বেল্লিক রামায়ণ/শিয়ানে শিয়ানে কোলাকুলি

ষষ্ঠ কাণ্ড।

শিয়ানে শিয়ানে কোলাকুলি।

বেল্লিক চলিয়ে গেল মোহিনীর স্থানে।
তাহার সহিত পরামর্শের কারণে॥
কিন্তু কই নাহি আর আসে ত ফিরিয়ে।
আশায় কত বা আর রহে সে বসিয়ে॥
একদণ্ড দুইদণ্ড এমনি হইবে।
বসি দর্প সেই স্থানে সেই একভাবে॥
মনে করে এখনি আসিবে পুন ফিরি।
আর ও কিঞ্চিৎ কাল নাহি হবে দেরি॥
কিন্তু দুই ঘণ্টাকাল উত্তীর্ণ ক্রমেতে।
বেল্লিক নিকটে তার না আসে কিছুতে॥
তখন ভাবিত সেই হয়ে অতিশয়।
সারা বাড়ী পাতি পাতি করি অন্বেষয়॥
দেখে কোথা বা বেল্লিক, কোথায় মোহিনী।
সারাটী বাড়ীটী পড়ে রয়েছে অমনি॥
নাহিক একটি প্রাণী আর ত সেখানে।
তখন বুঝিল তারা পলাল গোপনে॥

দামী দামী দ্রব্য যত বাক্সবন্দী করি।
লইয়া গিয়াছে সবি কিছু নাহি পড়ি॥
কেবল কতকগুলো খাট-তক্তপােষ।
তা ও ভাঙ্গা অবস্থায় করে আপ্‌শােষ॥
তারাই কেবল নাহি সঙ্গে যেতে পেরে।
মনের দুখেতে যেন খেদ করে মরে॥
দেখি বিপরীত এই আশ্চর্য্য ঘটন।
মনে মনে দর্পবাবু চিন্তিত তখন॥
আমারে ত দিল ফাঁকি সে এইরূপেতে।
আমি কিন্তু দিই ফাঁকি তারে কেমনেতে॥
শিয়ানে শিয়ানে চাই কোলাকুলি করা।
তবেই মনের শান্তি, নহে কেঁদে সারা॥
কিন্তু কেমনেতে ইহা হয় সংঘটন।
কেমনেতে প্রতিশােধ করিব গ্রহণ॥
হেন বেমালুম ফাঁকি সে আমারে দিল।
চক্ষের নিমেষে যেন কোথা লুকাইল॥
কিছু আর নাই হেথা আসে যে কারণ।
একবারে সমুদয় কৈল অদর্শন॥
এইরূপ বসি সেথা ভাবে দর্পবাবু।
হেনকালে বাড়ীয়ালা এসে করে কাবু॥
বলে, “কি হে ও বাবুরা কেমন ব্যভার।
লুকাইয়ে পলাতেছ কিবা এ ব্যাপার॥

এসেছ চারিটী মাস এখানে আমার।
একটী পয়সা ভাড়া না দিলে তাহার॥
দশটী করিয়ে টাকা দিবে বােলেছিলে।
পাওনা চল্লিশ টাকা দাও দেখি ফেলে॥
চোরের রীতিই এক স্বতন্ত্র প্রকার।
রাতারাতি ফাঁকি দিয়ে যাও কাছে কার॥
কলিকাতাবাসী দেখি বড় জুয়াচোর।
আজি কিন্তু ভেঙ্গে দিব যত ভার-ভাের॥
শুনিয়ে অবাক্ দর্প হয় এককালে।
চমকিত হয় যাহে উদরের পিলে॥
বলিতে লাগিল, “এ কি বলিছেন বাণী।
এমন অপূর্ব্ব নাহি কখন ত শুনি॥
যে জন ভাড়াটে হেথা ছিল আপনার।
জুয়াচোর বটে সেই মিথ্যা নাহি তার॥
কিন্তু সে নহিক আমি, আমি আর জন।
সদ্য কলিকাতা হতে, হেথা আগমন॥
আমারো সহিত জুয়াচুরী সে করেছে।
ফাঁকি দিয়ে আমারে সে পলাইয়ে গেছে॥
এইমাত্র তার সাথে আমার যে দেখা।
বসায়ে রাখিয়ে হেথা গেল মােরে একা॥”
এই বলি আগাগােড়া, নিজ দোষ ঢােকে।
যতেক বৃত্তান্ত সেথা বলিল তাহাকে॥

