বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

জল—জল—একটু জল

 পরদিন প্রভাতে ফার্গুসন্ যখন বেলুন ছাড়িলেন, তখন কহিলেন—“আর ছ’ঘণ্টা মাত্র যাওয়া যা’বে। যদি এর মধ্যে জল না পাই, তবে মৃত্যু নিশ্চিত।”

 ফার্গুসন‍্কে একান্ত চিন্তাক্লিষ্ট দেখিয়া জো কহিল—

 “যদিও এখন বাতাস তেমন নাই, কিন্তু হ’বে বলে’ বোধ হচ্ছে।”

 বৃথা আশা। বাতাস উঠিল না। তাম্বুর অভ্যন্তরস্থ তাপমান-যন্ত্রে দেখা গেল, উত্তাপ ১০৯ ডিগ্রী। জো এবং কেনেডি শয্যা গ্রহণ করিলেন।

 যতই বেলা বাড়িতে লাগিল, ততই তৃষ্ণা বৃদ্ধি হইতে আরম্ভ হইল। জলের পরিবর্ত্তে তাহারা ব্রাণ্ডি পান করিলেন। কিন্তু উহা অগ্নিতুল্য। তৃষ্ণা নিবারণ করিল না, বরং আরো বাড়াইয়া তুলিল। তখন এক সের মাত্র জল সম্বল ছিল। তাহাও অত্যন্ত উত্তপ্ত হইয়াছিল। প্রত্যেকেই সেই তপ্ত জলের দিকে সতৃষ্ণ নয়নে চাহিতে লাগিলেন, কিন্তু উহা স্পর্শ করিতে সাহসী হইলেন না। বিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে মাত্র এক সের জল। কে সাহস করিয়া তাহা পান করিয়া সম্বলহীন হইতে পারে।

 ফার্গুসন্ ভাবিতে লাগিলেন, বেলুনকে হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখতে যেয়ে খানিকটা জল কেন নষ্ট করলেম। জলটা গ্যাস না করে’ খাবার জন্য রাখলেই কি ভাল হ’তো না। মোটেই ত সর্ব্বশুদ্ধ ৬০ মাইল পথ এসেছি। যদি না আসতেম, তা’ হ’লেই বা কি হ’তো। সেখানেও জল ছিল না—এস্থানেও নাই। যদি বাতাস আসে, সেখানেও যেমন বয়ে’ যাবে, এখানেও ঠিক তেমনি যাবে। তবে কেন এলেম, কেন জল নষ্ট করলেম। আর এক সের জল থাকলে অন্ততঃ ৮।৯ দিন মরতে হ’তো না। ন’ দিনে কত কি ঘটতে পারে। পৃথিবী ওলোট-পালট হয়ে যেতে পারে। বেলুন নিয়ে উপরে উঠতেও জল লেগেছে। তখন ভার ফেলে দিয়েও ত উঠতে পারতেম। হায়, কেনই বা তা’ করলেম না! না হয় বেলুনের গ্যাস ছেড়ে দিয়ে নীচে নামা যেত।

 তা’ কি যেত? না—কখনো যেত না। গ্যাসই যে বেলুনের প্রাণ। সে প্রাণই যদি না থাকলো তবে আর বেলুন থেকে লাভ কি!

 ফার্গুসন্ এইরূপে চিন্তা করিতে লাগিলেন। কোন্ দিক্‌ দিয়া যে সময় কাটিয়া গেল, তাহা বুঝিতেই পারিলেন না।

 শেষে মনে মনে কহিলেন, ‘একবার শেষ চেষ্টা করে’ দেখতে হ’বে। আর একবার উপরে উঠে চেষ্টা করে’ দেখি, যদি বায়ুপ্রবাহ পাই। তার জন্য যথাসর্ব্বস্ব পণ করতে হ’বে!’

 জো এবং কেনেডি তখন ঝিমাইতেছিলেন। ফার্গুসন্ তাঁহাদিগকে কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না। ডাকিলেনও না। কলে উত্তাপ দিতে লাগিলেন। বেলুন উপরে উঠিল— আরো উপরে—আরো উপরে। কোথাও বাতাস ছিল না। কোথাও বায়ুপ্রবাহ মিলিল না! ফার্গুসন্ ৫ মাইল পর্য্যন্ত উপরে উঠিয়াও বেগশালী বায়ুপ্রবাহের সন্ধান পাইলেন না।

