বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ/সপ্তম পরিচ্ছেদ
যাত্রা
রেজলিউট জাহাজ জান্জিবারের বন্দরে আসিয়া নোঙ্গর করিল। হস্তিদন্ত, গোয়ানো, গাম্ প্রভৃতি দ্রব্যের বাণিজ্যের জন্য জান্জিবার প্রাচ্য ভূখণ্ডে পরিচিত। আফ্রিকার আন্তর্জ্জাতিক সমরে যে সকল লোক বন্দীকৃত হয়, তাহারা জান্জিবারের বিপণিতে কৃতদাসরূপে বিক্রীত হইয়া থাকে।
জান্জিবারের ইংরাজ কন্সাল সসম্ভ্রমে বেলুনযাত্রীদিগকে স্বগৃহে অতিথি হইবার নিমিত্ত নিমন্ত্রণ করিলেন। তাঁহাদিগের জিনিষপত্র ধীরে ধীরে নামানো হইতে লাগিল। এদিকে গৃহে গৃহে প্রচারিত হইযা গেল যে, একজন খ্রীষ্টান আসিয়া শূন্যে উড়িতে চাহিতেছে। শুনিবামাত্র দ্বীপবাসিগণ চঞ্চল হইয়া উঠিল। তাহারা মনে করিল এই নবাগত খ্রীষ্টান নিশ্চয়ই চন্দ্র এবং সূর্য্য দেবতার অকল্যাণ করিবার জন্যই আকাশ-ভ্রমণে যাইতেছে। তাহাদিগের অন্ধ ধর্ম্ম-বিশ্বাসে আঘাত লাগিল, কারণ সূর্য্য এবং চন্দ্রই তাহাদিগের উপাস্য দেবতা। কাফ্রিরা স্থির করিল যেরূপেই হউক বাধা দিবে এবং বলপ্রয়োগে এই অভিযান বন্ধ করিবে। ইংরাজ কন্সাল চিন্তিত হইলেন। জাহাজের অধ্যক্ষ কহিলেন “কিছুতেই আমরা স্থান ত্যাগ করবো না, কাফ্রির এতদূর ধৃষ্টতা! দেখা যা’ক: কি হয়। আবশ্যক হ’লে আমরা লড়াই করবো।”
ডাক্তার বলিলেন, “যুদ্ধ করলে যে আমাদেরই জয় হ’বে তা’তে আর সন্দেহ কি? কিন্তু হঠাৎ যদি বেলুনটা আক্রান্ত হয় তা’ হ’লেই ত সবর্বনাশ ঘটবে। এতদূর এসেও আফ্রিকা-দর্শন ঘটবে না!”
কিছুক্ষণ বাদানুবাদের পর স্থির হইল যে, পূরোবর্ত্তী দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে কোন একটাতে বেলুন নামাইয়া পাহারা দিতে হইবে। জাহাজের অধ্যক্ষ নোঙ্গর তুলিয়া যে দ্বীপাভিমুখে যাত্রা করিলেন তাহার নাম কুম্বেনী। ফার্গুসন্ অতি সতর্কতার সহিত বেলুনটি নামাইয়া উহাতে গ্যাস পূর্ণ করিবার ব্যবস্থা করিলেন।
কাফ্রিগণ দূর হইতে চীৎকার করিতে লাগিল, কেহ বা অঙ্গভঙ্গী করিতে লাগিল। কেহ কেহ মন্ত্র পাঠ করিয়া বজ্রকে আহ্বান করিল। কাফ্রি যাদুকরগণ কত রকম কলকৌশল যে অবলম্বন করিল, তাহার ইয়ত্তা নাই; কিন্তু তাহাতেও যখন বেলুনের কোনো অনিষ্ট ঘটিল না, বরং উহা গ্যাসে পূর্ণ হইয়া ধীরে ধীরে দুলিতে লাগিল, তখন তাহারা আরও উত্তেজিত হইয়া উঠিল ।
বিদায়ের সময় ক্রমেই নিকট হইতেছিল। সকলেই হৃদয় মধ্যে বেদনা বোধ করিতে লাগিলেন। সকলেই ভাবিলেন অসভ্য বর্ব্বর জাতিতে পরিপূর্ণ অজ্ঞাত দেশে এই দুঃসাহসিক পর্য্যটকদিগের অদৃষ্টে না জানি কত বিপদ্ই লিখিত রহিয়াছে। যদি বেলুন না চলে, তাহাদের হস্তে নিপতিত হইলে না জানি কি দর্দশাই ঘটিবে। ডাক্তার ফার্গুসনের ললাটে চিন্তার রেখা পর্য্যন্ত ছিল না। তিনি নিশ্চিন্ত চিত্তে নানা বিস্ময়কর কাহিনী বর্ণনা করিয়া বন্ধুদিগকে প্রফুল্ল করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সবই বৃথা হইল—সান্ধ্য বিদায়ভোজের আনন্দ কেহই অনুভব করিতে পারিলেন না।
