বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।
মঙ্গলার কুটীর যশোহরের এক প্রান্তে ছিল। সেইখানে বসিয়া সে মালা জপ করিতেছিল। এমন সময়ে শাকসব্জির চুব্ড়ি হাতে করিয়া রাজবাটীর দাসী মাতঙ্গিনী আসিয়া উপস্থিত হইল।
মাতঙ্গ কহিল, “আজ হাটে আসিয়াছিলাম, অমনি ভাবিলাম, অনেক দিন মঙ্গলাদিদিকে দেখি নাই, তা একবার দেখিয়া আসিগে। আজ ভাই অনেক কাজ আছে, অধিকক্ষণ থাকিতে পারিব না।” বলিয়া চুবড়ি রাখিয়া নিশ্চিন্ত ভাবে সেই খানে বসিল। “তা, দিদি তুমি ত সব জানই, সেই মিন্সে আমাকে বড় ভালবাসিত, ভাল এখনো বাসে, তবে আর একজন কা’র পরে তার মন গিয়াছে আমি টের পাইয়াছি—তা’ সেই মাগীটার ত্রিরাত্রির মধ্যে মরণ হয় এমন করিতে পার না?”
মঙ্গলার নিকট গরু হারানো হইতে স্বামী হারানো পর্য্যন্ত সকল-প্রকার দুর্ঘটনারই ঔষধ আছে, তা’ ছাড়া সে বশীকরণের এমন উপায় জানে যে, রাজবাটীর বড় বড় ভৃত্য মঙ্গলার কুটীরে কত গণ্ডা গণ্ডা গড়াগড়ি যায়! যে মাগীটার ত্রিরাত্রির মধ্যে মরণ হইলে মাতঙ্গিনী বাঁচে সে আর কেহ নহে স্বয়ং মঙ্গলা!
মঙ্গলা মনে মনে হাসিয়া কহিল, “সে মাগীর মরিবার জন্য বড় তাড়াতাড়ি পড়ে নাই, যমের কাজ বাড়াইয়া তবে সে মরিবে।” মঙ্গলা হাসিয়া প্রকাশ্যে কহিল, “তোমার মতন রূপসীকে ফেলিয়া আর কোথাও মন যায় এমন অরসিক আছে নাকি? তা’ নাতনী, তোদর ভাবনা নাই। তাহার মন তুমি ফিরিয়া পাইবে। তোমার চোখের মধ্যেই ঔষধ আছে, একটু বেশি করিয়া প্রয়োগ করিয়া দেখিও তাহাতেও যদি না হয়, তবে এই শিকড়টি তাহাকে পানের সঙ্গে খাওয়াইও।” বলিয়া এক শুক্ন শিকড় আনিয়া দিল।
মঙ্গলা মাতঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করিল, “বলি রাজবাটীর খবর কি?”
মাতঙ্গিনী হাত উল্টাইয়া কহিল, “সে সব কথায় আমাদের কাজ কি ভাই?”
মঙ্গলা কহিল, “ঠিক কথা। ঠিক কথা।”
মঙ্গলার যে এ বিষয়ে সহসা মতের এতটা ঐক্য হইয়া যাইবে, তাহা মাতঙ্গিনী আশা করে নাই। সে কিঞ্চিৎ ফাঁফরে পড়িয়া কহিল, “তা’ তোমাকে বলিতে দোষ নাই; তবে আজ আমার বড় সময় নাই; আর একদিন সমস্ত বলিব।” বলিয়া বসিয়া রহিল।
মঙ্গলা কহিল—“তা বেশ, আর একদিন শুনা যাইবে।”
মাতঙ্গিনী অধীর হইয়া পড়িল, কহিল, “তবে আমি যাই ভাই। দেরি করিলাম বলিয়া আবার কত বকনি খাইতে হইবে। দেখ ভাই, সে দিন আমাদের ওখানে, রাজার জামাই আসিয়াছিলেন, তা’ তিনি যে দিন আসিয়াছিলেন সেই রাত্রেই কাহাকে না বলিয়া চলিয়া গিয়াছেন।”
মঙ্গলা কহিল, “সত্য নাকি? বটে; কেন বল দেখি; তাই বলি মাতঙ্গ না হইলে আমাকে ভিতরকার খবর কেহ দিতে পারে না।”
মাতঙ্গ প্রফুল্ল হইয়া কহিল, “আসল কথা কি জান? আমাদের যে বৌঠাকরুণটি আছেন, তিনি দুটি চক্ষে কাহারো ভাল দেখিতে পারেন না। তিনি কি মন্তর জানেন, স্বোয়ামীকে একেবারে ভেড়ার মতন করিয়া রাখিয়াছেন, তিনি—না ভাই; কাজ নাই, কে কোথা দিয়া শুনিবে আর বলিবে মাতঙ্গ রাজবাড়ির কথা বাহিরে বলিয়া বেড়ায়।”
মঙ্গলা আর কৌতূহল সামলাইতে পারিল না; যদিও সে জানিত, আর খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলে মাতঙ্গ আপনি সমস্ত বলিবে, তবু তাহার বিলম্ব সহিল না, কহিল, “এখানে কোন লোক নাই নাতনী। আর আপনা-আপনির মধ্যে কথা, ইহাতে আর দোষ কি? তা’ তোমাদের বৌঠাকরুণ কি করিলেন?”
