বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 মন্ত্রী কহিলেন “মহারাজ, কাজটা কি ভাল হইবে?”

 প্রতাপাদিত্য জিজ্ঞাসা করিলেন “কোন্ কাজটা?”

 মন্ত্রী কহিলেন “কাল যাহা আদেশ করিয়াছিলেন।”

 প্রতাপাদিত্য বিরক্ত হইয়া কহিলেন “কাল কি আদেশ করিয়াছিলাম?”

 মন্ত্রী কহিলেন “আপনার পিতৃব্য সম্বন্ধে।”

 প্রতাপাদিত্য। আরো বিরক্ত হইয়া কহিলেন “আমার পিতৃব্য সম্বন্ধে কি?”

 মন্ত্রী কহিলেন “মহারাজ আদেশ করিয়াছিলেন, যখন বসন্তরায় যশোহরে আসিবার পথে সিমুলতলীর চটিতে আশ্রয় লইবেন তখন—”

 প্রতাপাদিত্য ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া কহিলেন “তখন কি? কথাটা শেষ করিয়াই ফেল!”

 মন্ত্রী—“তখন দুই জন পাঠান গিয়া—”

 প্রতাপ—“হঁ।”

 মন্ত্রী—“তাঁহাকে নিহত করিবে।”

 প্রতাপাদিত্য রুষ্ট হইয়া কহিলেন “মন্ত্রী, হঠাৎ তুমি শিশু হইয়াছ না কি? একটা কথা শুনিতে দশটা প্রশ্ন করিতে হয় কেন? কথাটা মুখে আনিতে বুঝি সঙ্কোচ হইতেছে! এখন বোধ করি, তোমার রাজকার্য্যে মনোেযোগ দিবার বয়স গিয়াছে, এখন পরকাল চিন্তার সময় আসিয়াছে। এতদিন অবসর প্রার্থনা কর নাই কেন?”

 মন্ত্রী—“মহারাজ আমার ভাবটা ভাল বুঝিতে পারেন নাই।”

 প্রতাপ—“বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, আমি যে কাজটা করিতে পারি, তুমি তাহা মুখে আনিতেও পার না? তোমার বিবেচনা করা উচিত ছিল, আমি যখন এ কাজটা করিতে যাইতেছি, তখন অবশ্য তাহার গুরুতর কারণ আছে; আমি অবশ্য ধর্ম্ম অধর্ম্ম সমস্তই ভাবিয়াছিলাম।”

 মন্ত্রী—“আজ্ঞা মহারাজ, আমি—”

 প্রতাপ—“চুপ কর, আমার সমস্ত কথাটা শোন আগে। আমি যখন এ কাজটা—আমি যখন নিজের পিতৃব্যকে খুন করিতে উদ্যত হইয়াছি, তখন অবশ্য তোমার চেয়ে ঢের বেশি ভাবিয়াছি। এ কাজে অধর্ম্ম নাই। আমার ব্রত এই—এই যে ম্লেচ্ছেরা আমাদের দেশে আসিয়া অনাচার আরম্ভ করিয়াছে, যাহাদের অত্যাচারে আমাদের দেশ হইতে সনাতন আর্য্য ধর্ম্ম লোপ পাইবার উপক্রম হইয়াছে, ক্ষত্রিয়েরা মোগলকে কন্যা দিতেছে, হিন্দুরা আচারভ্রষ্ট হইতেছে, এই ম্লেচ্ছদের আমি দূর করিয়া দিব, আমাদের আর্য্য-ধর্ম্মকে রাহুর গ্রাস হইতে মুক্ত করিব। এই ব্রত সাধন করিতে অনেক বলের আবশ্যক। আমি চাই, সমস্ত বঙ্গদেশের রাজারা আমার অধীনে এক হয়। যাহারা যবনের মিত্র, তাহাদের বিনাশ না করিলে ইহা সিদ্ধ হইবে না। পিতৃব্য বসন্তরায় আমার পূজ্যপাদ, কিন্তু যথার্থ কথা বলিতে পাপ নাই, তিনি আমাদের বংশের কলঙ্ক। তিনি আপনাকে ম্লেচ্ছের দাস বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন, এমন লোকের সহিত প্রতাপাদিত্য রায়ের কোন সম্পর্ক নাই। ক্ষত হইলে নিজের বাহুকে কাটিয়া ফেলা যায়; আমার ইচ্ছা যায় বংশের ক্ষত, বঙ্গদেশের ক্ষত ঐ বসন্ত রায়কে কাটিয়া ফেলিয়া রায়বংশকে বাচাই, বঙ্গদেশকে বাঁচাই।”