 জল ফুরাইল! মরুভূমে শেষ সম্বল এক সের জল— তাহাও ফুরাইল! গ্যাসের অভাবে কলের অগ্নি নির্বাপিত হইল। বৈদ্যুতিক যন্ত্র আর চলিল না। ভিক্টোরিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া পড়িতে লাগিল। অবশেষে যে স্থান হইতে উঠিয়াছিল, ঠিক সেই স্থানেই আসিয়া বালুরাশি স্পর্শ করিল।

 তখন মধ্যাহ্ন। ফার্গুসন্ হিসাব করিয়া দেখিলেন, চ্যাড-হ্রদ তথা হইতে ৫০০ মাইলের কম নহে। আফ্রিকার পশ্চিম তীরও তখন প্রায় ৪০০ মাইল ছিল। বেলুন ভূমি স্পর্শ করিবামাত্র জো এবং কেনেডির মোহ ভঙ্গ হইল। কেনেডি জিজ্ঞাসা করিলেন—“আমরা কি এখানেই থাকবো?”

 “না থেকে আর উপায় কি। কলের সব জলটুকু শেষ হয়েছে”

 তিন জনে বেলুন হইতে অবতরণ করিয়া আপন আপন ওজনের সমান বালুকা তুলিয়া বেলুন মধ্যে রাখিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাইতে লাগিল। কেহ কাহারও সহিত বাক্যালাপ করিলেন না। রাত্রে জো মাখন এবং বিস্কুট বাহির করিল। কেহ আহার করিলেন না। মাত্র এক গণ্ডুষ করিয়া উষ্ণ বারি পান করিয়া নৈশ ভোজন শেষ করিলেন!

 সমস্ত রজনী কাহারো নিদ্রা হইল না। এতই গরম বোধ হইতেছিল যে, এক একবার নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল পরদিন প্রভাতে দেখা গেল পান করিবার জন্য আর অর্দ্ধ সের মাত্র জল আছে। ফার্গুসন্ উহা একপার্শ্বে সরাইয়া রাখিলেন তিন জনেই স্থির করিলেন যে, শেষ সময় ভিন্ন উহা পান করিবেন না।

 অল্পক্ষণ পরেই জো কহিল, “বাপরে! ১২০ ডিগ্রী উত্তাপ! আমার দম বন্ধ হচ্ছে। গা জ্বলে’ যাচ্ছে।”

 কেনেডি বলিলেন, “বালু এত তেতেছে, যেন আগুনে ভাজা! আকাশে বিন্দুমাত্রও মেঘ নাই। এমন অবস্থায় পড়লে মানুষ মূহূর্ত্তে পাগল হয়।”

 বন্ধুদিগকে সাহস দিয়া ডাক্তার কহিলেন—“হতাশ হ’য়ো না। মরুভূমে খুব বেশী গরম হ’লে তার পর নিশ্চয়ই ঝড় বৃষ্টি হয়।”

 “তার ত কোন লক্ষণ দেখি না, ফার্গুসন্।”

 “এখন তেমন কিছু নাই বটে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বায়ুমান যন্ত্রের পারা যেন নিম্নগামী হ’বার মত হয়েছে।”

 “ও তোমার ভ্রম, ফার্গুসন্।”

 “না ডিক্। সাহস কর। ধৈর্য্য ধর।”

 কেনেডি যতই সেই মেঘশূন্য পরিচ্ছন্ন উজ্জ্বল আকাশ ও দিগন্তবিস্তারি উত্তপ্ত বালুকারাশির দিকে চাহিতেছিলেন, ততই শঙ্কিত হইতেছিলেন। তাঁহারা ক্রমে বিকারগ্রস্ত হইতে লাগিলেন।

 রাত্রি আসিল। ফার্গুসন ভাবিলেন দ্রুতপদে ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিলে হয় ত কষ্টের অনেকটা লাঘব হইবে। তিনি সঙ্গীদিগকে ডাকিলেন।

 কেনেডি বলিলেন,

 “আমি এক পা-ও চলতে পারি না।”

 জো কহিল, “আমার ঘুম পাচ্ছে।”

 ফার্গুসন্ পুনরায় কহিলেন, “এ অবসাদ দূর করতেই হ’বে। ঘুমিয়ে পড়লে বড় খারাপ হ’বে। এস বেড়াই।”