গুনিয়ে অবাক্ সেও, তাহা হতে বেশী।
মনের ভিতরে তুলে ভাবনার রাশি॥
পুলিসে সংবাদ অতঃপর দিতে যায়।
পুলিস দর্পের সাক্ষী চাহিয়া পাঠায়॥
সুতরাং দর্পেরে পুলিসেতে যেতে হ’ল।
আগাগােড়া সেথা দর্প প্রকাশ করিল॥
রাজারেও, সত্য কি না, জিজ্ঞাসা করিয়ে।
পত্র এক পুলিস সে, দিল পাঠাইয়ে॥
রাজার মনের সন্ধ, তারি’পরে ছিল।
অতএব দর্পপরে যত দোষ দিল॥
বলিল, “উহারে আমি পাঠায়েছি তথা।
নহে মিথ্যা এ কথা ত স্বরূপ বারতা॥
কিন্তু ও যে বলিতেছে ও নহেক দোষী।
এ কথা নিশ্চিত জেনো হয় অবিশ্বাসী॥
অই তারে—মােহিনীরে করেছে হরণ।
তাই বেল্লিকের সনে করেছে প্রেরণ॥
ভাবেতে সন্দেহ প্রাণে জন্মেছে অটল।
নতুবা কেমনে বার্ত্তা জানে ও সকল॥
অবশ্য দর্পও লিপ্ত আছে ভিতরেতে।
বােধ হয় কমি কিছু হয়েছে স্বার্থেতে॥
তেঁই সে এখন ‘সতী’ কবুলিতে চায়।
কোনরূপে নিজ দোষ মুছে যদি যায়॥

তাহা ছাড়া, বেল্লিক উপরে রাগ এবে।
তাই চেষ্টা করে কিসে তাহারে ফাঁসাবে॥
বেল্লিক আমার বাড়ী কভু না আসিত।
কেমনে সন্ধান তার সেই ব্যক্তি পেত॥
কেমনে আমার বাড়ী করিয়ে প্রবেশ।
পারিত করিতে চুরি—শঠতার শেষ॥
অবশ্য দর্পই তারে পথ দেখায়েছে।
অথবা দর্পই তারে বাহির করেছে॥
তার পর শ্যায়নামো করি তার সনে।
পাঠায়ে নিজেই দেছে অই দূরস্থানে॥
এক্ষণে করুণা ভিক্ষা মাগে এ অধম।
সহজে নিষ্কৃতি যেন পায় না দুর্জ্জন॥”
শুনিয়া রাজার বাণী তবে ত পুলিস।
দর্পেরে চালান দেয়, মনেতে হরিষ॥
ভাবে দর্প—“মম দর্প হইল যে চূর।
না রহিল সমাজেতে আর কিছু ভূর্॥
হায় হায় এতখানা হইবে যে শেষে।
কে জানিত আগে তাহা, পুড়িব হুতাশে॥
ভাল, এর প্রতিশোধ আমি কি না লব।
কেমনে আমার হাত এড়াবে দেখিব॥
যুঘু দেখিয়াছে সেই, দেখেনিক ফাঁদ।
বুঝিকে আমার বল, এইবারে চাঁদ॥

