বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/বিংশ পরিচ্ছেদ

বিংশ পরিচ্ছেদ

বিরাট আত্মত্যাগ

 চ্যাড হ্রদের সমীপবর্ত্তী হইবার পর হইতেই ভিক্টোরিয়া পশ্চিম মুখে চালিত হইতেছিল। বেলা ১টার সময় অদূরে কৌফা নগর দেখা গেল। নগরের শ্বেতাভ মৃন্ময় প্রাচীর, মসজেদ এবং গৃহাদি দেখা যাইতে লাগিল। গৃহাঙ্গনে সুদীর্ঘ তরুগুলি ফলে পত্রে সুশোভিত হইয়া অতি সুন্দর দেখাইতেছিল।

 কৌফা নগর দুই ভাগে বিভক্ত। একাংশের গৃহগুলি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ও সুসজ্জিত। দেখিলেই মনে হয়, ধনীর আবাসগৃহ। অপরাংশের গৃহাদি ক্ষুদ্র এবং অপরিচ্ছন্ন। ফার্গুসন্ ভাবিয়াছিলেন, বেশ ভাল করিয়া নগরটা দেখিবেন। কিন্তু তাহা ঘটিল না। অকস্মাৎ একটা বিপরীতগামী বায়ু-প্রবাহ বেলুনকে স্পর্শ করিল। ফার্গুসন্ বেলুনের গতি রোধ করিতে পারিলেন না। উহা চ্যাড হ্রদের উপর দিয়া চলিতে লাগিল।

 হ্রদের মধ্যে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ ছিল। তাহাদের একটীতে জলদস্যুগণ বাস করিত। উহারা তীর ও ধনুক লইয়া বেলুন আক্রমণ করিল।

 বেলুন যেরূপ বেগে যাইতেছিল, তাহাতে দ্বীপপুঞ্জ অল্পকাল মধ্যেই দূরে পড়িয়া রহিল।

 জো তখন কেনেডিকে কহিতেছিল, “আপনার কত শীকার জুটেছে—ওই দেখুন।”

 “কি জো?”

 “দেখছেন না, কতকগুলো বৃহদাকার পক্ষী এই দিকেই উড়ে আসছে।”

 ফার্গুসন্ দূরবীক্ষণ লইয়া কহিলেন—“পক্ষী! কৈ দেখি।”

 কেনেডি বলিলেন—“আমি দেখেছি। প্রায় দশ বারটা হবে।”

 ফার্গুসন চিন্তিত হইয়া কহিলেন—“পাখীগুলো তফাতে গেলেই ভাল হ’তো, ডিক্। ও গুলো এক রকমের গিরবাজ! এক একটা মস্ত হয়। ওরা যদি দলবদ্ধ হ’য়ে বেলুন আক্রমণ করে—”

 বাধা দিয়া কেনেডি বলিলেন—“ভয় কি, ফার্গুসন্। আমাদের বন্দুক আছে—গুলি বারুদ আছে।”

 অল্পক্ষণ মধ্যেই পক্ষীগুলি নিকটে আসিল। উহাদের কর্কশ কণ্ঠ চতুর্দ্দিকে ধ্বনিত হইতে লাগিল। বেলুন দেখিয়া উহারা কিছু মাত্র ভীত হইল না, বরং কুপিত হইল।

 জো কহিল—“পাখীগুলো কি চীৎকারই কচ্ছে! ওদের রাজ্য আমরা দখল করে’ নিয়েছি বলে’ বুঝি বড় রেগেছে।”

 কেনেডি কহিলেন—“ওদের চেহারা ত বড় ভীষণ। দেখলেই ভয় হয়। ভাগ্যে ওদের বন্দুক নাই!”

 ফার্গুসন্ আরো চিন্তিত হইয়া কহিলেন—“ওদের বন্দুক লাগে না।”

 পক্ষীগুলি শূন্যে বৃত্তাকারে ভিক্টোরিয়ার চতুর্দ্দিকে ঘুরিতে লাগিল। বৃত্ত ক্রমেই ক্ষুদ্র হইতে লাগিল।

 ফার্গুসন আরো উপরে উঠিলেন।

 পক্ষীরাও ঊর্দ্ধে উঠিতে লাগিল।

 কেনেডি কহিলেন—“মারি।”

 “না না কেনেডি—মের না। তা’ হ’লে ওরা নিশ্চয়ই বেলুনের উপর পড়বে।”

 “তাতে ক্ষতি কি! আমার গুলির অভাব নাই। সব গুলো পাখীই মেরে দিচ্ছি। একটু দাঁড়াও না।”

 “ধৈর্য্য ধর, ডিক্। গুলি করার জন্য প্রস্তুত হ’য়ে থাক। আমি না বল্লে মের না।”

 পক্ষীগণ ততক্ষণ বেলুনের নিকটে আসিয়াছিল। উহাদের রঞ্জিত চূড়া, শ্বেত পক্ষ রৌদ্রে অতিশয় উজ্জ্বল দেখাইতেছিল। ফার্গুসন্ বলিলেন—“দেখছ না, ওরা অনুসরণ কচ্ছে।”

 কেনেডি হাসিয়া কহিলেন—

 “১৪ টা ত পাখী দেখছি। তুমি অত ভাবছ কেন, ভাই! ওদের যদি মারতে না পারি, তবে আমার শিকারী নাম বৃথা!”

