতে পারে?”
“মৃত্যু আমার শিয়রে এসে বসেছে—আমি তা’ ঠিক বুঝেছি। আর কেন? বীরের মত মৃত্যুর মুখের দিকে চাইতে দিন। মৃত্যুই এ জন্মের শেষ—আবার সেইখান থেকেই অনন্তের আরম্ভ। বন্ধুগণ, দয়া করে’ আমাকে আমার জানুর উপর বসিয়ে দিন।”
কেনেডি তাহাই করিলেন। পাদরীর দুর্ব্বল শরীর কম্পিত হইতে লাগিল। তিনি ধীরে ধীরে কহিলেন—“হে ভগবান, দয়া কর—দয়া কর—তোমার কাছে টেনে নাও।”
তাঁহার বদনমণ্ডল উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তিনি তখন পৃথিবীর মায়ালোক ত্যাগ করিয়া স্বর্গের সিংহদ্বারের দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন। বন্ধুদিগকে শেষবার আশীর্ব্বাদ করিয়াই পাদরী কেনেডির বাহুর উপর ঢলিয়া পড়িলেন! ফার্গুসন্ গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন—“সব শেষ ডিক্, সব শেষ!”
তাঁহারা রোদন করিতে লাগিলেন।
রজনী প্রভাত হইল। ভিক্টোরিয়া তখন একটী শৈলচূড়ার উপর দিয়া ধীরে ধীরে যাইতেছিল। নিম্নে কোথাও মৃত আগ্নেয়-পর্বত বদন ব্যাদন করিয়া অবস্থিত ছিল, কোথাও বা বিশুষ্কা পার্ব্বত্যতরঙ্গিণীর শেষ রেখা দেখা যাইতেছিল। নিকটবর্ত্তী শৈলমালা বারিহীন শুষ্ক ও একান্ত কঠিন বলিয়া প্রতীয়মান হইতে লাগিল। কোথাও স্তূপীকৃত প্রস্তরখণ্ড, কোথাও অতি বৃহৎ শিলা প্রতি মুহূর্ত্তেই বলিয়া দিতে লাগিল, এ প্রদেশ একান্ত নীরস, নিতান্ত ঊষর। তথায় বৃক্ষ লতা গুল্ম কিছুই ছিল না। যতদূর চক্ষু চলে কেবল শুষ্ক কঠিন নীরস প্রস্তর রৌদ্র-কিরণে ঝক্ ঝক্ করিতেছিল।
দ্বিপ্রহরে ফার্গুসন্ একটী অতি প্রাচীন গিরিশঙ্কট-মধ্যে অবতরণ করিতে চাহিলেন—ইচ্ছা, তথায় পাদরীকে সমাহিত করিবেন। গ্যাসের উত্তাপ কমিল। বেলুন ধীরে ধীরে নীচে নামিয়া প্রস্তর স্পর্শ করিল। জো এক লম্ফে নিম্নে অবতরণ করিয়া এক হস্তে বেলুন ধরিয়া অপর হস্তে কতকগুলি প্রস্তরখণ্ড তুলিয়া বেলুন-মধ্যে স্থাপিত করিল। বেলুন স্থির হইল। জো আরও প্রস্তর তুলিল। বেলুন অচল হইল। কেনেডি এবং ফার্গুসন্ অবতরণ করিলেন।
গিরিশঙ্কট-মেধ্য অত্যন্ত গরম অনুভূত হইতেছিল। মধ্যাহ্ণতপন তখন মস্তকোপরি অনল বর্ষণ করিতেছিল। তিন জনে চেষ্টা করিয়া পাদরীকে সমাহিত করিলেন।
ফার্গুসন্কে চিন্তান্বিত দেখিয়া কেনেডি কহিলেন—
“কি ভাবছ, ফার্গুসন্?”
“ভাবছি, অক্লান্ত পরিশ্রম করে’ ধৈর্য্যেরসঙ্গে সমস্ত বিপদ্ মাথায় নিতে পারলে, কি পুরস্কারই না মিলতে পারে! প্রকৃতির কি বিসংবাদী ব্যবস্থা। যেখানে কেবল আরাম সেখানে পুরস্কার নাই। যেখানে অগণিত বিপদ্ সেইখানেই সব আছে—ধন, সম্পদ্, মান, যা’ চাও। আজ আমরা কোথায় এই বীর ধর্ম্মযাজককে সমাহিত করলেম, জান?”