পরদিন প্রভাতে যখন তাঁহারা জাহাজ হইতে কুম্বেনী দ্বীপে অবতরণ করিলেন, তখন মন্দপবনে দুলিয়া দুলিয়া বেলুন বায়ুমধ্যে ভাসিতেছিল। নাবিকগণ বেলুনের বন্ধন-রজ্জু ধরিয়া টানিয়া রাখিয়াছিল। যাত্রার কাল আগত হইল। কেনেডি তখন অগ্রসর হইয়া বন্ধু ফার্গুসনের করমর্দন পূর্বক কহিলেন—
“ভাই তবে তুমি নিশ্চয়ই যাবে।”
“এখনো কি সন্দেহ আছে ডিক্? আমি নিশ্চয়ই যাব।”
“তোমাকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে আমার যতদূর সাধ্য তা’ করেছি।”
“করেছ বৈ কি।”
“তবে আর আমার দোষ নাই। হয়েছে। আমার মন এখন স্থির হয়েছে। চল আমিও তোমার সঙ্গেই যাব।”
ফার্গুসনে্র মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তিনি হর্ষোৎফুল্ল হইয়া কহিলেন, “আমি আগেই জানতেম যে তুমি যাবে।” বিদায়ের শেষ মুহূর্ত্ত আসিয়া উপস্থিত হইল। জাহাজের অধ্যক্ষ এবং নাবিকগণ সস্নেহে কর মর্দ্দন করিয়া বিদায় লইলেন। যাত্রিগণ বেলুনে আরোহণ করিলেন। ফার্গুসন্ অবিলম্বে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিয়া গ্যাসে উত্তাপ দিতে লাগিলেন। বেলুন ক্রমেই ফুলিয়া উঠিতে লাগিল—ক্রমেই দুলিতে লাগিল—শেষে ধীরে ধীরে ঊর্দ্ধে উঠিতে লাগিল। ফার্গুসন্ তখন সহযাত্রীদিগের মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান হইয়া টুপী খুলিয়া কহিলেন—
“বন্ধুগণ, আমাদের এই ব্যোমযানকে একটী মাঙ্গলিক আখ্যায় অভিহিত করা যাক। আসুন আমরা এর নামকরণ করি। আজ থেকে এই বেলুনের নাম ভিক্টোরিয়া।”
সমেবত জননণ্ডলী উল্লাসে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। নাবিকগণ তখনো রজ্জু ধরিয়া বেলুনকে টানিয়া রাখিয়াছিল, কিন্তু আর পারিতেছিল না। ফার্গুসন্, কেনেডি এবং জো শূন্য হইতেই পুনরায় সকলের নিকট বিদায় লইলেন। গ্যাস ক্রমেই বেলুন মধ্যে বিস্তার করিতেছিল। ফার্গুসন চীৎকার করিয়া কহিলেন—
“ছাড়ুন—ছাড়ুন—দড়ি ছাড়ুন—হুসিয়ার।”
নাবিকগণ বন্ধনরজ্জু ছাড়িয়া দিল। মুহূর্ত্তমধ্যে ভিক্টোরিয়া শূন্যপথে যাত্রা করিল। রেজলিউট জাহাজ হইতে তৎক্ষণাৎ চারিবার কামান নিনাদিত হইয়া যাত্রীদিগকে শেষবার অভিনন্দিত করিল। বেলুন ক্রমেই উপরে উঠিতে লাগিল। উপরের বাতাস শীতল ও আকাশ পরিচ্ছন্ন ছিল। বেলুন ১৫০০ ফিট উর্দ্ধে উত্থিত হইয়া দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ধাবিত হইল । তখন পদনিম্নে জান্জিবার দ্বীপ একটী মসিবর্ণ বিপুল প্রান্তরের ন্যায় দেখা যাইতেছিল। কর্ষিত শস্যহীন ও কোন স্থানে শস্যসমাচ্ছন্ন বিস্তৃত ভূমি সেই মসিবর্ণ প্রান্তর মধ্যে বর্ণবৈচিত্র্য ঘটাইতেছিল। জান্জিবারের অধিবাসিগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পিপীলিকাবৎ দৃষ্ট হইতে লাগিল। নাবিকদিগের জয়োল্লাসধ্বনি ক্রমেই অনন্তশূন্যে মিলাইতে লাগিল। কেবল রেজলিউট জাহাজের কামান-গর্জ্জনের প্রতিধ্বনি তখনো অস্পষ্টভাবে কর্ণে আসিয়া পৌঁছিতেছিল। জো পুলকিত হইয়া কহিল—
“আহা, কি সুন্দর!”