 মন্ত্রী কহিলেন “এ বিষয়ে মহারাজের সহিত আমার অন্য মত ছিল না।”

 প্রতাপাদিত্য কহিলেন—“হাঁ ছিল। ঠিক কথা বল। এখনাে আছে। দেখ মন্ত্রী, যতক্ষণ আমার মতের সহিত তােমার মত না মিলিবে, ততক্ষণ তাহা প্রকাশ করিও। সে সাহস যদি না থাকে তবে এ পদ তােমার নহে। সন্দেহ থাকে ত বলিও। আমাকে বুঝাইবার অবসর দিও। তুমি মনে করিতেছ নিজের পিতৃব্যকে হনন করা সকল সময়েই পাপ। ‘না’ বলিও না, ঠিক এই কথাই তােমার মনে জাগিতেছে। ইহার উত্তর আছে। পিতার অনুরােধে ভৃগু নিজের মাতাকে বধ করিয়াছিলেন, ধর্ম্মের অনুরােধে আমি আমার পিতৃব্যকে বধ করিতে পারি না?”

 এ বিষয়ে — অর্থাৎ ধর্ম্ম অধর্ম্ম বিষয়ে যথার্থই মন্ত্রীর কোন মতামত ছিল না। মন্ত্রী যতদূর তলাইয়াছিলেন, রাজা ততদূর তলাইতে পারেন নাই। মন্ত্রী বিলক্ষণ জানিতেন যে, উপস্থিত বিষয়ে তিনি যদি সঙ্কোচ দেখান, তাহা হইলে রাজা আপাতত কিছু রুষ্ট হইবেন বটে, কিন্তু পরিণামে তাহার জন্য মনে মনে সন্তুষ্ট হইবেন। এইরূপ না করিলে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এককালে-না-এককালে রাজার সন্দেহ ও আশঙ্কা জন্মিতে পারে।

 মন্ত্রী কহিলেন “আমি বলিতেছিলাম কি, দিল্লীশ্বর এ সংবাদ শুনিয়া নিশ্চয়ই রুষ্ট হইবেন।”

 প্রতাপাদিত্য জ্বলিয়া উঠিলেন “হঁ হাঁ রুষ্ট হইবেন! রুষ্ট হইবার অধিকার ত সকলেরই আছে। দিল্লীশ্বর ত আমার ঈশ্বর নহেন। তিনি রুষ্ট হইলে থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকিবে এমন জীব যথেষ্ট আছে, মানসিংহ আছে, বীরবল আছে, আমাদের বসন্ত রায় আছেন, আর সম্প্রতি দেখিতেছি তুমিও আছ; কিন্তু আত্মবৎ সকলকে মনে করিও না।”

 মন্ত্রী হাসিয়া কহিলেন “আজ্ঞা, মহারাজ ফাঁকা রােষকে আমিও বড় একটা ডরাই না, কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঢাল তলােয়ার যদি থাকে তাহা হইলে ভাবিতে হয় বৈ কি! দিল্লীশ্বরের রােষের অর্থ পঞ্চাশ সহস্র সৈন্য।”

 প্রতাপাদিত্য ইহার একটা সদুত্তর না দিতে পারিয়া কহিলেন “দেখ মন্ত্রী, দিল্লীশ্বরের ভয় দেখাইয়া আমাকে কোন কাজ হইতে নিরস্ত করিতে চেষ্টা করিও না, তাহাতে আমার নিতান্ত অপমান বােধ হয়।”

 মন্ত্রী কহিলেন “প্রজারা জানিতে পারিলে কি বলিবে?”

 প্রতাপ—“জানিতে পারিলে ত?”

 মন্ত্রী—এ কাজ অধিক দিন ছাপা রহিবে না।”

 “এ সংবাদ রাষ্ট্র হইলে সমস্ত বঙ্গদেশ আপনার বিরােধী হইবে। যে উদ্দেশ্যে এই কাজ করিতে চান, তাহা সমূলে বিনাশ পাইবে। আপনাকে জাতিচ্যুত করিবে ও বিবিধ নিগ্রহ সহিতে হইবে।”

 প্রতাপ—“দেখ, মন্ত্রী, আবার তােমাকে বলিতেছি, আমি যাহা করি, তাহা বিশেষ ভাবিয়া করি। অতএব আমি কাজে প্রবৃত্ত হইলে মিছামিছি কতকগুলা ভয় দেখাইয়া আমাকে নিরস্ত করিতে চেষ্টা করিও না। আমি শিশু নহি। প্রতিপদে আমাকে বাধা দিবার জন্য, তােমাকে আমার নিজের শৃঙ্খলস্বরূপে রাখি নাই।”

 মন্ত্রী চুপ করিয়া গেলেন। তাঁহার প্রতি রাজার দুইটি আদেশ ছিল। এক, যতক্ষণ মতের অমিল হইবে ততক্ষণ প্রকাশ করিবে, দ্বিতীয়তঃ বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করিয়া রাজাকে কোন কাজ হইতে নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিবে না। মন্ত্রী আজ পর্য্যন্ত এই দুই আদেশের ভালরূপ সামঞ্জস্য করিতে পারেন নাই।

 মন্ত্রী কিয়ৎক্ষণ পরে আবার কহিলেন “মহারাজ, দিল্লীশ্বর”—! প্রতাপ আদিত্য জ্বলিয়া উঠিয়া কহিলেন,—“আবার দিল্লীশ্বর? মন্ত্রী, দিনের মধ্যে তুমি যতবার দিল্লীশ্বরের নাম কর ততবার যদি জগদীশ্বরের নাম করিতে তাহা হইলে পরকালের কাজ গুছাইতে পারিতে। যতক্ষণে না আমার এই কাজটা শেষ হইবে, ততক্ষণ দিল্লীশ্বরের নাম মুখে আনিও না। যখন আজ বিকালে এই কাজ সমাধার সংবাদ পাইব, তখন আসিয়া আমার কানের কাছে তুমি মনের সাধ মিটাইয়া দিল্লীশ্বরের নাম জপিও! ততক্ষণ একটু আত্মসংযম করিয়া থাক!”

 মন্ত্রী আবার চুপ করিয়া গেলেন। দিল্লীশ্বরের কথা বন্ধ করিয়া কহিলেন—“মহারাজ, যুবরাজ উদয়াদিত্য—”

 রাজা কহিলেন—“দিল্লীশ্বর গেল, প্রজারা গেল; এখন অবশেষে সেই স্ত্রৈণ বালকটার কথা বলিয়া ভয় দেখাইবে না কি?”

 মন্ত্রী কহিলেন “মহারাজ, আপনি অত্যন্ত ভুল বুঝিতেছেন। আপনার কাজে বাধা দিবার অভিপ্রায় আমার মূলেই নাই।”

 প্রতাপাদিত্য ঠাণ্ডা হইয়া কহিলেন “তবে কি বলিতেছিলে বল!”

 মন্ত্রী বলিলেন “কাল রাত্রে যুবরাজ সহসা অশ্বারােহণ করিয়া একাকী চলিয়া গিয়াছেন, এখনাে ফিরিয়া আসেন নাই।”

 প্রতাপাদিত্য বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “কোন দিকে গেছেন?”

 মন্ত্রী কহিলেন “পূর্ব্বাভিমুখে।”

 প্রতাপাদিত্য দাঁতে দাঁত লাগাইয়া কহিলেন “কখন গিয়াছিল?”

 মন্ত্রী—“কাল প্রায় অর্দ্ধরাত্রের সময়।”

 প্রতাপাদিত্য কহিলেন “শ্রীপুরের জমীদারের মেয়ে কি এখানেই আছে?”

 মন্ত্রী—“আজ্ঞা হাঁ!”

 প্রতাপাদিত্য—“সে তাহার পিত্রালয়ে থাকিলেই ত ভাল হয়।”

 মন্ত্রী কোন উত্তর দিলেন না।

 প্রতাপাদিত্য কহিলেন “উদয়াদিত্য কোন কালেই রাজার মত ছিল না। ছেলেবেলা হইতে প্রজাদের সঙ্গেই তাহার মেশামেশি। আমার সন্তান যে এমন হইবে তাহা কে জানিত? সিংহ-শাবককে কি, কিকরিয়া সিংহ হইতে হয়, তাহা শিখাইতে হয়? তবে কিনা, নরাণাং মাতুলক্রমঃ। বােধ করি সে তাহার মাতামহদের স্বভাব পাইয়াছে। তাহার উপরে আবার সম্প্রতি শ্রীপুরের ঘরে বিবাহ দিয়াছি; সেই অবধি বালকটা একেবারে অধঃপাতে গিয়াছে। ঈশ্বর করুন, আমার কনিষ্ঠ পুত্রটি যেন উপযুক্ত হয়, আমি যাহা আরম্ভ করিয়াছি তাহা শেষ যদি না করিতে পারি তাহা হইলে মরিবার সময়ে ভাবনা না থাকিয়া যায় যেন! সে কি তবে এখনও ফিরিয়া আসে নাই?”

 মন্ত্রী—“না মহারাজ!”

 ভূমিতে পদাঘাত করিয়া প্রতাপাদিত্য কহিলেন একজন প্রহরী তাহার সঙ্গে কেন যায় নাই?”

 মন্ত্রী—“একজন যাইতে প্রস্তুত হইয়াছিল, কিন্তু তিনি বারণ করিয়াছিলেন।”

 প্রতাপ—“অদৃশ্যভাবে, দূরে দূরে থাকিয়া কেন যায় নাই?”

 মন্ত্রী—“তাহারা কোন প্রকার অন্যায় সন্দেহ করে নাই।”

 প্রতাপ—“সন্দেহ করে নাই। মন্ত্রী, তুমি কি আমাকে বুঝাইতে চাও, তাহারা বড় ভাল কাজ করিয়াছিল? মন্ত্রী, তুমি আমাকে অনর্থক যাহা-তাহা একটা বুঝাইতে চেষ্টা পাইও না। প্রহরীরা কর্ত্তব্য কাজে বিশেষ অবহেলা করিয়াছে। সে সময়ে দ্বারে কাহারা ছিল ডাকিয়া পাঠাও। এই ঘটনাটির জন্য যদি আমার কোন একটা ইচ্ছা বিফল হয়, তবে আমি সর্ব্বনাশ করিব। মন্ত্রী, তােমারও তাহা হইলে ভয়ের সম্ভাবনা আছে। আমার কাছে তুমি প্রমাণ করিতে আসিয়াছ, এ কাজের জন্য কেহই দায়ী নহে! তবে এ দায় তােমার!”

 প্রতাপাদিত্য প্রহরীদিগকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। কিয়ৎক্ষণ গম্ভীরভাবে থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “হাঁ। দিল্লীশ্বরের কথা কি বলিতেছিলে?”

 মন্ত্রী—“শুনিলাম আপনার নামে দিল্লীশ্বরের নিকট অভিযােগ, করিয়াছে।”

 প্রতাপ—“কে? তােমাদের যুবরাজ উদয়াদিত্য না কি?”

 মন্ত্রী—“আজ্ঞা, মহারাজ, এমন কথা বলিবেন না। কে করিয়াছে। সন্ধান পাই নাই।”

 প্রতাপ—“যেই করুক, তাহার জন্য অধিক ভাবিও না, আমিই দিল্লীশ্বরের বিচারকর্ত্তা, আমিই তাহার দণ্ডের উদ্যোগ করিতেছি। সে পাঠানেরা এখনও ফিরিল না? উদয়াদিত্য এখনো আসিল না? শীঘ্র প্রহরীকে ডাক।”