একবার কোনরূপে পাই অব্যাহতি।
দেখাইয়ে দিই কিবা করি তার গতি॥
শিয়ানে শিয়ানে কোলাকুলি এরি নাম।
নিশ্চিত অদৃষ্ট তারে হবে এবে বাম॥
যেমতি ফাঁদের হাতে ব্রাহ্মণ ঠেকিল।
সেইমত শিক্ষা আমি দিব তারে ভাল॥
অতি অপরূপ ঘুঘু-ফাঁদ-বিবরণ।
শিখেছে বহুৎ তাহা করিয়ে শ্রবণ॥
ঘুঘু ফাঁদ নামে দুই ব্রাহ্মণ-সন্তান।
অত্যন্ত গরীব নাহি অন্নের সংস্থান॥
ছিল এককালে কোন অতি দীন গ্রামে।
সবাই বিমুখ ছিল তাহাদের নামে॥
গরীবেরে কেবা দয়া করে বল কোথা।
কে আছে এমন বােঝে গরীবের ব্যথা॥
দিনান্তে না জোটে অন্ন এমনি হইল।
কাতর দুইটী ভাই কাঁদিতে লাগিল॥
পরে বড়ভাই স্থির করে এই মনে।
যাইব কোথাও এক কর্ম্মের সন্ধানে॥
ঘুচিবে তা হলে দুঃখ আসিবে সুদিন।
এত বলি কর্ম্ম হেতু বাহিরে সে দিন॥
কিছুদূর গিয়ে এক ব্রাহ্মণ দেখিল।
সেই সে ব্রাহ্মণ তারে চাকর রাখিল॥

কড়ার করিল কিন্তু সেই সে ব্রাহ্মণ।
পান্তা ও আমানি অগ্রে করিবে ভক্ষণ॥
তার পর ভাল অন্ন পাইবেক খেতে।
না পাবে খাইতে ভাল আপন ইচ্ছাতে॥
তার পর এক কথা যখনি যা বলি।
করিতে হইবে তাহা ওজর না করি॥
না হয় পছন্দ যদি কাজ পরেক্কেতে।
ছাড়িতে নারিবে কাজ আপন ইচ্ছাতে॥
হই যদি রাজী আমি তবে ত খালাস।
নতুবা কিছুতে নাহি পাবে অবকাশ॥
যাইলে স্বেচ্ছায় নাক লব আমি কেটে।
আমিও তাহাই যদি লবে তুমি কেটে॥
কড়ারেতে রাজী ঘুঘু হইল তাহার।
বেতন পাঁচটী টাকা নাহি বৃদ্ধি আর॥
করিতে লাগিল কার্য্য সেথা অতঃপর।
অতি আশান্বিত ঘুঘু হইয়ে সত্বর॥
কিন্তু দিন কত কার্য্য করা হলে পরে।
চমকে পেটের পিলে—কেঁদে ঘুঘু মরে॥
খেটে খেটে সারা, নাহি কাজে অবসান।
ওঠে বসে সবতাতে কার্য্য আগুয়ান॥
বলে না যে নাহি কাজ বসো একটুকু।
ক্রমাগত কাজ আর মুখ আঁকুবাঁকু॥

মুখনাড়া কেবলি কেবলি গালাগালি।
মারিতে কাটিতে যায় দশ কথা বলি॥
অথচ খাইতে পায় শুধু পান্তাভাত।
আমানি কিঞ্চিৎ আর দুটো শাকপাত॥
ভাল অন্ন দিনেকের তরে নাহি মিলে।
জন্মিল পেটের পীড়া—বাড়িল ত পিলে॥
অতি কৃশ কলেবর ম’রে বুঝি যায়।
এমনি হইল ভাব কে রাখে তাহায়॥
দুঃখে পড়ে পায়ে ধরে কাঁদে ব্রাহ্মণের।
ব্রাহ্মণ শুনে না কিন্তু কথা গরীবের॥
বলে,—“নাক রাখাে আগে, যাও তার পর।
করেছ কড়ার কিসে যাবে শীঘ্রতর॥
কি করে প্রাণের ভয়ে ঘুঘু কাটে নাক্।
আনন্দে ব্রাহ্মণ দিল বাজাইয়ে শাঁক॥
নাককাটা অবস্থায় ঘুঘু এল ঘরে।
জিজ্ঞাসিল দশজন নাক কোথাকারে॥
কাঁদিয়ে কহিল ঘুঘু যত বিবরণ।
বড়ই দুঃখিত ফাঁদ হৈল মনে মন॥
ফাঁদ কহে, “ভাল দাদা থাক তুমি ঘরে।
আমি যাব এইবার চাকরীর তরে॥
সেই সে ব্রাহ্মণ-বাড়ী হইব চাকর।
দেখিব কেমন সেই সুচতুর নর॥”

