বৌ-ঠাকুরাণীর হাট/পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ।

 উদয়াদিত্যকে যেখানে রুদ্ধ করা হইয়াছে, তাহা প্রকৃত কারাগার নহে। তাহা প্রাসাদসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র অট্টালিকা। বাটির ঠিক ডানপাশেই এক রাজপথ, ও তাহার পূর্ব্বদিকে প্রশস্ত এক প্রাচীর আছে, তাহার উপর প্রহরীরা পায়চারি করিয়া পাহারা দিতেছে। ঘরেতে একটি অতি ক্ষুদ্র জানালা কাটা। তাহার মধ্যদিয়া খানিকটা আকাশ, একটা বাঁশঝাড় ও একটি শিবমন্দির দেখা যায়। উদয়াদিত্য প্রথম যখন কারাগারে প্রবেশ করিলেন, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। জানালার কাছে মুখ রাখিয়া ভূমিতে গিয়া বসিলেন। বর্ষাকাল। আকাশে মেঘ জমিয়া আছে। রাস্তায় জল দাঁড়াইয়াছে। নিস্তব্ধ রাত্রে দৈবাৎ দুই একজন পথিক চলিতেছে, ছপ্‌ছপ্‌ করিয়া তাহাদের পায়ের শব্দ হইতেছে। পূর্ব্বদিক হইতে, কারাগারের হৃৎ-স্পন্দন ধ্বনির মত প্রহরীদের পদশব্দ অনবরত কানে আসিতেছে। এক এক প্রহর অতীত হইতে লাগিল, দুর হইতে এক একটা হাঁক শুনা যাইতেছে। আকাশে একটি মাত্র তারা নাই, যে বাঁশঝাড়ের দিকে উদয়াদিত্য চাহিয়া আছেন, তাহা জোনাকীতে একেবারে ছাইয়া ফেলিয়াছে। সে রাত্রে উদয়াদিত্য আর শয়ন করিলেন না, জানলার কাছে বসিয়া প্রহরীদের অবিরাম পদশব্দ শুনিতে লাগিলেন।

