বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ডাক্তারের কৌশল

 জো যখন এইরূপে সরলচিত্ত নাবিকদিগের সহিত নানারূপ কাল্পনিক বিষয়ের আলোচনা করিতেছিল, ডাক্তার ফার্গুসন্ তখন জাহাজের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদিগের নিকট নিজ বেলুনের কল-কৌশল বর্ণনা করিতে করিতে কহিলেন—

 “আপন ইচ্ছামত যে বেলুনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, তা’ আমি বিশ্বাস করি না।”[]

 “বেলুন ত অনেকাংশে জাহাজেরই মত। জাহাজ ত যেদিকে সেদিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে— জলে তিল মাত্রও বাধা হয় না।”

  “মাপ করবেন কাপ্তান—ওইটা ভুল। জল এক জিনিষ, বাতাস আর এক জিনিষ। এ দু’য়ের ধর্ম্ম কি এক? বাতাস জলের চেয়ে সহস্রগুণ লঘু। জলের মধ্যে জাহাজখানার খুব বেশী হলেও ধরুন অর্দ্ধেকটা ডুবে থাকে, কিন্তু সম্পূর্ণ বেলুনটাই বাতাসের সমুদ্রের মধ্যে ডুবে আছে। বেলুনের উপরে নিম্নে দক্ষিণে বামে চারিদিকেই বায়ুস্তর। বাতাস যেন দশ হাতে বেলুনকে আলিঙ্গন করে’ ধরে’ রেখেছে। বেলুন তাই এক হাতও নড়তে পারে না। জলের স্রোত একদিকে চলে—বাতাস চলে নানাদিকে। ভূপৃষ্ঠেই পর্ব্বত গহ্বর প্রান্তর কন্দর-নির্ম্মক্ত মরুভূমি বা নিবিড় বনশ্রেণীর অবস্থান। বাতাসের স্রোত তাই শত স্থানে শত বাধা পেয়ে নানাদিকে ফিরে ঘুরে নানা পথে চলে। অন্তরীক্ষে এ সব উৎপাত নাই। অনন্ত উদার নীলাকাশ বাধাবন্ধহীন। তাই যতই উপরে যাওয়া যায় বায়ুপ্রবাহেও ততই একটা সমতা লক্ষিত হয়। উপরের বায়ুস্রোত কদাচিৎ দিক পরিবর্ত্তন করে। আকাশপথে কোন্ স্থানে বাতাসের গতি কিরূপ সেটা ঠিক করতে পারলেই আর চিন্তা নাই—বায়ুমণ্ডলের যে স্তরে আবশ্যক সেই স্তরে বেলুনকে ছেড়ে দিলেই হ’লো।”

 জাহাজের অধ্যক্ষ কহিলেন, “বাতাসের কোন্ বিশেষ স্তরটী আপনার চাই, সেটা খুঁজতে হ’লে আপনাকে ত অনেকবার উঠা-নামা করতে হ’বে। আর যতবার নামবেন ততবারই খানিকটা করে’ গ্যাস ছেড়ে দিতে হ’বে। আবার উপরে উঠতে হ’লে ভার ফেলে দিয়ে বেলুনকে হালকা করে’ নিতে হ’বে!”

 “এইবার আপনি আসল কথাটা ধরেছেন। বেলুনকে চালানো শক্ত নয়—কিন্তু গ্যাস রক্ষা করাই শক্ত।”

 “আজ পর্য্যন্তও এ সমস্যার মীমাংসা হয় নাই।”

 “হয়েছে বৈ কি!”

 “হয়েছে? কে করেছে?”  “আমি করেছি।”

 অধ্যক্ষ সবিস্ময়ে কহিলেন, “আপনি করেছেন?”

 “যদি না করতে পারতেম, তা’ হ’লে বেলুনে চড়ে’ আফ্রিকা অতিক্রম করতে সাহসী হতেম না।”

 “ইংলণ্ডে ত আপনি এ কথা প্রকাশ করেন নাই।”

 “না, তা করি নাই বটে। দশ জনে এ কথাটা নিয়ে-প্রচণ্ড উত্তাপ সৃষ্টি করার সাধারণ কৌশল মাত্র।”

 “এ পর্য্যন্ত বুঝলেম, তারপর?”

