বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ।

 মুক্তিয়ার খাঁ ফিরিয়া আসিল। রায়গড়ে অধিকাংশ সৈন্য রাখিয়া উদয়াদিত্যকে লইয়া তৎক্ষণাৎ যশােহরে যাত্রা করিল। পথে যাইতে দুই দিন উদয়াদিত্য খাদ্য দ্রব্য স্পর্শ করিলেন না—কাহারো সহিত একটি কথাও কহিলেন না—কেবল চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন। পাষাণমূর্ত্তির ন্যায় স্থির—তাঁহার নেত্রে নিদ্রা নাই, নিমেষ নাই, অশ্রু নাই, দৃষ্টি নাই —কেবলি ভাবিতেছেন। নৌকায় উঠিলেন—নৌকা হইতে মুখ বাড়াইয়া জলের দিকে চাহিয়া রহিলেন, নৌকা চলিতে লাগিল—দাঁড়ের শব্দ শুনিতে লাগিলেন, জলের কল্লোল কানে প্রবেশ করিল তবুও কিছুই শুনিলেন না, কিছুই দেখিলেন না, কেবলি ভাবিতে লাগিলেন। রাত্রি হইল, আকাশে তারা উঠিল, মাঝিরা নৌকা বাঁধিয়া রাখিল, নৌকায় সকলেই ঘুমাইল কেবল জলের শব্দ শুনা যাইতেছে, নৌকার উপর ছােট ছােট তরঙ্গ আসিয়া আঘাত করিতেছে—যুবরাজ এক দৃষ্টে সম্মুখে চাহিয়া— সুদূর প্রসারিত শুভ্র বালির চড়ার দিকে চাহিয়া কেবলি ভাবিতে লাগিলেন। প্রত্যুষে মাঝিরা জাগিয়া উঠিল—নৌকা খুলিয়া দিল— ঊষার বাতাস বহিল—পূর্ব্বদিক রাঙা হইয়া উঠিল, যুবরাজ, ভাবিতে লাগিলেন। তৃতীয় দিবসে যুবরাজের দুই চক্ষু ভাসিয়া হুহু করিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল—হাতের উপর মাথা রাখিয়া জলের দিকে চাহিয়া রহিলেন —আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন। নৌকা চলিতে লাগিল—তীরে গাছপালাগুলি মেঘের মত চোখের উপর দিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল, চোখ দিয়া সহস্রধারায় অশ্রু পড়িতে লাগিল। অনেক ক্ষণের পর অবসর বুঝিয়া মুক্তিয়ার খাঁ ব্যথিত হৃদয়ে যুবরাজের নিকট আসিয়া বসিল, বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিল—“যুবরাজ, কি ভাবিতেছেন?” যুবরাজ চমকিয়া উঠিলেন—অনেকক্ষণ স্তব্ধভাবে অবাক হইয়া মুক্তিয়ারের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। মুক্তিয়ারের মুখে মমতার ভাব দেখিয়া সহসা রুদ্ধপ্রাণ খুলিয়া যুবরাজ বলিয়া উঠিলেন—“ভাবিতেছি, পৃথিবীতে জন্মাইয়া আমি কি করিলাম। আমার জন্য কি সর্ব্বনাশই হইল! হে বিধাতা, যাহারা দুর্ব্বল এ পৃথিবীতে তাহারা কেন জন্মায়? যাহারা নিজের বলে সংসারে দাঁড়াইতে পারে না—যাহারা পদে পদে পরকে জড়াইয়া ধরে— তাহাদের দ্বারা পৃথিবীর কি উপকার হয়? তাহারা যাহাকে ধরে, তাহাকেই ডুবায়, পৃথিবীর সকল কাজেই বাধা দেয়—নিজেও দাঁড়াইতে পারে না, আর সকলকেও ভারাক্রান্ত করে।—আমি একজন দুর্ব্বল ভীরু, ঈশ্বর আমাকেই বাঁচাইলেন, আর যাহারা সংসারের আনন্দ ছিল, সংসারের ভরসা ছিল—আমার জন্য তাহাদেরই বিনাশ করিলেন? আর না, এ সংসার হইতে আমি বিদায় হইলাম।”

 উদয়াদিত্য বন্দীভাবে প্রতাপাদিত্যের সম্মুখে আনীত হইলেন। প্রতাপাদিত্য তাঁহাকে অন্তঃপুরের কক্ষে লইয়া গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলেন। প্রতাপাদিত্যের কাছে আসিতেই উদয়াদিত্যের শরীর যেন শিহরিয়া উঠিল, অনিবার্য্য ঘৃণায় তাঁহার সর্ব্বশরীরের মাংস যেন কুঞ্চিত হইয়া আসিল —তিনি পিতার মুখের দিকে আর চাহিতে পারিলেন না!

 প্রতাপাদিত্য গম্ভীর স্বরে কহিলেন—“কোন্ শাস্তি তােমার উপযুক্ত?”