 তাঁহারা ভ্রমণ করিতে চাহিলেন না। ফার্গুসন্ একাকী যাত্রা করিলেন। ঊর্দ্ধে নক্ষত্রখচিত আকাশ, নিম্নে সুদূরবিস্তৃত মরুভূমি। পশু নাই—পক্ষী নাই—জন-প্রাণীর সাড়া শব্দ নাই! চতুর্দ্দিকে ভীষণ নীরবতা। ফার্গুসন একাকী যাত্রা করিলেন। প্রথমে হাটিতে পারিলেন না—চরণ চলিতে চাহিল না। কিছুক্ষণ পাদচারণ করিতে করিতেই লুপ্তশক্তি যেন অল্পে অল্পে ফিরিয়া আসিতে লাগিল। তিনি বহুদূর পর্য্যন্ত গমন করিলেন। কতদূর গেলেন, তাহা বুঝিতে পারিলেন না। চলিতে চলিতে অকস্মাৎ মস্তক ঘুরিয়া উঠিল—চক্ষু অন্ধকার হইল—শরীর অবসন্ন হইয়া গেল। চরণদ্বয় কম্পিত হইতে লাগিল। সেই ভীষণ নীরবতা যেন তাঁহাকে একান্ত ভীত করিয়া তুলিল। পশ্চাতে ফিরিয়া দেখিলেন ভিক্টোরিয়ার আর চিহ্ন পর্যন্ত দেখা যাইতেছে না। ফার্গুসন্ প্রত্যাবর্তন করিবার চেষ্টা করিলেন, পারিলেন না। বন্ধুদিগকে উচ্চকণ্ঠে ডাকিলেন। কাহারো উত্তর পাইলেন না। প্রতিধ্বনি পর্য্যন্ত হইল না। ফার্গুসন্ তখন সেই তপ্ত বালুকারাশির মধ্যে মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন।

 তাঁহার যখন মূর্চ্ছা ভঙ্গ হইল, তখন রজনী দ্বিতীয় প্রহর। ফার্গুসন্ চক্ষু চাহিয়া দেখিলেন, তিনি ভূশয্যায় পতিত রহিয়াছেন। জো ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিয়া আছে।

 জো কহিল, “আপনার কি হয়েছে?”

 “কিছু নয় জো। অকস্মাৎ বলশূন্য হয়েছিলাম।”

 “আমার কাঁধের উপর ভর করে’ চলুন। ভিক্টোরিয়ায় ফিরে যাই।”

 ফার্গুসন্ তাহাই করিলেন।

 যাইতে যাইতে জো কহিল—“এমন করে কি একাকী আসতে আছে। এ ভাবে আর ক’দিন কাটবে? যদি বাতাস না উঠে, তবে ত আমরা তিন জনে একত্রে মারা যাব।”

 ফার্গুসন নীরব রহিলেন। জো কহিল—

 “আপনাদের মঙ্গলের জন্য আমি জীবন পণ করেছি। দু’জনের জন্য এক জনের আত্ম-বিসর্জ্জন করাই উচিত। আমি তাই করবো।”

 “তাতে কি হ’বে জো? প্রাণ দিলে কি বাতাস এনে দিতে পরবে?”

 “কিছু খাবার নিয়ে আমি পদব্রজে যাত্রা করতে চাই। হয় ত কোথাও একটা আশ্রয় খুঁজে পেতে পারি। কোন একটা  গ্রাম পেলে মনের কথা গ্রামবাসীদের এক রকম করে’ বুঝিয়ে দিতেই পারবো। আমি সেখান থেকে আপনাদের জন্য জল আনবো। যদি এর মধ্যে বাতাস উঠে, আমার জন্য আপনারা তাপেক্ষা করবেন না।”

 “এ অসম্ভব, জো। তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না।”

 “একটা ত উপায় করতে হবে। আমি গেলে ক্ষতি কি?”

 “না জো, তা’ হ’বে না। এ বিপদের সময় আমরা এক, সঙ্গেই থাকবো। যদি মরতে হয়, একত্রেই মরবো। ধৈর্য্য ধরে’ অপেক্ষা করা ভিন্ন আর উপায় কি?”

 “বেশ—আমি আর একদিনমাত্র দেখবো। যদি মঙ্গলবারেও বাতাস না উঠে আমি পদব্রজে যাত্রা করবো। কোন বাধাই মানবো না।”

 কথা কহিতে কহিতে উভয়ে বেলুনের নিকটে আসিলেন। রাত্রি একরূপে কাটিয়া গেল।

 প্রভাত হইতেই ফার্গুসন্ বায়ুমান-যন্ত্র পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। কোনো পরিবর্ত্তন লক্ষিত হইল না। তিনি তখন নিম্নে অবতরণ করিয়া ভাল করিয়া আকাশের অবস্থা পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন। দেখিলেন, সূর্য্য তেমনি প্রখর —বালুকারাশি তেমনি তপ্ত—আকাশ তেমনি পরিচ্ছন্ন। তিনি আপন মনে বলিলেন, “তবে কি আমাদের শেষ সময়, সত্যই এসেছে!”

