বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

মরুভূমে

 পরদিন ফার্গুসন্ বলিলেন, “আমরা বড়ই ধীরে যাচ্ছি। দশ দিনে মাত্র অর্দ্ধেক পথ এসেছি। কিন্তু এখন যে ভাবে যাচ্ছি, বাকি পথটা যেতে যে কতদিন লাগবে তা’ কে জানে। জল যে ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে, সেইটাই বড় চিন্তার কথা।”

 কেনেডি কহিলেন, “জলের ভাবনা কি। পথে যেতে এতদিন যেমন পেয়েছি, এখনো তেমনি পাব।”

 কেনেডির আশ্বাস-বাণীতে ফার্গুসনের চিন্তা দূর হইল না। তিনি দূরবীক্ষণ লইয়া সম্মুখে বিস্তৃত সেই জলহীন প্রদেশের অবস্থা নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। দেখিলেন, কোথাও নিম্ন ভূমির চিহ্ন পর্য্যন্ত নাই, বরং তাঁহার মনে হইতে লাগিল, দূরে মরুভূমি থাকিবারই কথা। নিকটে বা দূরে তিনি কোথাও গ্রামের চিহ্ন দেখিতে পাইলেন না। বোধ হইতে লাগিল, বৃক্ষ লতা প্রভৃতি ক্রমেই যেন বিরল হইতেছে। মধ্যে মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্ব্বত দৈত্যের ন্যায় দণ্ডায়মান রহিয়াছে। ক্বচিৎ দুই চারিটী বিশুষ্ক তরু বা কণ্টকময় গুল্ম মাত্র দেখা যাইতে লাগিল। ফার্গুসন্ ক্রমেই চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। দিন শেষে হিসাব করিয়া দেখিলেন, স্বর্ণক্ষেত্র হইতে মাত্র ৩০ মাইল পথ আসিয়াছেন, অথচ জল ফুরাইয়া ১৫ সেরে দাঁড়াইয়াছে। ফার্গুসন্ পাঁচ সের জল ভবিষ্যতের জন্য সাবধানে সরাইয়া রাখিলেন। কলের জন্য দশ সের থাকিল। দশ সের জলে ৪০০ ঘন ফুট গ্যাস হয়। প্রতি ঘণ্টায় ভিক্টোরিয়ার ৯ ঘন ফুট গ্যাসের প্রয়োজন। তিনি সঙ্গীদিগকে কহিলেন—

 “আর আমরা ৪৪ ঘণ্টা মাত্র যেতে পারি। রাত্রে যাওয়া হ’বে না। কোথায় যে খাল বিল নদী বা ঝরণা আছে, রাত্রে গেলে কিছুই দেখা যাবে না। জল চাই-ই চাই। এখন খুব কম জল খেয়ে কাটাতে হবে।”

 কেনেডি কহিলেন, “তার জন্য ভাবনা কি। খুব কমই খাওয়া যাবে। এখনো ত প্রায় তিন দিন যেতে পারবো। এর মধ্যে কি আর জলই মিলবে না।”

 রাত্রি নির্বিঘ্নে কাটিল। উজ্জ্বল নক্ষত্রখচিত অতি সুন্দর রজনী। ফার্গুসন্ চাহিয়া চাহিয়া সেই নক্ষত্ররাশি দেখিলেন। আকাশের অবস্থা দেখিয়া বুঝিলেন, বাতাসের বেগ বর্দ্ধিত হইবে না। তিনি বিচলিত হইলেন।

 প্রভাতে বেলুন ছাড়া হইল । ভিক্টোরিয়া অতি ধীরে অগ্রসর হইল। ক্রমেই সূর্য্যের উত্তাপ প্রখর হইতে প্রখরতর হইতে লাগিল। ফার্গুসন্ ইচ্ছা করিলে আরও উর্দ্ধে উঠিয়া শীতল স্থানে যাইতে পারিতেন, কিন্তু অনেকটা জল গ্যাস করিতে হইবে দেখিয়া সে সঙ্কল্প ত্যাগ করিলেন। দ্বিপ্রহরে দেখা গেল, ভিক্টোরিয়া মাত্র দ্বাদশ মাইল পথ আসিয়াছে। তিনি কহিলেন—

 “আমরা আর এর চেয়ে বেগে যেতে পারছি না। আগে বেলুন আমাদের দাস ছিল, এখন আমরাই বেলুনের দাস হ’য়ে পড়েছি!”