 বিভা আজ সন্ধ্যাবেলায় একবার অন্তঃপুরের বাগানে গিয়াছে। প্রাসাদে, বােধ করি অনেক লােক। চারিদিকে দাস দাসী, চারিদিকেই পিসি মাসী, কথায় কথায় “কি হইয়াছে, কি বৃত্তান্ত” জিজ্ঞাসা করে, প্রতি অশ্রুবিন্দুর হিসাব দিতে হয়, প্রতি দীর্ঘ নিশ্বাসের বিস্তৃত ভাষ্য ও সমালােচনা বাহির হইতে থাকে। বিভা বুঝি আর পারে নাই, ছুটিয়া বাগানে আসিয়াছে। সূর্য্য আজ মেঘের মধ্যেই উঠিয়াছে, মেঘের মধ্যেই অস্ত গেল। কখন যে দিনের অবসান হইল, ও সন্ধ্যার আরম্ভ হইল বুঝা গেল না। বিকালের দিকে পশ্চিমের মুখে একটুখানি সােনার রেখা ফুঠিয়াছিল, কিন্তু দিন শেষ হতে না হইতেই মিলাইয়া গেল। আঁধারের উপর আঁধার ঘনাইতে লাগিল। দিগন্ত হইতে দিগন্ত আচ্ছন্ন হইয়া গেল। ঘন-শ্রেণী ঝাউগাছগুলির মাথার উপর অন্ধকার এমনি করিয়া জমিয়া আসিল যে, তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটা ব্যবধান আর দেখা গেল না, ঠিক মনে হইতে লাগিল যেন সহস্র দীর্ঘ পায়ের উপর ভর দিয়া একটা প্রকাণ্ড বিস্তৃত নিস্তব্ধ অন্ধকার দাঁড়াইয়া আছে। রাত হইতে লাগিল, রাজবাড়ির প্রদীপ একে একে নিবিয়া গেল। বিভা ঝাউগাছের তলায় বসিয়া আছে। বিভা স্বভাবতই ভীরু, কিন্তু আজ তাহার ভয় নাই। কেবল, যতই আঁধার বাড়িতেছে, ততই তাহার মনে হইতেছে যেন পৃথিবীকে কে তাহার কাছ হইতে কাড়িয়া লইতেছে; যেন সুখ হইতে, শান্তি হইতে জগৎ সংসারের উপকূল হইতে কে তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়াছে; অতলস্পর্শ অন্ধকারের সমুদ্রের মধ্যে সে পড়িয়া গিয়াছে; ক্রমেই ডুবিতেছে, ক্রমেই নামিতেছে, মাথার উপরে অন্ধকার ক্রমেই বাড়িতেছে, পদতলে ভূমি নাই, চারিদিকে কিছুই নাই, আশ্রয়, উপকূল, জগৎ-সংসার ক্রমেই দূর হইতে দূরে চলিয়া যাইতেছে। তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন, একটু একটু করিয়া তাহার সম্মুখে একটা প্রকাণ্ড ব্যবধান আকাশের দিকে উঠিতেছে। তাহার ওপারে কত কি পড়িয়া রহিল। প্রাণ যেন আকুল হইয়া উঠিল। যেন ওপারের সকলি দেখা যাইতেছে; সেখানকার সূর্য্যালােক, খেলাধূলা, উৎসব সকলি দেখা যাইতেছে; কে যেন নিষ্ঠুর ভাবে, কঠোর হস্তে তাহাকে ধরিয়া রাখিয়াছে, তাহার কাছে বুকের শিরা টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেও সে যেন সে দিকে যাইতে দিবে না। বিভা যেন আজ দিব্য চক্ষু পাইয়াছে; এই চরাচরব্যাপী ঘন ঘাের অন্ধকারের উপর বিধাতা যেন বিভার ভবিষ্যৎ অদৃষ্ট লিখিয়া দিয়াছেন, অনন্ত জগৎসংসারে একাকী বসিয়া বিভা যেন তাহাই পাঠ করিতেছে; তাই তাহার চক্ষে জল নাই, দেহ নিস্পন্দ, নেত্র নির্ণিমেষ। রাত্রি দুই প্রহরের পর একটা বাতাস উঠিল; অন্ধকারে গাছপালাগুলা হা হা করিয়া উঠিল। বাতাস অতিদূরে হূ—হূ করিয়া শিশুর কণ্ঠে কাঁদিতে লাগিল। বিভার মনে হইতে লাগিল যেন দূর—দূর-দূরান্তরে সমুদ্রের তীরে বসিয়া বিভার সাধের, স্নেহের, প্রেমের শিশুগুলি দুই হাত বাড়াইয়া কাঁদিতেছে, আকুল হইয়া তাহারা বিভাকে ডাকিতেছে, তাহারা কোলে আসিতে চায়, সম্মুখে তাহারা পথ দেখিতে পাইতেছে না; যেন তাহাদের ক্রন্দন এই শত যােজন, লক্ষ যােজন গাঢ় স্তব্ধ অন্ধকার ভেদ করিয়া বিভার কানে আসিয়া পৌঁছিল। বিভার প্রাণ যেন কাতর হইয়া কহিল, “কেরে, তােরা কে, তােরা কে কাঁদিতেছিস্, তােরা কোথায়!” বিভা মনে মনে যেন এই লক্ষ যােজন অন্ধকারের পথে একাকিনী যাত্রা করিল। সহস্র বৎসর ধরিয়া যেন অবিশ্রান্ত ভ্রমণ করিল, পথ শেষ হইল না, কাহাকেও দেখিতে পাইল না;—কেবল সেই বায়ুহীন, শব্দহীন দিনরাত্রিহীন, জনশূন্য তারাশূন্য দিক্‌দিগন্তশূন্য মহান্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া মাঝে মাঝে চারিদিক্‌ হইতে ক্রন্দন শুনিতে পাইল, কেবল বাতাস দূর হইতে করিতে লাগিল হূ—হূ!

 সমস্ত রাত্রি অনিদ্রায় কাটিয়া গেল। পর দিন বিভা কারাগারে উদয়াদিত্যের নিকট যাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিল, সেখানে তাহার যাওয়া নিষেধ। সমস্ত দিন ধরিয়া অনেক কাঁদাকাটি করিল। এমন কি স্বয়ং প্রতাপাদিত্যের কাছে গেল। বিভা তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিল। অনেক কষ্টে সম্মতি পাইল। পরদিন প্রভাত হইতে না হইতেই বিভা শয্যা হইতে উঠিয়া কারাগৃহে প্রবেশ করিল। গিয়া দেখিল, উদয়াদিত্য বিছানায় শােন নাই। ভূমিতলে বসিয়া, বাতায়নের উপরে মাথা দিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। দেখিয়া বিভার প্রাণ যেন বুক ফাটিয়া কাঁদিয়া উঠিতে চাহিল। অনেক কষ্টে রােদন সম্বরণ করিল। অতি ধীরে নিঃশব্দে উদয়াদিত্যের কাছে গিয়া বসিল। ক্রমে প্রভাত পরিষ্কার হইয়া আসিল। নিকটের বন হইতে পাখীরা গাহিয়া উঠিল। পাশের রাজপথ হইতে পান্থেরা গান গাহিয়া উঠিল। দুই একটি রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত প্রহরী আলো দেখিয়া মৃদুস্বরে গান গাহিতে লাগিল। নিকটস্থ মন্দির হইতে শাঁখ ঘণ্টার শব্দ উঠিল। উদয়াদিত্য সহসা চমকিয়া জাগিয়া উঠিলেন। বিভাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “একি বিভা, এত সকালে যে?” ঘরের চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন—“এ কি—আমি কোথায়?” মুহূর্ত্তের মধ্যে মনে পড়িল, তিনি কোথায়! বিভার দিকে চাহিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আঃ—বিভা, তুই আসিয়াছিস্? কাল তােকে সমস্ত দিন দেখি নাই, মনে হইয়াছিল, বুঝি তােদের আর দেখিতে পাইব না।”