এত বলি ফাঁদ পুনঃ যায় সেইখানে।
চাকর থাকার কথা কহিল ব্রাহ্মণে॥
ব্রাহ্মণ স্বর্গের চাঁদ হাতে যেন পায়।
বুঝিল আবার বোকা আসিল হেথায়॥
চরিত্রই এইরূপ সেই ব্রাহ্মণের।
খাটাইয়া নাহি কড়ি দেয় খাটনের॥
কোনরূপে ফাঁকি ফুঁকি দিয়ে চাকরেরে।
খাটাবার ইচ্ছা তার সতত অন্তরে॥
ফাঁদের সহিত পুনঃ করিল কড়ার।
যেইমত ঘুঘু সনে করে একবার॥
ফাঁদের মনেতে ইচ্ছা জব্দ করিবারে।
অতএব সেও রাজী হইল কড়ারে॥
পরে খাইবার স্থান করি নির্ব্বাচন।
বৃহৎ গহ্বর এক করিল খনন॥
উপর আবৃত করি খিলান করিয়ে।
সরু এক ছিদ্রমাত্র রাখে মাঝ দিয়ে॥
এমন হইল তাহা মালুম না হয়।
খোরা খোরা পান্তামানি পাচাড় করয়॥
সকলি চলিয়ে যায় সেই ছিদ্রপথে।
রাশি রাশি উষ্ণ অন্ন লাগে পরে খেতে॥
কে তারে বারণ করে খাইতে তাহায়।
কেন না গরম দিবে পান্তা যদি খায়॥

খাওয়া ত চলিল এইরূপেতে তাহার।
অতঃপর শুন তার কর্ম্মের ব্যাপার॥
উঠে যদি, ছেলে ধরে—বসে, কাট্‌না কাটে।
এমনি সে বন্দোবস্ত ছিল তার সাথে॥
কিন্তু সে ছেলের গায়ে চিম্‌টি কাটিয়ে।
কাঁদাতে লাগিল নিত্য, ছেলে মরে ভয়ে॥
সহজে না কাছে তার যেতে চায় ছেলে।
কাজেই, “নিও না হেদে” কর্ত্তাগিন্নী বলে॥
একদিন পাঠ কাটিবারে আজ্ঞা হয়।
কাটারি আনিয়ে ফাঁদ সকলি কাটয়॥
জিজ্ঞাসে ব্রাহ্মণ একি কাণ্ডখানা তাের।
কেন তুই ক্ষতি এত কর্‌লি বল্ মাের॥
এই কি রে পাটকাটা বল দেখি শুনি।
তাের মত পাজী আমি কখন দেখিনি॥
সে বলে, সামাল মুখ, কথা তুমি কবে।
পাট কাটা কারে বলে, বল দেখি তবে॥
বলেছ কাটিতে পাট, দিয়েছি তা কেটে।
পছন্দ না হয়, আর লাগিব না পাটে॥
কাটিতে হইলে পাট্ এমনি কাটিব।
পছন্দ না হলে কাটা স্থগিত রাখিব॥”
কহিতে না পারে কথা আর ত ব্রাহ্মণ।
কড়ারে আছয়ে বদ্ধ ভাবে মনে মন॥