 কপালের ঘাম মুছিয়া জো কহিল, “উঃ কি গরম—”

 “এখন যদি আমাদের জল থাকতো, তা’ হ’লে সূর্য্যের উত্তাপেই হাইড্রোজেন গ্যাস বিস্তার লাভ করতো—কলে তাপ দিতেই হ’তো না। সে দিন পাদরীকে বাঁচাতে এক মণ দশ সের জল ফেলে দিতে হয়েছে! থাকলে এখন কত উপকার হতো।”

 “জলটা যে গেছে সে জন্য কি তোমার অনুতাপ হচ্ছে, ফার্গুসন্?”

 “অনুতাপ! না ডিক্‌, তা’ নয়। জল ফেলে দিয়ে যে আমরা পাদরীকে নিষ্ঠুর রাক্ষসদের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছিলেম, সেই জন্যই আনন্দ হচ্ছে।”

 ক্রমে ভূমি নিম্ন হইতে নিম্নতর বলিয়া প্রতীয়মান হইতে লাগিল। স্বর্ণপর্ব্বতরাশির পাদমূল ক্রমেই সরিয়া গেল এবং অপেক্ষাকৃত সমতল ক্ষেত্র দেখা দিল। কদাচিৎ দুই একটী অর্দ্ধশুষ্ক লতা বা রসহীন বৃক্ষ নয়নপথে পতিত হইতে লাগিল। ফার্গুসন্ বলিলেন—“আফ্রিকার নগ্ন মূর্ত্তি দেখ। আমি তোমাদের কাছে এই আফ্রিকার কথাই বলেছি।”

 “এ আর বেশী কি! উত্তাপ আর বালু—এ ত হ’বেই! যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। এতদিন বন-জঙ্গল মাঠ-ঘাট শস্যক্ষেত্র এই সব দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি ইংলণ্ডেই আছি। এতক্ষণে মনে হচ্ছে যে, আমরা আফ্রিকায় এসেছি।”

 সমস্ত দিবস অগ্নি বৃষ্টি করিয়া সূর্য অস্ত গেল। ফার্গুসন্ দেখিলেন তাঁহারা কুড়ি মাইলের অধিক আসিতে পারেন নাই।

 পরদিন আবার তপন উদিত হইল, আবার পূর্ববৎ অনলবৃষ্টি হইতে লাগিল। বাতাস পূর্ববৎই মন্দ বহিল। ফার্গুসন্ দূরবীক্ষণ লইয়া দেখিলেন সম্মুখে অনন্ত বিস্তৃত মরুভূমি! তপন কিরণে সমুজ্জ্বল ধূ ধূ বালুকারাশি জ্বলিতেছিল।

 তিনি একেবারে হতাশ হইলেন। ভাবিতে লাগিলেন, ‘কেনই বা কেনেডিকে আনিলাম, কেনই বা জোকে আসিতে দিলাম! আমিই এদের প্রাণনাশের কারণ হয়েছি!’ কখনো ভাবিলেন, ‘কেন এদেশে আসিলাম। যা’ কখনো সম্ভব নয়, কেনই বা তাই করতে প্রবৃত্ত হলেম! এখনো সময় আছে —ফিরে যাই। ফিরতে কি পারবো না? উপরে উঠলে বুঝি বেগশালী বায়ু-প্রবাহ পেতে পারি। কি করি? উপরে উঠবো জল যে ফুরিয়েছে——’  ফার্গুসনের চিত্ত এত অস্থির হইয়াছিল যে, তিনি মনের ভাব গোপন করিতে পারিলেন না। সঙ্গীদিগকে সকল অবস্থা জানাইলেন। জো কহিল, “ভৃত্য আমি। প্রভুর যা’ ইচ্ছা, আমারও তাই।”

 “কেনেডি, তোমার মত কি?”