 জো কোন কথা কহিল না। নীরবে বসিয়া তাহার যাত্রার কথা ভাবিতে লাগিল। কেনেডি অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। পিপাসায় তাঁহার কণ্ঠ জিহ্বা তালু সমস্তই শুষ্ক হইয়াছিল। সেই শুষ্ক কণ্ঠে ও জিহ্বায় এমন ক্ষত হইয়াছিল যে, কথা কহিবার শক্তিও তাঁহার ছিল না। বেলুনে যে, তখনো একটু জল ছিল, তাহা তিন জনেই জানিতেন। সেই কয়েক বিন্দু বারি নিঃশেষে পান করিয়া অন্ততঃ মুহূর্ত্তের জন্য কষ্টের লাঘব করিতে তিন জনেরই ইচ্ছা হইতেছিল। পরস্পর পরস্পরের দিকে তীব্র দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। একটা পাশবিক ভাব মধ্যে মধ্যে তাঁহাদিগকে উত্তেজিত করিতে লাগিল।

 কেনেডি আহত সিংহের ন্যায় হইলেন। তিনি সমস্ত দিন ধরিয়া প্রলাপ বকিলেন। জল—জল—একটু জল। কণ্ঠ পুড়িয়া গেল—বক্ষ ফাটিয়া গেল—এক বিন্দু জল। কেনেডি এক স্থানে স্থির থাকিতে পারিলেন না। কখনো সেই অগ্নিতুল্য বালুরাশির মধ্যে অবতরণ করিতে লাগিলেন, কখনো বেলুনে উঠিতে লাগিলেন। যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া নিজের অঙ্গুলি দংশন করিলেন! নিকটে ছুরি থাকিলে—তিনি হয়ত শিরা কাটিয়া আপন রুধির পান করিতেন!

 কেনেডি অল্পকাল মধ্যেই দুর্ব্বল অবসন্ন দেহে শয্যা লইলেন এবং অপরাহ্ণেই উন্মত্তবৎ হইয়া উঠিলেন। জো-ও সেই সময় বুদ্ধি হারাইল! বিকারের ঘোরে সে দেখিল সম্মুখেই দিগন্তবিস্তৃত শীতল সলিল রৌদ্রকিরণে ঝকমক করিতেছে। জে কাল বিলম্ব না করিয়া উহা পান করিবার জন্য বেলুন হইতে ঝম্প দান করিল এবং পরক্ষণেই রৌদ্রতপ্ত বালুরাশি কর্তৃক দগ্ধ হইয়া যন্ত্রণায় ছটফট করিতে করিতে বেলুনমধ্যে পলায়ন করিল। আবার সেই ভ্রম—আবার জো সলিল বলিয়া বালুকার মধ্যে মুখ গুঁজিল! পরক্ষণেই বিরক্ত হইয়া কহিল— “এ জল কে খাবে——বড় লোণা।”

 ফার্গুসন্ এবং কেনেডি তখন মৃতবৎ পড়িয়াছিলেন। জো আর পারিল না। কোনক্রমে জানুতে ভর করিয়া নিজের শক্তিহীন দেহকে টানিয়া লইয়া বেলুনে উঠিল এবং ক্ষিপ্র হস্তে জলের বোতলটী লইয়া পান করিতে আরম্ভ করিল। কেনেডি ইহা দেখিতে পাইয়াছিলেন। তিনিও কোন প্রকারে জোর নকটে উপস্থিত হইয়া ভীষণ কণ্ঠে কহিলেন—

 “দাও—দাও—আমাকে দাও।”

 জো তখন বিশ্ব-সংসার বিস্মৃত হইয়া জলপান করিতেছিল। কেনেডি পুনরায় কহিলেন—

 “জো, তোমার চরণে ধরি—মিনতি—করি—একটু দাও। বেশী নয় এতটুকু জল। দাও জো দাও—প্রাণ যায়—রক্ষা কর—”

 জো কাঁদিতে কাঁদিতে জলের বোতলটী—তাহার শেষ আশা, শেষ সম্বল কেনেডির হস্তে অর্পণ করিল।