ভিক্টোরিয়া ২৫০০ ফিট উর্দ্ধে উঠিল। রেজলিউট অর্ণবপোত তখন একখানি ক্ষুদ্র ধীবরতরণীর ন্যায় দৃষ্ট হইতে লাগিল। সাগরবিধৌত আফ্রিকার পশ্চিম তীর শুধু ফেনপুঞ্জ বলিয়া মনে হইতে লাগিল। ভিক্টোরিয়া তখন ঘণ্টায় ৮ মাইল বেগে সমুদ্র অতিক্রম করিতেছিল। উহা দুই ঘণ্টার মধ্যে আফ্রিকার নিকটবর্ত্তী হইল। ফার্গুসন্ গ্যাসের উত্তাপ হ্রাস করিলেন। দেখিতে দেখিতে ভিক্টোরিয়া অনেক নিম্নে নামিয়া পড়িল। অদূরে ঘনসন্নিবিষ্ট বনশ্রেণী তখন বেশ সুস্পষ্টরূপে নয়নগোচর হইতেছিল । তাঁহারা ফাগুলি গ্রামের উপর আসিলেন । গ্রামবাসীরা দেখিল কি যেন একটা অদ্ভুত পদার্থ রাক্ষসের মত আকাশপথে বিচরণ করিতেছে। তাহারা প্রথমে ভয়ে এবং শেষে ক্রোধে চীৎকার করিতে লাগিল। তাহাদিগের সুদৃঢ় কার্ম্মুক হইতে মুহুর্মুহুঃ বিষবাণ নিক্ষিপ্ত হইয়া আকাশ ছাইয়া ফেলিল। কিন্তু ভিক্টোরিয়া অনেক উপর দিয়া যাইতেছিল বলিয়া কাফ্রির শর বৃথা গেল। ডাক্তার ইহাদিগের জন্য তিলমাত্র চিন্তিত হইলেন না। পর্যটক বার্টন্ এবং স্পিকের যাত্রাপথ অনুসরণ করিয়া অগ্রসর হইতে পারিতেছেন বলিয়া তিনি প্রফুল্ল হইলেন।
কেনেডি পুলকিত হইয়া কহিলেন, “কি সুন্দর যান! এর কাছে ঘোড়ার গাড়ী!”
জো কহিল, “ঘোড়ার গাড়ী ত দূরের কথা— ষ্টীমারেও কি কখনো এত আনন্দ হয়?”
ডাক্তার বলিলেন, “আমি ত রেল অপেক্ষা বেলুনে যেতেই বেশী পছন্দ করি। রেল হু হু করে’ চলে’ যায়—যে দেশের ভিতর দিয়ে যায় তা’র কিছুই দেখা ঘটে না।”
জো অল্পকাল মধ্যেই কিছু আহার্য্য প্রস্তুত করিল। তিনজনে সেই মহাশূন্যে আনন্দে আহার করিতে করিতে অগ্রসর হইলেন। ক্রমেই তাঁহারা উর্বর ভূমির উপর দিয়া যাইতে লাগিলেন। দেখিলেন নিম্নে শীর্ণকায় দীর্ঘ পথ আঁকিয়া বাঁকিয়া বিস্তৃত রহিয়াছে। অদূরে তামাক, ভূট্টা, ছোলা প্রভৃতির ক্ষেত্র ফলে পত্রে সুশোভিত হইয়া রহিয়াছে। স্থানে স্থানে সুবিস্তৃত ধান্যক্ষেত্র নয়নের তৃপ্তি সাধন করিতেছে। ধান্যক্ষেত্র সমুদ্রের ন্যায় বিস্তৃত—পবন-স্পর্শে ধান্যশীর্ষ দুলিতেছে—ধান্যক্ষেত্র তরঙ্গায়িত হইতেছে। তাঁহারা যখনই কোন গ্রামের উপর দিয়া যাইতে লাগিলেন, তখনই গ্রামবাসীরা দৈত্য মনে করিয়া তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিতে লাগিল। তাহাদিগের বিকট চীৎকারে অন্তরীক্ষ পর্য্যন্ত আলোড়িত হইতে লাগিল। ফার্গুসন্ বেলুনটীকে অপেক্ষাকৃত উচ্চে রক্ষা করিলেন। শত্রুর গুণমুক্ত তীর বেলুন স্পর্শ করিতে পারিল না।