 “ফার্গুসন্, তুমি ত জান হতাশ হ’বার লোক আমি নই। আমাদের যাত্রাপথ যে নিতান্ত বিপদসঙ্কুল তা’ আমি জানতেম। কিন্তু যখন দেখলেম যে, তুমি একা সেই বিপদের মধ্যে মাথা দিয়েছ, অমনি বিপদ্ তুচ্ছ জ্ঞান করে’ আমি তোমার সহযোগী হয়েছি। আমি ছায়ার মত তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবো। ধৈর্য্য ধর। এখন ফিরে যেতে হ'লেও আবার হয় ত এই সব বিপদেই পড়বো। আমি বলি চালাও—যা’ থাকে কপালে—চালাও।”

 “বন্ধুগণ, ধন্যবাদ! তোমরা যে আমাকে এত বিশ্বাস কর, তা’ আমি জানি।”

 তিন জনে তখন করমর্দ্দন করিলেন। ফার্গুসন্ বলিলেন— “শোন বলি। গিনি উপসাগর থেকে আমরা বোধ হয় তিনশ’ মাইলের অধিক দূরে নাই। সুতরাং এই যে মরুভূমি, এটা খুব বড় নয়। উপসাগরের তীরে অনেক দূর পর্য্যন্ত মনুষ্যের বসতি আছে বলে’ জানা গেছে। যদি দরকার হয়, আমরা সেই দিকে যাব। সে দিকেও কি একটু জল মিলবে না! কিন্তু ভাই, এখন বাতাসও যে নাই! বাতাসের অভাবেই যে বেলুন চলছে না।”

 “যদি না চলে, বাতাসের জন্য অপেক্ষা করাই মঙ্গল। যখন পাব তখন যাব।”

 তাহাই হইল। নির্বিঘ্নে নিস্তব্ধ রজনী কাটিয়া গেল। প্রভাতে ফার্গুসন্ দেখিলেন, তিন সের মাত্র জল আছে। তখন নির্মেঘ আকাশে মরুসূর্য্য তক্ তক্ করিতেছিল। ভিক্টোরিয়া ৫০০ ফিট উঠিল। কিন্তু নীচেও যেমন উপরেও তেমন—বাতাস ছিল না। ফার্গুসন্ একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন—

 “আমরা এখন মরুভূমির ঠিক মধ্যে। দেখ, বালুকারাশির কি বিপুল বিস্তার! কি বিস্ময়কর দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে, দেখ। প্রকৃতির কি আশ্চর্য্য লীলা! কে এর রহস্য ভেদ করতে পারে! আফ্রিকার এক দিকে কত নিবিড় বন, সরস প্রান্তর, বিপুলা তরঙ্গিণী, বিশাল হ্রদ—আর এদিকে যোজনের পর যোজন বিস্তৃত উত্তপ্ত বালুকারাশি! বৃক্ষ নাই, লতা নাই, গুল্ম নাই—সামান্য আশ্রয় পর্যন্ত নাই! শীতল বারির পরিবর্ত্তে এখানে জ্বালাময় অগ্নি ছুটছে। কেন এমন হয়েছে বলতে পার, কেনেডি?”

 “না ভাই, ও সব কেনর আমি ধার ধারি না। তবে অবস্থাটা যে, ওই রকমই’ তার জন্যই চিন্তা হয়েছে। দেখছ না, বেলুন ত দাঁড়িয়ে গেল!”

 এমন সময় জো বলিয়া উঠিল—“আমার যেন বোধ হচ্ছে, পূর্বের দিকে একটু মেঘ দেখা দিয়েছে।”  “হাঁ হাঁ ঠিক—জোর কথা ঠিক। ফার্গুসন্, দেখ—দেখ।”

 “এতক্ষণে তবে মেঘ দেখা দিয়েছে। একটু বৃষ্টি আর বাতাস—ব্যস্।”

 “দেখা যাক।”

 “আজ বুঝি শুক্রবার?”

 “কেন জো? তাতে কি?”

 “আমি শুক্রবারকে বড় ভয় করি। ওটা বড় অলক্ষণে বার।”

 “আজ তোমার সে ভুল ভাঙ্গবে, জো।”

 “হোক হোক—তাই হোক। এ গরম আর সহ্য হয় না।”

 ফার্গুসন্কে সম্বোধন করিয়া কেনেডি বলিলেন—

 “এত গরমে বেলুনের ত কিছু খারাপ হ’বে না?”

