বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ত্রিংশ পরিচ্ছেদ।

 সীতারাম যুবরাজকে সঙ্গে করিয়া খালের ধারে লইয়া গেল; সেখানে একখানা বড় নৌকা বাঁধা ছিল, সেই নৌকার সম্মুখে উভয়ে গিয়া দাঁড়াইলেন। তাহাদের দেখিয়া নৌকা হইতে এক ব্যক্তি তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া আসিয়া কহিল, “দাদা, আসিয়াছিস্?” উদয়াদিত্য একেবারে চমকিয়া উঠিলেন—সেই চির পরিচিত স্বর, যে স্বর বাল্যের স্মৃতির সহিত, যৌবনের সুখ দুঃখের সহিত জড়িত—পৃথিবীতে যতটুকু সুখ আছে, যতটুকু আনন্দ আছে যে স্বর তাহারি সহিত অবিচ্ছিন্ন! এক এক দিন কারাগারে গভীর রাত্রে বিনিদ্র নয়নে বসিয়া সহসা স্বপ্নে বংশিধ্বনির ন্যায় যে স্বর শুনিয়া চমকিয়া উঠিতেন—সেই স্বর! বিস্ময় ভাঙিতে না ভাঙিতে বসন্তরায় আসিয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিলেন। উভয়ের দুই চক্ষু বাষ্পে পূরিয়া গেল। উভয়ে সেই খানে তৃণের উপর বসিয়া পড়িলেন। অনেক ক্ষণের পর উদয়াদিত্য কহিলেন, “দাদা মহশয়!” বসন্তরায় কহিলেন, “কি দাদা!” আর কিছু কথা হইল না। আবার অনেক ক্ষণের পর উদয়াদিত্য চারিদিকে চাহিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া বসন্তরায়ের মুখের দিকে চাহিয়া আকুল কণ্ঠে কহিলেন—“দাদা মহাশয় আজ আমি স্বাধীনতা পাইয়াছি,—তােমাকে পাইয়াছি, আমার আর সুখের কি অবশিষ্ট আছে? এ মুহূর্ত্ত আর কতক্ষণ থাকিবে?” কিয়ৎক্ষণ পরে সীতারাম যােড়হাত করিয়া কহিল —“যুবরাজ, নৌকায় উঠুন।”

 যুবরাজ চমক ভাঙিয়া কহিলেন—“কেন, নৌকায় কেন?”

 সীতারাম কহিল—“নহিলে এখনি আবার প্রহরীরা আসিবে।”

 উদয়াদিত্য বিস্মিত হইয়া বসন্তরায়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাদা মহাশয়, আমরা কি পালাইয়া যাইতেছি?”

 বসন্তরায় উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কহিলেন, “হাঁ ভাই, আমি তােক চুরি করিয়া লইয়া যাইতেছি! এ যে পাষাণ-হৃদয়ের দেশ—এরা যে তােকে ভালবাসে না! তুই হরিণ-শিশু এ ব্যাধের রাজ্যে বাস করিস্—আমি তোকে প্রাণের মধ্যে লুকাইয়া রাখিব, সেখানে নিরাপদে থাকিবি!” বলিয়া উদয়াদিত্যকে বুকের কাছে টানিয়া আনিলেন—যেন তাঁহাকে কঠোর সংসার হইতে কাড়িয়া আনিয়া স্নেহের রাজ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে চান্।

 উদয়াদিত্য অনেক ক্ষণ ভাবিয়া কহিলেন, “না দাদা মহাশয়, আমি পালাইতে পারিব না।”

 বসন্তরায় কহিলেন, “কেন দাদা, এ বুড়াকে কি ভুলিয়া গেছিস্।”

 উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমি যাই—একবার পিতার পা ধরিয়া কাঁদিয়া ভিক্ষা চাই গে, তিনি হয়ত রায়গড়ে যাইতে সম্মতি দিবেন।”

 বসন্তরায় অস্থির হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “দাদা, আমার কথা শােন্— সেখানে যাস্‌নে, সে চেষ্টা করা নিস্ফল।”

 উদয়াদিত্য নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন—“তবে যাই—আমি কারাগারে ফিরিয়া যাই।”

 বসন্তরায় তাঁহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “কেমন যাইবি যা দেখি। আমি যাইতে দিব না।”

 উদয়াদিত্য কহিলেন, “দাদা মহাশয়, এ হতভাগ্যকে লইয়া কেন বিপদকে ডাকিতেছ। আমি যেখানে থাকি সেখানে কি তিলেক শান্তির সম্ভাবনা আছে?”