“কেন?”
“এই গিরিশঙ্কট যে স্বর্ণক্ষেত্র! যে পাদরী জীবন–কালে দারিদ্র্য ভিন্ন আর কিছুই জানতেন না, জীবনান্তে তিনি একটা বিপুল স্বর্ণক্ষেত্রে সমাহিত হয়েছেন!”
“স্বর্ণক্ষেত্রে! এ কি তবে স্বর্ণের খনি?”
“এই যে সব প্রস্তরখণ্ড তোমরা মূল্যহীন মনে করে’ চরণে দলিত করছ, এর মধ্যেই বিশুদ্ধ স্বর্ণ বর্ত্তমান আছে।”
জো বলিয়া উঠিল— “অসম্ভব! অসম্ভব!”
“অসম্ভব নয়, জো। একটু অনুসন্ধান করলেই দেখতে পাবে।”
জো উন্মত্তের ন্যায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত প্রস্তরখণ্ডগুলি অপসৃত করিতে লাগিল।
ফার্গুসন্ বলিলেন
“জো ঠাণ্ডা হও—ঠাণ্ডা হও। কি করছ? এই অনন্ত সম্পদ্ তোমার কোন্ কাজে আসবে, জো? আমরা ত আর এ সব নিয়ে যেতে পারবো না।”
“কেন? কেন?”
“বেলুন অত ভার সইবে কেন?”
“আপনি বলেন কি! এত সোণা এখানে রয়েছে—আর আমরা কিছু সঙ্গে নিব না!—নিলে বড় মানুষ হ’য়ে যাব!”
জো উত্তেজিত হইয়া উঠিল।
“সাবধান, জো। স্বর্ণমোহ ক্রমেই তোমায় আছন্ন করে ফেলছে। মনুষ্য-জীবন যে অসার, তা’ কি পাদরীর সমাধি দেখে বুঝতে পারছ না?”
জো বিরক্ত হইয়া কহিল—
“ও সব কথা বক্তৃতায় ভাল শুনায়। এ ত আর শুধু কথা নয়—ভারি ভারি সোণার দলা! আসুন মিঃ কেনেডি, আমরা দু’জনে দু’চার কোটী টাকার সোণা তুলে নি।”
কেনেডি হাসিতে হাসিতে বলিলেন—
“ও দিয়ে আমরা কি করবো, জো! আমরা ত অর্থের কাঙ্গাল হ’য়ে এখানে আসি নাই। তোমার দুই পকেটে কত টাকারই সোণা ধরবে?”
“ভার ত আমাদের নিতেই হ’বে। বালির ভারের বদলে কিছু সোণাই নি না কেন?”
ফার্গুসন্ কহিলেন—
“হাঁ, তা’ নিতে পার। আগেই কিন্তু বলে রাখি, যখনই দরকার হবে, তখনই বিনা ওজরে ভার ফেলতে হ’বে।”
“এ সবই কি সোণা?”
“সবই সোণা। প্রকৃতিরাণী আফ্রিকার এই অতিনিভৃত অজ্ঞ।ত অনধিগম্য প্রদেশে তাঁর সঞ্চিত স্বর্ণরাশি লোকলোচনের অন্তরাল করে’ লুকিয়ে রেখেছেন। কালিডোনিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়ার সমস্ত সুবর্ণখনি একত্র করলেও এর তুলনা হয়
“হায় এত সোণা বৃথা নষ্ট হ’বে! কেউ এর কণামাত্রও পাবে না?”
“ভগবানের রাজ্যে এমন কত আছে, জো। যা’ হোক্, তোমার তুষ্টির জন্য আমি—”
বাধা দিয়া জো উচ্চৈঃস্বরে কহিল—“আমার তুষ্টি! কিছুতেই তা’ হবে না—হায় হায় এত সোণা!”
“আগে শোনই। এ স্থানটার ঠিক পরিচয় আমি লিখে নিচ্ছি। ইংলণ্ডে ফিরে গিয়ে তুমি এই স্বর্ণ-খনির কথা প্রচার করো। দেশের লোক যদি আবশ্যক মনে করে, অবাধে নিয়ে যেতে পারবে।”
“ভারের বদলে তবে সোণা তুলে নি। যাত্রা-শেষে যা’ অবশিষ্ট থাকবে, তাই নিয়েই তুষ্ট হ’বো।”
জো বিশেষ আগ্রহের সহিত বেলুনে সোণার ভার তুলিতে লাগিল।
ফার্গুসন্ মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন।
এক মণ, দুই মণ, তিন মণ! জো ক্রমেই ভার তুলিতে লাগিল এবং প্রায় দ্বাদশ মণ তুলিয়া ফেলিল। ফার্গুসন্ বাঙ্নিষ্পত্তি না করিয়া বেলুনে উঠিলেন। কেনেডি আপন স্থানে আসিয়া বসিলেন।
জো তখনো ভারই তুলিতেছিল!