 “না, সে ভয় নাই। রেশমের উপর গাটাপার্চা দেওয়া আছে। খুব বেশী উত্তাপেও কিছু হবে না।”

 জো আনন্দে করতালি দিয়। কহিল—“ওই যে মেঘ—ওই যে মেঘ—আর ভয় নাই।”

 দুই বন্ধু চাহিয়া দেখিলেন, সত্যই বহুদূরে আকাশের প্রান্তদেশে একখণ্ড মেঘ দেখা যাইতেছে। উহা ধীরে ধীরে উপরে উঠিতেছিল। ফার্গুসন্ মেঘের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বেলা ১১টার সময় উহা সূর্য্যকে ঢাকিয়া ফেলিল; কিন্তু পরক্ষণেই দেখা গেল, মেঘের প্রান্তভাগ দিগ্বলয় ছাড়াইয়া উঠিয়াছে। ফার্গুসন্ গম্ভীরভাবে বলিলেন——  “ও মেঘের উপর কোনো আস্থা স্থাপন করা যায় না। সকালেও যেমন ছিল, এখনো তেমনিই আছে।”

 “তোমার কথাই ঠিক, ফার্গুসন্। আমাদের অদৃষ্টে বাতাসও নাই, বৃষ্টিও নাই।”

 “আমারও ত তাই বোধ হচ্ছে। মেঘখানা যত উপরে উঠছে—”

 বাধা দিয়া কেনেডি বলিলেন—

 “আচ্ছা, মেঘ যদি কাছে না আসে, আমরা ত মেঘের কাছে যেতে পারি।”

 “তা’তে বড় বেশী ফল হ’বে না। কেবল খানিকটা গ্যাস নষ্ট হ’বে। কিন্তু আমরা যেমন সঙ্কটে পড়েছি, তা’তে আর চুপ করে’ থাকা যায় না। চল উঠি।”

 বেলুন উর্দ্ধে উঠিতে লাগিল। ভূমিতল হইতে ১৫০০ ফিট ঊর্দ্ধে উঠিয়া ভিক্টোরিয়া সেই মেঘের ভিতরে প্রবেশ করিল। সেখানেও বাতাস ছিল না। সে মেঘেও বারি ছিল না। ফার্গুসন্ চিন্তান্বিত হইলেন।

 অকস্মাৎ জো চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল—

 “দেখুন—দেখুন—আমরাই যে শুধু এ দেশে এসেছি তা’ নয়। ওই দেখুন, আর একটা বেলুনেও মানুষ আছে।”

 কেনেডি বলিলেন—“জো পাগল হ’ল না কি?”

 জো আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিল—“ওই দেখুন—”  কেনেডিও জোর ন্যায় বিস্মিত হইয়া কহিলেন——“ফার্গুসন্, সত্যই ত—দেখ দেখ—”

 ফার্গুসন্ ধীরভাবে বলিলেন, “বুঝেছি। ওটা মায়া।”

 “মায়া! বল কি! ওই দেখ না, বেলুনে কয়েকজন যাত্রীও আছে। আমরাও যে দিকে যাচ্ছি ও বেলুনটাও সেই দিকেই যাচ্ছে।”

 ফার্গুসন্ বলিলেন—“ওদের নিশান দেখাও।”

 কেনেডি যখন পতাকা হস্তে সঙ্কেত করিলেন, তখন সে বেলুনের যাত্রীরাও পতাকা নাড়িল।

 ফার্গুসন্ বলিলেন, “কেমন ডিক্, এখন বিশ্বাস হয় যে ওটা মায়া। ও বেলুন তোমাদেরই ছায়া মাত্র।”

 জো বলিল, “এ কথা বিশ্বাস হয় না। আকাশের গায়ে বেলুনের ছবি। আকাশ ত আর দর্পণ নয়।”

 “আচ্ছা, তুমি হাত নেড়ে সঙ্কেত কর।”

 জো তাহাই করিল।

 “কি দেখলে?”