 উদয়াদিত্য অবিচলিত ভাবে কহিলেন, “আপনি যাহা আদেশ করেন।”

 প্রতাপাদিত্য কহিলেন—“তুমি আমার এ রাজ্যের যােগ্য নহ।”

 উদয়াদিত্য কহিলেন—“না মহারাজ, আমি যােগ্য নহি। আমি আপনার রাজ্য চাহি না—আপনার সিংহাসন হইতে আমাকে অব্যাহতি দিন—এই ভিক্ষা।”

 প্রতাপাদিত্যও তাহাই চান, তিনি কহিলেন—“তুমি যাহা বলিতেছ, তাহা যে সত্যই তােমার হৃদয়ের ভাব তাহা কি করিয়া জানিব?”

 উদয়াদিত্য কহিলেন—“দুর্ব্বলতা লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছি বটে, কিন্তু আজ পর্য্যন্ত নিজের স্বার্থের জন্য কখনাে মিথ্যা কথা বলি নাই। বিশ্বাস করেন যদি, আজ আমি মা-কালীর চরণ স্পর্শ করিয়া শপথ করিব— আপনার রাজ্যের এক সূচ্যগ্রভূমিও আমি কখনাে শাসন করিব না—সমরাদিত্যই আপনার রাজ্যের উত্তরাধিকারী।”

 প্রতাপাদিত্য সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন—“তুমি তবে কি চাও?”

 উদয়াদিত্য কহিলেন—“মহারাজ, আমি আর কিছুই চাই না—কেবল আমাকে পিঞ্জররুদ্ধ পশুর মত গারদে পূরিয়া রাখিবেন না! আমাকে পরিত্যাগ করুন, আমি এখনি কাশী চলিয়া যাই। আর একটি ভিক্ষা— আমাকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিন—আমি সেখানে দাদামহাশয়ের নামে এক অতিথিশালা ও একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করিব।”

 প্রতাপাদিত্য কহিলেন—“আচ্ছা, তাহাই স্বীকার করিতেছি।”

 সেই দিনই উদয়াদিত্য মন্দিরে গিয়া প্রতাপাদিত্যের সম্মুখে শপথ করিয়া কহিলেন—“মা কালী, তুমি সাক্ষী থাক, তােমার পা ছুঁইয়া আমি শপথ করিতেছি—যত দিন আমি বাঁচিয়া থাকিব, যশোহরের মহারাজের রাজ্যের এক তিলও আমি আমার বলিয়া গ্রহণ করিব না—যশােহরের সিংহাসনে আমি বসিব না, যশােহরের রাজদণ্ড আমি স্পর্শও করিব না। যদি কখনাে করি, তবে এই দাদা মহাশয়ের হত্যার পাপ সমস্ত যেন আমারই হয়?” বলিয়া শিহরিয়া উঠিলেন।

 মহারাণী যখন শুনিলেন, উদয়াদিত্য কাশী চলিয়া যাইতেছেন, তখন উদয়াদিত্যের কাছে আসিয়া কহিলেন, “বাবা উদয়, আমাকেও তাের সঙ্গে লইয়া চল।”

 উদয়াদিত্য কহিলেন, “সে কি কথা মা! তোমার সমরাদিত্য আছে, তােমার সমস্ত সংসার এখানে রহিল, তুমি যদি এখান হইতে যাও, তবে যশােরে রাজলক্ষ্মী থাকিবে না।”

 মহিষী কাঁদিয়া কহিলেন, “বাছা, এই বয়সে তুই যদি সংসার ছাড়িয়া গেলি, আমি কোন্ প্রাণে সংসার লইয়া থাকিব? রাজ্য, সংসার পরিত্যাগ করিয়া তুই সন্ন্যাসী হইয়া থাকিবি—তােকে সেখানে কে দেখিবে? তাের পিতা পাষাণ বলিয়া আমি তােকে ছাড়িতে পারিব না!” মহিষী তাঁহার সকল সন্তানের মধ্যে উদয়াদিত্যকে অধিক ভাল বাসিতেন, উদয়াদিত্যের জন্য তিনি বুক ফাটিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

 উদয়াদিত্য মায়ের হাত ধরিয়া অশ্রুনেত্রে কহিলেন, “মা, তুমি ত জানই রাজবাড়িতে থাকিলে আমার পদে পদে আশঙ্কার কারণ থাকিবে— তুমি নিশ্চিন্ত হও মা, আমি বিশ্বেশ্বরের চরণে গিয়া নিরাপদ হই।”

 উদয়াদিত্য বিভার কাছে গিয়া কহিলেন, “বিভা, দিদি আমার, কাশী যাইবার আগে তােকে আমি সুখী করিয়া যাইব। আমি নিজে সঙ্গে করিয়া তােকে শ্বশুরবাড়ি লইয়া যাইব, এই আমার একমাত্র সাধ আছে!”

 বিভা উদয়াদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, দাদামহাশয় কেমন আছেন?”

 “দাদা মহাশয় ভাল আছেন।” বলিয়াই উদয়াদিত্য তাড়াতাড়ি সেখান হইতে চলিয়া গেলেন।