সেই রাতে ব্রাহ্মণের ছেলে কাঁদে ভারী।
হয়েছে পেটের পীড়া নাহি সহে দেরী॥
‘হাগিব’ বলিয়ে ঘন কাঁদিতে লাগিল।
ফাঁদেরে হাগাতে তবে ব্রাহ্মণ কহিল॥
উঠে ফাঁদ তাড়াতাড়ি হাগাইতে যায়।
পথে কিন্তু গিয়ে বড় দৌরাত্ম্য লাগায়॥
বলে, “দেখ ছোঁড়া যদি হাগিবি এখন।
নির্যস্ করিব তােরে মারিয়ে নির্দ্দম॥”
ভয়েতে না হাগে ছেলে হাগা টিপে রয়।
ফাঁদ গিয়ে চুপিচুপি শয্যায় শোওয়ায়॥
কহিল ব্রাহ্মণ, “হাগা হয়েছে খােকার?
ফাঁদ কহে, “অতিরিক্ত হেগেছে দুবার॥”
কিন্তু ক্ষণপরে খোকা পুন ‘হাগি’ বলে।
পুনঃ ডাক পাড়ে প্রভু ‘ফাঁদ’ ‘ফাঁদ’ বােলে॥
পুনঃ ফাঁদ হাগাইতে চলিল তাহায়।
পুনশ্চ পথের মাঝে ভয় সে দেখায়॥
বেজায় ভয়েতে খোকা পুনঃ হাগা চাপে।
আবার শােয়ায় ফাঁদ তারে চুপে চুপে॥
বালক চাপিবে হাগা, কিন্তু কতক্ষণ।
মিনিট দু তিন পরে পুনশ্চ ক্রন্দন॥
ব্রাহ্মণ রাগিয়ে বলে, “দেত গলা টিপে।
এমন বেয়াড়া ছেলে, মার গলা চেপে॥”

শুনেই উঠিল ফাঁদ, মারিল তাহায়।
ব্রাহ্মণ অবাক্, আর কথা না জুয়ায়॥
বলে এ কি সর্ব্বনাশ করিলাম আমি।
ছেলেরে করিলে খুন কেন বল তুমি?
ফাঁদ বলে, বলেছেন তবে ত করেছি
আপন ইচ্ছায় আমি নাহি ত মেরেছি॥
যা হবার হয়ে গেছে কিবা আর হবে।
এমন আদেশ আর নাহি কর তবে॥
অন্তরের দুঃখ দ্বিজ অন্তরে লুকায়।
ভাবে, এরে কেমনেতে করিব বিদায়॥
এইরূপ কিছুদিন পুনঃ গত হৈল।
একদিন বাজারেতে ব্রাহ্মণ চলিল॥
সঙ্গে ফাঁদ যাইতেছে পিছন পিছন।
ক্রীত কাষ্ঠ বহিবারে এই ত মনন॥
ক্রয় করি কাষ্ঠ ক্রমে ব্রাহ্মণ কহিল।
এইগুলি লয়ে তুমি বাড়ী পানে চল॥
আজ্ঞামাত্র কাঠ ঘাড়ে ফাঁদ চলে বাড়ী।
দু মন কাষ্ঠের বোঝা অসহনীয় ভারী॥
বাড়ীতে লইয়া বহুকষ্টে ফাঁদ গেল।
“কোথা ফেলি কোথা ফেলি” চীৎকার করিল॥
বহুৎ কার্য্যের ভিড়ে আছিল ব্রাহ্মণী।
নহেক গৃহিণী, অই ব্রাহ্মণ-জননী॥