 “ও বেলুন থেকেও ঠিক আমারই মত হাত নাড়ছে। ওটা মায়াই বটে।”

 “তোমার চোখের ভুল মাত্র। মরুভূমিতে অমন হয়। বাতাস লঘু হ’লেই অমন দেখা যায়।”

 মরুভূমির মায়া-ছবি মুহূর্ত্তে অন্তর্হিত হইল। মেঘখণ্ড দেখিতে দেখিতে আরো উপরে উঠিয়া গেল। যতটুকু বাতাস ছিল, সেই সঙ্গে তাহাও গেল। ফার্গুসন্ অনন্যোপায় হইয়া নিম্নে নামিলেন।

 বেলুন অতি ধীরে অগ্রসর হইতেছিল। অপরাহ্ণে জো কহিল—“দূরে দু’টো তাল গাছ দেখা যাচ্ছে।”

 “যদি সত্যই গাছ হয়, তা’ হ’লে ওখানে নিশ্চয়ই জল আছে।” ফার্গুসন্ দূরবীক্ষণ দ্বারা দেখিলেন যে, সত্যই তাল বৃক্ষ দেখা যাইতেছে। তিনি হৃষ্টচিত্তে বলিলেন—“পেয়েছি—জল পেয়েছি। আর ভাবনা নাই।”

 জো তখন বলিল, “তবে একটু জল খেতে দিন। বড়ই গরম বোধ হচ্ছে। পিপাসায় কণ্ঠ শুকিয়েছে।”

 নিকটেই জল পাওয়া যাইবে দেখিয়া, ফার্গুসন্ জোকে জল পান করিতে দিলেন।

 ছয়টা বাজিল। ভিক্টোরিয়া তখন সেই পূর্বদৃষ্ট তাল বৃক্ষের সন্নিকটে আসিল। সে ত বৃক্ষ নয়—বৃক্ষের প্রেতছায়া! শুষ্ক শীর্ণ পত্র-বিরহিত! আসন্ন মৃত্যুর হস্ত হইতে যেন কোন প্রকারে আত্মরক্ষা করিতেছে। ফার্গুসন্ ভীত চিত্তে বৃক্ষের দিকে চাহিলেন। বৃক্ষনিম্নে একটা কূপের রৌদ্রদগ্ধ প্রস্তরখণ্ডগুলি পতিত ছিল। সেখানে জলের চিহ্নমাত্রও ছিল না। ফার্গুসন্ বন্ধুদিগকে সেই নিদারুণ সংবাদ শুনাইতে যাইতেছিলেন, কিন্তু তাঁহাদিগের চীৎকারে বিস্মিত হইয়া চাহিয়া দেখিলেন, যতদূর চক্ষু চলে মৃত মনুষ্যের কঙ্কাল সেই উত্তপ্ত অগ্নিতুল্য বালুরাশির উপর পতিত আছে। শুষ্ক কূপে চতুরদ্দিকে আরো কতকগুলি কঙ্কাল বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। কঙ্কালের সারি দেখিয়া ফার্গুসন্ মুহূর্ত্তে বুঝিলেন যে, পর্য্যটকগণ এই পথে আসিতে আসিতে দূরে কূপ দেখিয়া জলের আশায় শুষ্ক কণ্ঠে উহার দিকে ছুটিয়াছিল। যাহারা দুর্ব্বল তাহারা কূপ পর্য্যন্ত পৌঁছিতেও পারে নাই—পথিমধ্যেই পড়িয়া মরিয়াছে! সবল যাহারা তাহারা কূপের নিকট যাইয়াই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। তিন বন্ধু এই দৃশ্য দেখিয়া পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চাহিলেন। কেনেডি বলিলেন—

 “আর জলে কাজ নাই ফার্গুসন্, চল পালাই। এ দৃশ্য আর দেখা যায় না।”

 “না ডিক্, পালালে হ’বে না। জল আছে কি না দেখতেই হ’বে। কূপের তল পর্য্যন্ত পরীক্ষা না করে’ যাওয়া হ’বে না।”

 জো এবং কেনেডি বেলুন হইতে অবতরণ করিয়া এক দৌড়ে কূপের নিকটবর্ত্তী হইলেন। কূপের তলদেশেও বিন্দু মাত্র বারি ছিল না। তাঁহারা বালু সরাইতে লাগিলেন, কিন্তু জল মিলিল না। দারুণ শ্রমে ক্লান্ত হইয়াও তাঁহারা খনন করিতে বিরত হইলেন না। প্রবল বেগে স্বেদ ঝরিতে লাগিল—শরীর অবসন্ন হইয়া আসিল—চক্ষু অন্ধকার হইল—মস্তক ঘুরিতে লাগিল—জল মিলিল না।