 বসন্তরায় কহিলেন—“দাদা তাের জন্য যে বিভাও কারাবাসিনী হইয়া উঠিল। এই তাহার নবীন বয়সে সে কি তাহার সমস্ত জীবনের সুখ জলাঞ্জলি দিবে?” বসন্তরায়ের চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল।

 তখন উদয়াদিত্য তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তবে চল চল দাদা মহাশয়।” সীতারামের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “সীতারাম, প্রাসাদে তিন খানি পত্র পাঠাইতে চাই।”

 সীতারাম কহিল—“নৌকাতেই কাগজকলম আছে, আনিয়া দিতেছি। শীঘ্র করিয়া লিখিবেন অধিক সময় নাই।”

 উদয়াদিত্য পিতার কাছে মার্জ্জনা ভিক্ষা করিলেন। মাতাকে লিখিলেন;—“মা, আমাকে গর্ব্ভে ধরিয়া তুমি কখনাে সুখী হইতে পার নাই। এইবার নিশ্চিন্ত হও মা—আমি দাদা মহাশয়ের কাছে যাইতেছি, সেখানে আমি সুখে থাকিব, স্নেহে থাকিব, তােমার কোন ভাবনার কারণ থাকিবে না।” বিভাকে লিখিলেন “চিরায়ুষ্মতীযু—তােমাকে আর কি লিখিব—তুমি জন্ম জন্ম সুখে থাক—স্বামিগৃহে গিয়া সুখের সংসার পাতিয়া সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলিয়া যাও!” লিখিতে লিখিতে উদয়াদিত্যের চোখ জলে পূরিয়া আসিল। সীতারাম সেই চিঠি তিনখানি এক জন দাঁড়ির হাত দিয়া প্রাসাদে পাঠাইয়া দিল। সকলে নৌকাতে উঠিতেছেন—এমন সময়ে দেখিলেন কে এক জন ছুটিয়া তাহাদের দিকে আসিতেছে। সীতারাম চমকিয়া বলিয়া উঠিল, “ঐরে—সেই ডাকিনী আসিতেছে!” দেখিতে দেখিতে রুক্মিণী কাছে আসিয়া পৌঁছিল। তাহার চুল এলােথেলাে— তাহার অঞ্চল খসিয়া পড়িয়াছে, তাহার জ্বলন্ত অঙ্গারের মত চোখ দুটা অগ্নি উদ্গার করিতেছে—তাহার বার বার প্রতিহত বাসনা, অপরিতৃপ্ত প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তির যন্ত্রণায় অধীর হইয়া সে যেন যাহাকে সম্মুখে পায়, তাহাকেই খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া রােষ মিটাইতে চায়! যেখানে প্রহরীরা আগুন নিবাইতেছিল, সেখানে বার বার ধাক্কা খাইয়া ক্রোধে অধীর হইয়া পাগলের মত প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করে—একেবারে প্রতাপাদিত্যের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিবার জন্য বার বার নিস্ফল চেষ্টা করে, প্রহরীরা তাহাকে পাগল মনে করিয়া মারিয়া ধরিয়া তাড়াইয়া দেয়। যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া সে প্রাসাদ হইতে ছুটিয়া আসিতেছে। বাঘিনীর মত সে উদয়াদিত্যের উপর লাফাইয়া পড়িবার চেষ্টা করিল। সীতারাম মাঝে আসিয়া পড়িল—চীৎকার করিয়া সে সীতারামের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, প্রাণপণে তাহাকে দুই হাতে জড়াইয়া ধরিল—সহসা সীতারাম চীৎকার করিয়া উঠিল, দাঁড়ি মাঝিরা তাড়াতাড়ি আসিয়া বলপূর্ব্বক রুক্মিণীকে ছাড়াইয়া লইল। আত্মঘাতী বৃশ্চিক যেমন নিজের সর্ব্বাঙ্গে হুল ফুটাইতে থাকে, তেমনি সে অধীর হইয়া নিজের বক্ষ নখে আঁচড়াইয়া চুল ছিঁড়িয়া চীৎকার করিয়া কহিল, “কিছুই হইল না, কিছুই হইনা—এই আমি মরিলাম এ স্ত্রী-হত্যার পাপ তােদের হইবে।” সেই অন্ধকার রাত্রে এই অভিশাপ দিকে দিকে ধ্বনিত হইয়া উঠিল। মুহূর্ত্ত মধ্যে বিদ্যুৎবেগে রুক্মিণী জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল। বর্ষায় খালের জল অত্যন্ত বাড়িয়াছিল—কোথায় সে তলাইয়া গেল ঠিকনা রহিল না। সীতারামের কাঁধ হইতে রক্ত পড়িতেছিল, চাদর জলে ভিজাইয়া কাঁদে বাঁধিল। নিকটে গিয়া দেখিল, উদয়াদিত্যের কপালে ঘর্ম্মবিন্দু দেখা গিয়াছে, তাঁহার হাত পা শীতল হইয়া গিয়াছে,তিনি প্রায় অজ্ঞান হইয়া গিয়াছেন—বসন্তরায়ও যেন দিশাহারা হইয়া অবাক্ হইয়া গিয়াছেন; দাঁড়িগণ উভয়কে ধরিয়া নৌকায় তুলিয়া তৎক্ষণাৎ নৌকা ছাড়িয়া দিল। সীতারাম ভীত হইয়া কহিল, “যাত্রার সময় কি অমঙ্গল!”