 “বেলুনের নীচের মুখ এমন করে’ বন্ধ করে দিয়েছি যে, বেলুনের মধ্যে এক বিন্দুও বাতাস যেতে পারবে না। বেলুনের মধ্যে দু’টো নল বসানো আছে। একটা নলের মুখ বেলুন-গর্ভের হাইড্রোজেনের উপরাংশের মধ্যে থাকবে, আর একটা নলের নিম্নাংশে। বেলুন যতই কেন না নড়ুক, গাটাপার্চ্চা দিয়ে যোড়া থাক্‌বে বলে কিছুতেই নলে আঘাত লাগবে না। এই দু’টো নল বরাবর বেলুন থেকে নেমে এসে বাহিরে একটা গোলাকার বাক্সর উপরকার ঢাকনার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। এটা হ’লো গ্যাসের উত্তাপ দিবার যন্ত্র। সেই গোল বাক্সটা বেশ শক্ত করে’ দোলনার সঙ্গে বাঁধা থাকবে।”

 “ঠিক বুঝতে পারছি না—গ্যাসে তাপ দিতে হ’বে কেমন করে’?”

 “বেলুনের উপরাংশ থেকে যে নল নেমে আসবে সেটা এই গোলাকার বাক্সের মধ্যে কুণ্ডলাকারে ঘুরতে ঘুরতে বাক্সের তলদেশে এসে উপস্থিত হ’বে। শেষে প্লাটিনাম ধাতুর আবরণের ভিতর দিয়া বাহিরে আসবে। এই নলের মধ্যে যে হাইড্রোজেন গ্যাস থাকবে, তা’তে উত্তাপ দিলেই, গ্যাস লঘু হয়ে’ উপরে উঠবে। গ্যাসের ধর্ম্ম এই যে, উত্তাপ দিলেই, গ্যাস লঘু হয় এবং বিস্তার লাভ করে। নলের মধ্যের গ্যাস লঘু হওয়া মাত্রই বেলুনের উপর দিকে উঠে যাবে, আর সঙ্গে সঙ্গে বেলুনের অপেক্ষাও শীতল, কাজেই ভারি, গ্যাস নিচে নেমে আসবে। মুখের কাছে এলেই তাপ লেগে উপরে উঠে যাবে। অমনি আবার শীতল গ্যাস নেমে আসবে।”

 “তারপর—তারপর? এখন দেখছি এটা কত সহজ!”

 “গ্যাসের ধর্ম্ম হচ্ছে এই যে, এক ডিগ্রী উত্তাপ পেলে  /৪৮০ গুণ বিস্তার লাভ করে। যদি আমি ১৮ ডিগ্রী তাপ দি, তা’ হ’লে বেলুনের গ্যাস  ১৮/৪৮০ গুণ বিস্তার লাভ করবে অর্থাৎ ১৬৭৪ ঘন ফিট বাড়বে। কাজেই বেলুনও ফুলে উঠে ততটা বাতাসের স্থান জুড়ে’ বসবে— সুতরাং উপরে উঠবে।”

 “আপনাকে সহস্র ধন্যবাদ—আপনি বুদ্ধিবলে একটা আলোচনা করে—”

 “সেটা আমার ইচ্ছা ছিল না। আমি অতি গোপনে এ সব পরীক্ষা করে’ দেখেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, আমি কৃতকার্য্য হ’তে পারবো।”

 শ্রোতৃমণ্ডলী বিশেষ উৎসুক হইয়া ডাক্তারের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তিনি ধীরভাবে বলিতে লাগিলেন—

 “অনেকদিন পর্য্যন্তই লোকে চেষ্টা করছে যে, কি করলে গ্যাস নষ্ট না করে’ ভার ফেলে না দিয়ে বেলুনকে ইচ্ছামত নামাতে কি তুলতে পারা যায়।”

 “এর আগেও তবে এ চেষ্টা হয়েছে?”