 “তোমার সন্ধান যে অব্যর্থ তা’ জানি। মনে কর, ওরা যদি বেলুনের মাথা আক্রমণ করে, তুমি ত তা’ হ’লে দেখতেই পাবে না। মারবে কেমন করে? ধারালো ঠোট দিয়ে ওরা বেলুনের রেশমের আবরণটা ছিঁড়ে ফেলবে। ভাব দেখি একবার! আমরা যে ৮০০০ ফিট উপরে আছি ডিক্!”

 ঠিক সেই সময়ে একটা বাজ মুখ ব্যাদান করিয়া বেলুনের দিকে অগ্রসর হইল।

 ফার্গুসন্ হাঁকিলেন— “মার—”

 গুড়ুম্। কেনেডির বন্দুক ডাকিল। পরক্ষণেই একটী পক্ষী মরিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে পড়িতে লাগিল। জো বন্দুক তুলিয়া লইল।

 মুহূর্ত্তের জন্য পক্ষীগুলি ভীত হইল—মুহূর্ত্তের জন্য স্থির হইল। পরক্ষণেই বর্দ্ধিত বিক্রমে বেলুন আক্রমণ করিল।

 আবার কেনেডি একটী পক্ষী নিহত করিলেন। জো আর একটীর পক্ষ ভাঙ্গিয়া দিল।

 উহারা আক্রমণ-প্রণালী পরিবর্ত্তিত করিল এবং সকলে একসঙ্গে ভিক্টোরিয়ার উপর উড়িয়া উঠিল।

 কেনেডি ফার্গুসনের দিকে চাহিলেন। তাঁহার মুখ তখন বিবর্ণ হইয়া গেল।

 ফর্—ফর্—ফর্—! পর মুহূর্ত্তেই শব্দ হইল ফর্—ফর্— ফর্! কেনেডির মুখের কথা মুখেই রহিল। মনে হইল বেলুন চরণ-তলে নামিয়া পড়িতেছে।

 ফার্গুসন্ চীৎকার করিয়া উঠিলেন—

 “সর্ব্বনাশ হলো! রেশম ছিঁড়েছে! ভারা ফেল—ভারা ফেল!” মুহূর্ত্তে বেলুনের সমস্ত ভারা—জো’র বহু যত্নে সঞ্চিত স্বর্ণরাশি চ্যাড-হ্রদ মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইল।

 বেলুন নামিতেই লাগিল।

 জো জলের বাক্স ফেলিয়া দিল। বেলুন থামিল না। ফার্গুসন্ সেই বিপুলকায় হ্রদের দিকে চাহিলেন। মনে হইতে লাগিল যেন তাঁহাদিগকে গ্রাস করিবার জন্য চ্যাড হ্রদের বারি—রাশি প্রতিমুহূর্ত্তে উর্দ্ধে উঠিতেছে। তিনি ব্যস্ত হইয়া কহিলেন—

 “জো খাবারগুলো ফেল—তাড়াতাড়ি— তাড়াতাড়ি!”

 যে বাক্সে খাদ্য-সামগ্রী ছিল, তাহা পরমুহূর্ত্তেই হ্রদ মধ্যে নিক্ষিপ্ত হইল। বেলুনের পতন-বেগ কমিল বটে, কিন্তু থামিল না।

 ফার্গুসন্ হাঁকিলেন—“যা কিছু আছে, সব ফেলে দাও—সব ফেলে দাও!”

 কেনেডি ব্যাকুল হইয়া বলিলেন—“আর ত কিছু নাই!”

 জো গভীর কণ্ঠে কহিল—“নাই কেন? এখনো আছে—”

 পরমুহূর্ত্তেই সে বেলুন হইতে লম্ফ প্রদান করিল।

 ফার্গুসন্ ভীত কণ্ঠে ডাকিলেন—“জো—জো—”

 জো তখন ভীম বেগে হ্রদ মধ্যে পতিত হইতেছিল। বেলুন পলকে সহস্র ফিট উপরে উঠিয়া গেল। বেলুনের ছিন্ন প্রথম আবরণের মধ্যে বায়ু প্রবেশ করিয়া, উহাকে হ্রদের উত্তর তীরে লইয়া চলিল।

 একান্ত হতাশ হইয়া বাষ্পনিরুদ্ধ কণ্ঠে কেনেডি বলিলেন—

 “যাঃ—সব গেল!”

 “আমাদের বাঁচাবার জন্যই গেল!”

 উভয়ের চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। জো’কে একবার দেখিবার জন্য তাঁহারা বারংবার নিম্নে চাহিতে লাগিলেন।

 তাহাকে আর দেখা গেল না!