বেলা দ্বিপ্রহর হইল। সূর্যকিরণ প্রখর বলিয়া অনুভূত হইতে লাগিল। নির্ম্মল আকাশতলে ভিক্টোরিয়া নির্বিঘ্নে ভাসিয়া যাইতে লাগিল। তাঁহারা আউজ্রামো প্রদেশ অতিক্রম করিলেন।
ডাক্তার কহিলেন, “দেখ দেশের মূর্ত্তি কেমন পরিবর্ত্তিত হ’য়ে যাচ্ছে। এখন আর অত ঘন ঘন গ্রাম দেখা যাচ্ছে না, আম্রবণও আর চোখে পড়ছে না। এই খানেই বোধ হয় আফ্রিকার অরণ্যের শেষ। ভূপৃষ্ঠ ক্রমেই কঙ্করময় প্রস্তরবহুল বলে’ বোধ হচ্ছে। বোধ হয় নিকটেই কোথাও শৈলমালা আছে।”
চারিদিক ভাল করিয়া দেখিয়া কেনেডি কহিলেন “আমার বোধ হচ্ছে পশ্চিম দিকের ওই মেঘমালা আর কিছুই নয়, উন্নত শৈলশ্রেণী।”
'ফার্গুসন্ দূরবীক্ষণ লইয়া দেখিলেন। দেখিয়া কহিলেন, “তুমি ঠিক বলেছ ডিক। ওগুলি আউরিজারা শৈলমালা। সম্মুখে যে পর্ব্বত দেখছো ওর নাম ডুথুমি। আজ রাত্রে আমরা ডুথুমির পর পারে যেয়ে বিশ্রাম করবো। ৫০০।৬০০ ফিট উপরে না উঠিলে পর্ব্বত শিখর পার হওয়া যাবে না।”
বেলুন অগ্রসর হইতে লাগিল। জো চীৎকার করিয়া কহিল “ওই দেখুন একটা কি বিরাট বৃক্ষ। এমন বারটা গাছ এক যায়গায় থাকলেই মস্ত একটা বন হ’তে পারে।” ফার্গুসন্ বলিলেন, “ও গাছের নাম বাওবাব্—ওই দেখ, গাছের একটা কাণ্ড দেখ। কি বিশাল! প্রায় ১০০ ফিট ব্যাস হ’বে— কেমন না? কে বলতে পারে যে, এই বৃক্ষতলেই ফরাসী পর্য্যটক মেইজান ১৮৪৫ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হননি। ওই যে দূরে একখানা গ্রাম দেখা যাচ্ছে ওর নাম জিলামোরা। মেইজান একাকী ওখানে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। গ্রামের সর্দ্দার তাঁকে বন্দী করে’ একটা বাওবাব্ গাছের শিকড়ের সঙ্গে বেঁধে ধীরে ধীরে টুকরা টুকরা করে’ কেটেছিল! কণ্ঠার্দ্ধ কেটে স্কন্ধ থেকে মস্তক টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল। উঃ কি নৃশংস নরহত্যা! হতভাগ্য পর্য্যটক ২৬ বৎসর বয়সে এমনি নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হয়েছিলেন।”
ফার্গুসন্ গ্যাসের উত্তাপ বৃদ্ধি করিলেন। বেলুন প্রায় ৮ সহস্র ফিট উপরে উঠিল। তাঁহারা অবলালাক্রমে ডুথুমি শৈল অতিক্রম করিয়া পর্ব্বতের অপর পারে নামিলেন। বেলুন হইতে একটা নোঙ্গর নিক্ষিপ্ত হইল। অল্পক্ষণ মধ্যেই উহা একটা বৃহদাকার বৃক্ষের শাখার সহিত আবদ্ধ হইয়া গেল।
জো রজ্জু-মই বাহিয়া বৃক্ষোপরি অবতরণ করিল এবং বৃক্ষশাখার সহিত নোঙ্গরটী দৃঢ়রূপে বাঁধিয়া দিল।
তখন সন্ধ্যা হইয়াছিল। রাত্রে নিয়মিতরূপে বেলুন পাহারা দিবার বন্দোবস্ত করিয়া তিন জনে আহারে বসিলেন।