 “হাঁ হয়েছে বৈ কি! একজন ফরাসী এবং একজন বেলজিয়মবাসী চেষ্টা করে’ বিফল—মনোরথ হয়েছিলেন। আমি তাঁদের পথ ছেড়ে অন্য পথ ধরেছি। ভারের ব্যবহার আমি অনেকটা কমিয়ে দিয়েছি। সামান্য কিছু থাকবে বটে, কিন্তু বিশেষ আবশ্যক না হ’লে ফেলতে হবে না।”

 “এ বড় বিস্ময়কর আবিষ্কার।”

 “এতে কিছুমাত্র বিস্ময়ের কারণ নাই। বেলুনে যে গ্যাস থাকবে, যদি আমি ইচ্ছামত সেই গ্যাসকে সঙ্কুচিত কি বিস্তৃত করতে পারি তা’ হ’লেই হ’বে। গ্যাস যখন সঙ্কুচিত হ’বে, বেলুন তখন ভারি হয়ে উঠবে আর অমনি নামবে। আবার বিস্তৃত হ’লেই বেলুন উপরে উঠে যাবে।”

 “তাই ত—এর মধ্যে কঠিন ত কিছু দেখছি না। আচ্ছা, কি করে’ করবেন?”

 “আপনারা বোধ হয় দেখেছেন যে, আমার সঙ্গে পাঁচটা লোহার বাক্স আছে। তার একটাতে থাকবে জল। জলের মধ্যে বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালিয়ে দিলেই হাইড্রোজেন আর তাক্সিজেন (অম্লজান ও যবক্ষারযান) গ্যাস প্রস্তুত হবে। যাতে সমানে সমানে গ্যাস হয় সে জন্য জলের সঙ্গে খানিকটা সল্‌ফিউরিক য়্যাসিড মিশিয়ে দিব।”  “তার পর?”

 “প্রথম বাক্সে গ্যাস প্রস্তুত হ’বে আর নল দিয়ে দু’টো স্বতন্ত্র বাক্সে জমা হ’বে। এই তিনটা বাক্সের উপর আর একটা বাক্স থাকবে, সেখানে গ্যাস দু’টো ভিন্ন ভিন্ন নলের মুখে ফেলিয়ে দিয়ে মিশিয়ে নেবো।”

 “এটা আর কিছুই নয় অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন মিশিয়ে একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন।”

 “এতে যোগ্যতার কিছুই নাই। শীতের দিনে ইংলণ্ডের কক্ষগুলি যে উপায়ে গরম করা হয়, আমি সেই উপায় অৱলম্বন করেছি মাত্র। মনে করুন আমি যদি বেলুনের গ্যাসে ১৮০ ডিগ্রী উত্তাপ দিতে পারি, তা’ হ’লে গ্যাসের বিস্তার হ’বে  ১৮০/৪৮০ গুণ, সুতরাং সেই অতি বিস্তৃত গ্যাস বেলুনকে ফুলিয়ে তুলে’ ১৬৭৪০ ঘন ফুট বাতাসের স্থান অধিকার করবে। তার ফলে এই হ’বে যে, বেলুন থেকে ২০ মণ ভার ফেলে দিলে বেলুন যত দ্রুত উপরে উঠতো, তত দ্রুত উঠবে। আমার বেলুনে যে পরিমাণ গ্যাস ধরে, আমি তার অর্দ্ধেক সঙ্গে নিয়ে যাব। কাজেই বেলুন উপরে উঠতে পারবে না, শুধু বাতাসের মধ্যে ভেসে থাকবে। আমি যতই উত্তাপ দিব গ্যাসও ততই বিস্তৃত হ’বে, বেলুন ততই উপরে উঠবে। আবার যখনই নামতে ইচ্ছা হ’বে, তাপ কমিয়ে দিলেই গ্যাস শীতল হ’য়ে কুঞ্চিত হ’য়ে যাবে, বেলুনও নেমে পড়বে।”


  1. যখন এই গ্রন্থ রচিত হয় তখন এরোপ্লেনের জন্ম হয় নাই।