“তিনি আমাদের দিদিঠাকরুণের নামে জামাইয়ের কাছে কি সব লাগাইয়াছিলেন, তাই জামাই রাতারাতিই দিদিঠাকরুণকে ফেলিয়া চলিয়া গেছেন। দিদিঠাকরুণ ত কাঁদিয়া কাটিয়া অনাত্ত করিতেছেন। মহারাজা খাপা হইয়া উঠিয়াছেন, তিনি বৌঠাকরুণকে শ্রীপুরে বাপের বাড়ি পাঠাইতে চান। ঐ দেখ ভাই, তোমার সকল কথাতেই হাসি! ইহাতে হাসিবার কি পাইলে? তোমার যে আর হাসি ধরে না।”
রামচন্দ্র রায়ের পলায়ন বার্ত্তার যথার্থ কারণ, রাজবাটির প্রত্যেক দাস দাসী সঠিক অবগত ছিল, কিন্তু কাহারো সহিত কাহারো কথার ঐক্য ছিল না।
মঙ্গলা কহিল, “তোমাদের মাঠাকরুণকে বলিও যে, বৌঠাকরুণকে শীঘ্র বাপের বাড়ি পাঠাইয়া কাজ নাই। মঙ্গলা এমন ওষুধ দিতে পারে যাহাতে যুবরাজের মন তাঁহার উপর হইতে একেবারে চলিয়া যায়।” বলিয়া সে খল্ খল্ করিয়া হাসিতে লাগিল। মাতঙ্গ কহিল, “তা বেশ কথা!”
মঙ্গলা জিজ্ঞাসা করিল, “তোমাদের বৌঠাকরুণকে কি যুবরাজ বড় ভালবাসেন?”
“সে কথায় কাজ কি! এক দণ্ড না দেখিলে থাকিতে পারেন না! যুবরাজকে “তু” বলিয়া ডাকিলেই আসেন।”
“আচ্ছা, আমি ওষুধ দিব। দিনের বেলাও কি যুবরাজ তাহার কাছেই থাকেন?”
“হাঁ।”
মঙ্গলা কহিল “ওমা কি হইবে! তা’, সে যুবরাজকে কি বলে, কি করে, দেখিয়াছিস?”
“না ভাই, তাহা দেখি নাই।”
“আমাকে একবার রাজবাটীতে লইয়া যাইতে পারিস্, আমি তাহা হইলে একবার দেখিয়া আসি!”
মাতঙ্গ কহিল “কেন ভাই, তােমার এত মাথাব্যথা কেন?”
মঙ্গলা কহিল, “বলি তা’ নয়। একবার দেখিলেই বুঝিতে পারিব, কি মন্ত্রে সে বশ করিয়াছে, আমার মন্ত্র খাটিবে কি না!”
মাতঙ্গ কহিল, “তা’ বেশ, আজ তবে আসি!” বলিয়া চুবড়ি লইয়া চলিয়া গেল।
মাতঙ্গ চলিয়া গেলে মঙ্গলা যেন ফুলিতে লাগিল, দাঁতে দাঁত লাগাইয়া চক্ষু-তারকা প্রসারিত করিয়া বিড়্ বিড়্ করিয়া বকিতে লাগিল।