বলিল “রাখহ স্থান দেখে নিজে তুমি।
এখন বিশেষ কাজে ব্যস্ত আছি আমি॥”
ফাঁদ কিন্তু সে কথা না তুলিল কাণেতে।
“কোথা ফেলি” রর শুধু সঘনে মুখেতে॥
বিরক্ত হইয়ে বুড়ী কহিল এবার।
“কোথায় ফেলিবি, ফেল্ মাথায় আমার॥”
শ্রুত মাত্র সেই কথা অমনি তখনি।
ফেলিল তেমতি ফাঁদ, মরিল ব্রাহ্মণী॥
বিষম ভারি সে বোঝা, তাহার চাপন।
কেমনে বাঁচিবে বল, বুড়ীর জীবন॥
অমনি পড়িয়ে গেল হাহাকার সেথা।
ব্রাহ্মণ বাড়ীতে আসি শুনে সর কথা॥
কাঁদিতে লাগিল, তবে, সেই সে ব্রাহ্মণ।
“হায় হায় সর্ব্বনাশ, এ কি রে ঘটন॥
ওরে অলপ্পেয়ে ছোঁড়া, করিলি কি কাজ।
কেন রে শিরেতে মোর হানিলি এ বাজ॥”
ফাঁদ কহে, “কি করিব, আদেশ তাঁহার।
ফেলিতে কাঠের বোঝা, উপরে মাথার॥
কি করে মনের দুঃখ মনেই তখন।
গুমুরে গুমুরে মরে আপনি ব্রাহ্মণ॥
ছেলে গেল, মাতা গেল, এক ভৃত্য হতে।
অথচ সহজে নাহি পারেও ছাড়াতে॥

ছাড়াতে গেলেই নাক যাইবেক কাটা।
অতএব ছাড়ালেও তাহে বড় লেঠা॥
কি করিবে আপাতত ছাড়ান না হয়।
যেমন আছিল ফাঁদ তেমনিই রয়॥
দশদিন পরে হয় শ্রাদ্ধ আয়ােজন।
উঠান করিতে সাফ কহিল ব্রাহ্মণ॥
‘তৈল-চক্চকে যেন হয়’ কহে তারে।
চাঁচিয়ে উঠান্ সেও পরিষ্কার করে।
ভাঁড়ারেতে যত তেল ছিল ব্রাহ্মণের।
সমস্ত ঢালিয়া দিল উপরে উঠানের॥
ঘতের মট্‌কী এক তারপর আনি।
ঢালিল যতেক ধৃত উঠানে তখনি॥
নিকাইল ন্যাতা করি, সেই সে উঠান।
একটী দণ্ডেতে সব হৈল সমাধান॥
ব্রাহ্মণ আসিয়া কহে, “একি রে ব্যাপার।
ঘৃত তৈল উঠানেতে কেন একাকার॥”
ফাঁদ কহে, “তেল-চকচকে করিয়াছি।
তেলে না কুলায় দেখি, ঘৃত পুনঃ দিছি॥
যত ঘৃত যত তৈল—সব দিছি ঢেলে।
একটুকু মাত্র নাহি কোন ভাণ্ডতলে॥”
গালে হাত দেয়, কথা শুনিয়ে ব্রাহ্মণে।
ভাবে, “ভাল আক্কেল-সেলামি এতদিনে॥”

কিন্তু তবু কোন কথা নাহি বলে তায়।
না পারে থাকিতে প্রাণ করিতে বিদায়॥
বিদায় করিতে গেলে, কাটা যাবে নাক।
ভাবে, “তার চেয়ে আর দিনকত থাক॥”
আবার রাখিল এই ভেবে তারে কাছে।
জঞ্জাল বাড়ায় না বুঝিয়ে মিছে মিছে॥
দিন যাবে রবে না ত শুধু রবে কথা।
আর সেই স্মরণেতে মনে লাগে ব্যথা॥
দিনরাত ব্রাহ্মণের বুকে বুকে ভয়।
আবার কি সূত্রে কবে কি লেঠা ঘটয়॥
এইরূপ ভাবে, ক্রমে এক শনিবার।
ব্রাহ্মণ ভাবিল, ‘যাব শ্বশুর-আগার॥’
মনে মনে দ্বিজবর হেন স্থির করি।
উপনীত হয় ক্রমে শ্বশুরের বাড়ী॥
সঙ্গেতে চাকর ফাঁদ আছয় নিশ্চিত।
করেছে ব্রাহ্মণ তারে স্তুতি যথোচিত॥
বলিল, “দেখিও যেন, কিছু অঘটন।
ঘটায়ো না এখানেতে ওরে বাপধন॥
ফাঁদ বলে, হেসে হেসে,—“ভাল ভাল ভাল।
কিছু না হইবে গোল, নিশ্চিন্তেতে চল॥”
এই বলি ফাঁদ তার সঙ্গে সঙ্গে যায়।
পশিল ক্রমেতে যথাস্থানে পুনরায়॥

ব্রাহ্মণের পত্নী হেথা আছয় এখন।
মাসাবধি আসিয়াছে, শুন বিবরণ॥
জামাই এসেছে বাড়ী বহুদিন পরে।
আনন্দে খাবার কত হয় অন্তঃপুরে॥
কচুরী সিঙ্গেড়া লুচি পান্তুয়াদি করি।
সন্দেশ মিঠাই কত হয়েছে তৈয়ারি॥
চিনিপাতা দধি ক্ষীর পায়স উত্তম।
মাংসের কাবাব কোর্ম্মা গরম গরম॥
হেনকালে ফাঁদ যায় সেই অন্তঃপুরে।
তামাক খাবার অগ্নি আনিবার তরে॥
বলে সেথা গিয়ে, “এ কি করিছ তোমরা।
কাহার নিমিত্তে বল এ খাবার করা?”
আশ্চর্য্য হইয়ে সবে জিজ্ঞাসে তখন।
“কেন বল দেখি হেন কহিছ কথন?
জামাই এসেছে বাড়ী, হতেছে খাবার।
করিব খাবার বল, তবে আর কার?”
বিশেষ দুঃখিত যেন, হয়ে হেন ধারা।
ফাঁদ কহে ধীরে ধীরে, “শুনহ তোমরা॥
হয়েছে পারার ব্যামো, জামাই বাবুর।
সত্বর ব্যবস্থা কিছু করহ সাগুর॥
সাগু বিনা বাবু কিছু না খাবেন আর।
বিশেষ বারণ আছে, ও সব খাবার॥

হয়েছে এমন ক্ষত, সারে কি না সারে।
বলিতে ফাটয়ে বুক, বুঝি যায় ম’রে॥
বেজায় ছোঁয়াচে রােগ সতর্ক বৌদিদি।
বাবুর দুঃখেতে ইচ্ছে,—ডাক ছেড়ে কাঁদি॥”
ভাবে তারা হতে পারে আশ্চর্য্য কি তার।
সাগুরি ব্যবস্থা কাজে হয় এইবার॥
খাইতে না ডাকে আর বাড়ীতে তাহারা।
ডাকিয়ে ফাঁদেরে সাগু দেয় হাতে তারা॥
পরে শয্যা বাহিরেই পাঠাইয়ে দিল।
একটা কম্বল মাত্র ব্যবস্থা হইল॥
সামান্য ওয়াড়শূন্য বালিস একটী।
সেই মাত্র পাঠাইয়া দিলেক ঝটিতি॥
বলিল, “বলহ গিয়ে জামাই বাবুরে।
এ যাত্রা বাড়ীতে যেন যান উনি ফিরে॥
এ যাত্রা অন্দরে নাহি হইবে প্রবেশ।
পুনশ্চ আসেন যেন সেরেসুরে বেশ॥”
অবাক্ ব্রাহ্মণ—ভাবে, এ কেমন হৈল?
বাড়ীতে প্রবেশে কেন নিষেধ করিল?
সাগু দিল খেতে কেন কি রােগ আমার?
না পারে বুঝিতে কিছু প্রকৃত ব্যাপার॥
ফাঁদে জিজ্ঞাসিয়ে কিছু না পান সংবাদ।
‘কেমনে জানিব আমি’ কহে মাত্র ফাঁদ॥