ফার্গুসন্ গ্যাসে কিছুক্ষণ তাপ দিয়া জোকে ডাকিয়া কহিলেন—“বেলুন ত আর চলে না!”
জো উত্তর দিল না। তাহার দেহ মন সব এক হইয়া তখন স্বর্ণরাশিতে তন্ময় হইয়াছিল। ফার্গুসন্ আবার ডাকিলেন, “জো—”
একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেলুনে উঠিয়া জো কহিল, “আজ্ঞা করুন।”
“কিছু ভার ফেলে দাও।”
“আপনিই ত নিতে বল্লেন!”
“বলেছি বৈ কি! কিন্তু অত ভার নিলে কি বেলুন চলবে?”
“অত! অত কৈ?”
“তোমার কি ইচ্ছা যে, আমরা জীবনান্ত কাল পর্য্যন্ত আফ্রিকার এই পাষাণ-স্তূপের মধ্যে আবদ্ধ থাকি?”
জো কাতর দৃষ্টিতে কেনেডির দিকে চাহিল। সে দৃষ্টির অর্থ, উপস্থিত বিপদে সাহায্য-ভিক্ষা। কেনেডি নীরব রহিলেন।
ফার্গুসন্ আবার কহিলেন—
“জো, ক্রমেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জল ফুরিয়ে এসেছে। চারিদিকে প্রস্তর-প্রাচীর। কিছু তার ফেলে দাও—”
“হা—তা—দেখুন দেখি—বেলুনের কলটা খারাপ হয় নি ত?”
“কৈ না। দেখ না—কল ত চল্ছে—গ্যাসও উত্তপ্ত হয়েছে, বেলুন কত বড় হয়েছে!”
জো মাথা চুলকাইতে লাগিল এবং নিতান্ত অনিচ্ছা-সহকারে সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র এক খণ্ড স্বর্ণপ্রস্তর তুলিয়া লইয়া তাহার ওজন অনুমান করিল এবং বেলুন হইতে দূরে নিক্ষেপ করিল। বেলুন নড়িল না। জো কহিল—“নিশ্চয়ই কল খারাপ হয়েছে। এই ত ভার ফেলেছি। বেলুন নড়ে না কেন?”
“হয় নাই, জো—আরো ফেলে দাও।”
জো আরও পাঁচসের ফেলিয়া দিল। বেলুন তবুও নড়িল না! সাত সের—দশ সের—বিশ সের—! কি সর্ব্বনাশ! তবুও যে বেলুন নড়ে না!
ফার্গুসন্ বলিলেন—“আমরা তিন জনে প্রায় পাঁচ মণ। পাঁচ মণ ভার ত ফেল!”
“পাঁ-চ-ম-ণ!” জো বিবর্ণ হইয়া উঠিল।
নিরুপায় হইয়া আরও কিছু ভার ফেলিয়া কহিল —
“এই নিন, ঢের ফেলেছি। এই ত বেলুন উঠছে!”
“কৈ? যেমন ছিল তেমনি আছে।”
“এই ত নড়ছে—না? একটু নড়ছে বৈ কি!”
“ফেল—ফেল—আরও ভার ফেলে দাও।”
জো ফেলিতে লাগিল। সে যেন তাহার পঞ্জর চূর্ণ করিয়া নিক্ষেপ করিতেছিল। এতক্ষণে বেলুন নড়িয়া—প্রায় শত ফিট উপরেও উঠিল। ফার্গুসন্ কহিলেন—
“এখনো যে পরিমাণ ভার আছে জো, যদি আর ফেলতে না হয়—”
“সে কি! আরো ফেলবেন? তবে আমাকেই ফেলে দিন!”
ফার্গুসন্ ও কেনেডি জোর কথা শুনিয়া হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। জো আর কথা কহিল না। তাহার বুক ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল। সে নির্ব্বাক্ হইয়া সেই ভারের উপর শুইয়া পড়িল!
বেলুন ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল।