বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 যশোহর রাজবাটিতে আজ কর্ম্মচারীরা ভারি ব্যস্ত। জামাতা আসিবে, নানা প্রকার উদ্যোগ করিতে হইতেছে। আহারাদির বিস্তৃত আয়োজন হইতেছে। চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশ যশোহরের তুলনায় যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর, সে বিষয়ে প্রতাপাদিত্যের সহিত মহিষীর কোন মতান্তর ছিল না, তথাপি জামাতা আসিবে বলিয়া আজ তাঁহার অত্যন্ত আহ্লাদ হইয়াছে। প্রাতঃকাল হইতে বিভাকে তিনি স্বহস্তে সাজাইতে আরম্ভ করিয়াছেন—বিভা বিষম গোলযোগে পড়িয়াছে। কারণ সাজাইবার পদ্ধতি সম্বন্ধে বয়স্কা মাতার সহিত যুবতী দুহিতার নানা বিষয়ে রুচিভেদ আছে, কিন্তু হইলে হয় কি, বিভার কিসে ভাল হয়, মহিষী তাহা অবশ্য ভাল বুঝেন। বিভার মনে মনে ধারণা ছিল, তিনগাছি করিয়া পাতলা ফিরােজ রঙের চুড়ি পড়িলে তাহার শুভ্র কচি হাতখানি বড় মানাইবে;— মহিষী তাহাকে আটগাছা মােটা সােনার চুড়ি ও এক এক গাছা বৃহদাকার হীরার বালা পরাইয়া এত অধিক আনন্দিত হইয়া উঠিলেন যে, সকলকে দেখাইবার জন্য বাড়ির সমুদয় বৃদ্ধা দাসী ও বিধবা পিসীদিগকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। বিভা জানিত যে, তাহার ছােট সুকুমার মুখখানিতে নথ কোন মতেই মানায় না— কিন্তু মহিষী তাহাকে একটা বড় নথ পরাইয়া তাহার মুখখানি একবার দক্ষিণপার্শ্বে একবার বামপার্শ্বে ফিরাইয়া গর্ব্বসহকারে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। ইহাতেও বিভা চুপ করিয়াছিল, কিন্তু মহিষী যে ছাঁদে তাহার চুল বাঁধিয়া দিলেন, তাহা তাহার একেবারে অসহ্য হইয়া উঠিল। সে গােপনে সুরমার কাছে গিয়া তাহার মনের মত চুল বাঁধিয়া আসিল। কিন্তু তাহা মহিষীর নজর এড়াইতে পারিল না। মহিষী দেখিলেন, কেবল চুল বাঁধার দোযে বিভার সমস্ত সাজ মাটি হইয়া গিয়াছে। তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন সুরমা হিংসা করিয়া বিভার চুল বাঁধা খারাপ করিয়া দিয়াছে;—সুরমার হীন উদ্দেশ্যের প্রতি বিভার চোখ ফুটাইতে চেষ্টা করিলেন;—অনেকক্ষণ বকিয়া যখন স্থির করিলেন কৃতকার্য্য হইয়াছেন তখন তাহার চুল খুলিয়া পুনরায় বাঁধিয়া দিলেন! এইরূপে বিভা তাহার খোঁপা, তাহার নথ, তাহার দুইবাহুপূর্ণ চুড়ি, তাহার এক হৃদয়পূর্ণ আনন্দের ভার বহন করিয়া নিতান্ত বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে। সে বুঝিতে পারিয়াছে যে, দুরন্ত আহ্লাদকে কোন মতেই সে কেবলই অন্তঃপুরে বদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিতেছে না, চোখে মুখে সে কেবলই বিদ্যুতের মত উঁকি মারিয়া যাইতেছে। তাহার মনে হইতেছে, বাড়ির দেয়ালগুলা পর্য্যন্ত তাহাকে উপহাস করিতে উদ্যত রহিয়াছে। যুবরাজ উদয়াদিত্য আসিয়া গভীর স্নেহপূর্ণ প্রশান্ত আনন্দের সহিত বিভার সলজ্জ হর্ষপূর্ণ মুখখানি দেখিলেন। বিভার হর্ষ দেখিয়া তাঁহার এমনি আনন্দ হইল যে, গৃহে গিয়া সস্নেহ মৃদু হাস্যে সুরমাকে চুম্বন। করিলেন।

 সুরমা জিজ্ঞাসা করিল, “কি?”

 উদয়াদিত্য কহিলেন,—“কিছুই না!”

 এমন সময়ে বসন্তরায় জোর করিয়া বিভাকে টানিয়া ঘরের মধ্যে আনিয়া হাজির করিলেন। চিবুক ধরিয়া তাহার মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন—“দেখ, দাদা, আজ একবার তােমাদের বিভার মুখখানি দেখ! সুরমা,—ও সুরমা, একবার দেখে যাও!” আনন্দে গদগদ হইয়া বৃদ্ধ হাসিতে লাগিলেন। বিভার মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আহ্লাদ হয় ত ভাল করেই হাস্ না ভাই, দেখি!”

“হাসিরে পায়ে ধরে রাখিবি কেমন করে,
হাসির সে প্রাণের সাধ ঐ অধরে খেলা করে!”

 বয়স যদি না যাইত ত আজ তাের ঐ মুখখানি দেখিয়া এই খানে পড়িতাম আর মরিতাম! হায়, হায়, মরিবার বয়স গিয়াছে! যৌবন কালে ঘড়ি ঘড়ি মরিতাম। বুড়া বয়সে রোগ না হইলে আর মরণ হয় না!”

 প্রতাপাদিত্যকে যখন তাঁহার শ্যালক আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “জামাই বাবাজিকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য কে গিয়াছে?” তিনি কহিলেন “আমি কি জানি!” “আজ পথে অবশ্য আলাে দিতে হইবে?” নেত্র বিস্ফারিত করিয়া মহারাজা কহিলেন “অবশ্যই দিতে হইবে, এমন কোন কথা নাই!” তখন রাজশ্যালক সসঙ্কোচে কহিলেন, “নহবৎ বসিবে না কি?” “সে সকল বিষয় ভাবিবার অবসর নাই।” আসল কথা, বাজনা বাজাইয়া একটা জামাই ঘরে আনা প্রতাপাদিত্যের কার্য্য নহে।

 রামচন্দ্র রায়ের মহা অভিমান উপস্থিত হইয়াছে। তিনি স্থির করিয়াছেন, তাঁহাকে ইচ্ছাপূর্ব্বক অপমান করা হইয়াছে। পূর্ব্বে দুই একবার তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া লইয়া যাইবার জন্য রাজবাটি হইতে চকদিহিতে লােক প্রেরিত হইত, এবারে চকদিহি পার হইয়া দুই ক্রোশ আসিলে পর বামনহাটিতে দেওয়ানজি তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতে আসিয়াছেন। যদি বা দেওয়ানজি আসিলেন, তাঁহার সহিত দুই শত পঞ্চাশ জন বই লােক আসে নাই। কেন, সমস্ত যশােহরে কি আর পঞ্চাশ জন লােক মিলিল না? রাজাকে লইতে যে হাতীটি আসিয়াছে রমাই ভাঁড়ের মতে স্থূলকায় দেওয়ানজি তাহার অপেক্ষা বৃহত্তর। দেওয়ানকে রমাই জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, “মহাশয় উটি বুঝি আপনার কনিষ্ঠ?” ভালমানুষ দেওয়ানজি ঈষৎ বিস্মিত হইয়া উত্তর দিয়াছিলেন, “না ওটা হাতী।”

 রাজা ক্ষুব্ধ হইয়া দেওয়ানকে কহিলেন “তােমাদের মন্ত্রী যে হাতীটাতে চড়িয়া থাকে, সেটাও যে ইহা অপেক্ষা বড়।”

 দেওয়ান কহিলেন, “বড় হাতীগুলি রাজকার্য্য উপলক্ষে দূরে পাঠানাে হইয়াছে, সহরে একটিও নাই।”

 রামচন্দ্র স্থির করিলেন, তাঁহাকে অপমান করিবার জন্যই তাহাদের দূরে পাঠানাে হইয়াছে। নহিলে আর কি কারণ থাকিতে পারে!

 রাজাধিরাজ রামচন্দ্র রায় আরক্তিম হইয়া শ্বশুরের নাম ধরিয়া বলিয়া উঠিলেন, “প্রতাপাদিত্য রায়ের চেয়ে আমি কিসে ছােট?”

 রমাই ভাঁড় কহিল, “বয়সে আর সম্পর্কে, নহিলে আর কিসে? তাহার মেয়েকে যে আপনি বিবাহ করিয়াছেন, ইহাতেই—”

 কাছে রামমােহন মাল দাঁড়াইয়াছিল, তাহার আর সহ্য হইল না, বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়া উঠিল, “দেখ ঠাকুর, তােমার বড় বাড় বাড়িয়াছে। আমার মাঠাকরুণের কথা অমন করিয়া বলিও না। এই স্পষ্ট কথা বলিলাম।”

 প্রতাপাদিত্যকে লক্ষ্য করিয়া রমাই কহিল, “অমন, ঢের ঢের আদিত্য দেখিয়াছি। জানেন ত মহারাজ, আদিত্যকে যে ব্যক্তি বগলে ধরিয়া রাখিতে পারে, সে ব্যক্তি রামচন্দ্রের দাস।”

 রাজা মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিলেন। রামমোহন তখন ধীর পদক্ষেপে রাজার সম্মুখে আসিয়া যোড়হস্তে কহিল, “মহারাজ, ঐ বাম্‌না যে আপনার শ্বশুরের নামে যাহা ইচ্ছা তাই বলিবে, ইহা ত আমার সহ্য হয় না; বলেন ত উহার মুখ বন্ধ করি।”

 রাজা কহিলেন, “রামমোহন তুই থাম্।”

 তখন রামমোহন সেখান হইতে দূরে চলিয়া গেল।

 রামচন্দ্র সে দিন বহু সহস্র খুঁটিনাটি পর্য্যালোচনা করিয়া স্থির করিলেন, প্রতাপাদিত্য তাঁহাকে অপমান করিবার জন্য বহু দিন ধরিয়া বিস্তৃত আয়োজন করিয়াছেন। অভিমানে তিনি নিতান্ত স্ফীত হইয়া উঠিয়াছেন। স্থির করিয়াছেন, প্রতাপাদিত্যের কাছে এমন মুর্ত্তি ধারণ করিবেন, যাহাতে প্রতাপাদিত্য বুঝিতে পারেন তাঁহার জামাতা কতবড় লোক।

 যখন প্রতাপাদিত্যের সহিত রামচন্দ্র রায়ের দেখা হইল, তখন প্রতাপাদিত্য রাজকক্ষে তাঁহার মন্ত্রীর সহিত উপবিষ্ট ছিলেন। প্রতাপাদিত্যকে দেখিবামাত্রই রামচন্দ্র নতমুখে ধীরে ধীরে আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন।

 প্রতাপাদিত্য কিছুমাত্র উল্লাস বা ব্যস্তভাব প্রকাশ না করিয়া শান্তভাবে কহিলেন,—“এস ভাল আছ ত?”

 রামচন্দ্র মৃদুস্বরে কহিলেন, “আজ্ঞা, হাঁ।”

 মন্ত্রীর দিকে চাহিয়া প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “ভাঙামাথী পরগণার তহশীলদারের নামে যে অভিযোগ আসিয়াছে, তাহার কোন তদন্ত করিয়াছ?”

 মন্ত্রী দীর্ঘ এক কাগজ বাহির করিয়া রাজার হাতে দিলেন, রাজা পড়িতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর পড়িয়া একবার চোখ তুলিয়া জামাতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গত বৎসরের মত এবার ত তােমাদের ওখানে বন্যা হয় নাই?”

 রামচন্দ্র “আজ্ঞা না। আশ্বিন মাসে একবার জল বৃদ্ধি—”

 প্রতাপাদিত্য—“মন্ত্রি, এ চিঠিখানার অবশ্য একটা নকল রাখা হইয়াছে।” বলিয়া আবার পড়িতে লাগিলেন। পড়া শেষ করিয়া জামাতাকে কহিলেন, “যাও, বাপু, অন্তঃপুরে যাও।”

 রামচন্দ্র ধীরে ধীরে উঠিলেন। তিনি বুঝিতে পারিয়াছেন তাঁহার অপেক্ষা প্রতাপাদিত্য কিসে বড়!