আকুল চিন্তায় হয়ে উঠিল ব্রাহ্মণ।
রাত্রের মধ্যেই যেন পাগল মতন॥
বেজায় ভাবনা ভেবে পেটে ফাঁপ ধরে।
ক্রমে বিপরীত বাহ্যে চাপিল ভিতরে॥
কহে ফাঁদে ডেকে, “ওহে ফাঁদ তুমি জেগে?
দাঁড়াও বারেক যদি আসি আমি হেগে॥”
ফাঁদ বলে, “এত রাত্রে কোথা আমি যাব।
এ রাত্রে কিছুতে আমি দাঁড়াতে নারিব॥
একান্ত পেয়েছে হাগা শুন যুক্তি বলি।
ঘরেতেই হাগ তুমি দিব আমি ফেলি॥
প্রভাত হতে না হতে ফেলে দিব আমি।”
হাতে দিল ঘটী এক, বলে “হাগো তুমি॥
এই ঘটির মধ্যেই রাখ তুমি হেগে।
আনিব কাচিয়ে সাফ শেষ রাত্রিযোগে॥”
কি করে ব্রাহ্মণ তাই হাগে অতঃপর।
এদিকে প্রভাতরাত্রি ক্রমেতে গোচর॥
কহিল ব্রাহ্মণ, “ফাঁদ এই বেলা ফেল।”
ফাঁদ কিন্তু কিছুতে না সে মল ফেলিল॥
ক্রমেতে সকাল হলে বাহির বাড়ীতে।
উঠিল ত গোলমাল—ধাক্কা কপাটেতে॥
দোর খুলে ফাঁদ বলে, “কি কর তোমরা।
ঘরেতে যে মাল আছে এখনও হে পোরা॥

ঘটীর ভিতরে বাবু রাখিয়াছে হেগে।
এস তার পরে, হাগা সাফ হােক্ আগে॥”
কে কত হাসিবে আর মহা গােলমাল।
লজ্জায় জামাই ছুটে পলাইয়া গেল॥
পিছনে পিছনে ফাঁদ করে ছুটাছুটি।
বলে, “মেজে দিয়ে যাও এই বেলা ঘটী॥”
ক্রোধেতে ব্রাহ্মণ বলে, “হােক্ যা হবার।
না রাখিব তােরে আমি কিছুতেই আর॥
এই বেলা কাছ থেকে পালা বেটা তুই।
কিছুতেই তােরে আর না রাখিব মুই॥”
ফাঁদ বলে,—“দাও নাক কাটিব এবার।
আছে ত মনেতে তব যতেক কড়ার॥
না কাটিয়ে নাক নাহি যাইব ত আমি।
বড় যে ভায়ের নাক কেটেছিলে তুমি॥
এর আগে ভৃত্য ছিল সােদর আমার।
বড়ই দুর্দ্দশা তুমি করিয়াছ তার॥
সেই শােধ লইতেই মম আগমন।
দাও নাক এই বেলা করিয়ে কর্ত্তন॥
ঘুঘু দেখিয়াছ তুমি ফাঁদ দেখ নাই।
এইবার মহাফাঁদে পড়িয়াছ তাই॥”
শুনিয়ে স্তম্ভিত তবে হইল ব্রাহ্মণ।
হেসে ফাঁদ, নাক তার করিল কর্ত্তন॥

বেল্লিকের রামায়ণ অতীব সুন্দর।
ক্ষণমাত্রে মুগ্ধ, হলে নয়নগোচর॥
এমন মজার কথা কোন শাস্ত্রে নাই।
যত পড়ি, ততবার পড়িবারে চাই॥