 বিভা উদয়াদিত্যের কাছে আসিয়া চোখ মুছিয়া কহিল, “দাদা, মাটিতে বসিয়া কেন? খাটে বিছানা পাতা রহিয়াছে। দেখিয়া বােধ হইতেছে, একবারাে তুমি খাটে বস নাই। এ দুদিন কি তবে ভূমিতেই আসন করিয়াছ?” বলিয়া বিভা কাঁদিতে লাগিল।

 উদয়াদিত্য ধীরে ধীরে কহিলেন, “খাটে বসিলে আমি যে আকাশ দেখিতে পাই না বিভা! জানলার ভিতর দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া যখন পাখীদের উড়িতে দেখি, তখন মনে হয়, আমারাে একদিন খাঁচা ভাঙিবে, আমিও একদিন ঐ পাখীদের মত ঐ অনন্ত আকাশে প্রাণের সাধে সাঁতার দিয়া বেড়াইব। এ জানাল হইতে যখন সরিয়া যাই, তখন চারিদিকে অন্ধকার দেখি, তখন ভুলিয়া যাই যে, আমার একদিন মুক্তি হইবে, একদিন নিষ্কৃতি হইবে, মনে হয় না জীবনের বেড়ী একদিন ভাঙিয়া যাইবে, এ কারাগার হইতে একদিন খালাস পাইব। বিভা এ কারাগারের মধ্যে এই দুই হাত জমি আছে, যেখানে আসিলেই আমি জানিতে পারি যে, আমি স্বভাবতই স্বাধীন; কোন রাজা মহারাজা আমাকে বন্দী করিতে পারে না। আর ঐ খানে ঐ ঘরের মধ্যে ঐ কোমল শয্যা, খানেই আমার কারাগার।”

 আজ বিভাকে সহসা দেখিয়া উদয়াদিত্যের মনে অত্যন্ত আনন্দ হইল। বিভা যখন তাঁহার চক্ষে পড়িল, তখন তাঁহার কারাগারের সমুদায় দ্বার যেন মুক্ত হইয়া গেল। সে দিন তিনি বিভাকে কাছে বসাইয়া আনন্দে এত কথা বলিয়াছিলেন যে, কারা-প্রবেশের পূর্ব্বে বােধ করি এত কথা কখন বলেন নাই। বিভা উদয়াদিত্যের সে আনন্দ মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছিল। জানি না, এক প্রাণ হইতে আর এক প্রাণে কি করিয়া বার্ত্তা যায়, এক প্রাণে তরঙ্গ উঠিলে আর এক প্রাণে কি নিয়মে তরঙ্গ উঠে। বিভার হৃদয় পুলকে পূরিয়া উঠিল। তাহার অনেক দিনের উদ্দেশ্য আজ সফল হইল। বিভা সামান্য বালিকা, উদয়াদিত্যকে সে যে আনন্দ দিতে পারে অনেক দিনের পর ইহা সে সহসা আজ বুঝিতে পারিল। হৃদয়ে সে বল পাইল। এত দিন সে চারিদিকে অন্ধকার দেখিতেছিল, কোথাও কিনারা পাইতেছিল না, নিরাশার গুরুভারে একেবারে নত হইয়া পড়িয়াছিল। নিজের উপর তাহার বিশ্বাস ছিল না; অনবরত সে উদয়াদিত্যের কাজ করিত, কিন্তু বিশ্বাস করিতে পারিত না যে, তাঁহাকে সুখী করিতে পারিব। আজ সে সহসা একটা পথ দেখিতে পাইয়াছে, এতদিনকার সমস্ত শ্রান্তি একেবারে ভুলিয়া গেল। আজ তাহার চোখে প্রভাতের শিশিরের মত অশ্রুজল দেখা দিল, আজ তাহার অধরে অরুণ কিরণের নির্ম্মল হাসি ফুটিয়া উঠিল।

 বিভাও প্রায় কারাবাসিনী হইয়া উঠিল। গৃহের বাতায়নের মধ্য দিয়া যখনি প্রভাত প্রবেশ করিত, কারাদ্বার খুলিয়া গিয়া তখনি বিভার বিমল মূর্ত্তি দেখা দিত। বিভা বেতনভােগী ভৃত্যদের কিছুই করিতে দিত না, নিজের হাতে সমুদায় কাজ করিত, নিজে আহার আনিয়া দিত, নিজে শয্যা রচনা করিয়া দিত। একটি টিয়াপাখী আনিয়া ঘরে টাঙাইয়া দিল ও প্রতিদিন সকালে অন্তঃপুরের বাগান হইতে ফুল তুলিয়া আনিয়া দিত। ঘরে একখানি মহাভারত ছিল, উদয়াদিত্য বিভাকে কাছে বসাইয়া তাহাই পড়িয়া শুনাইতেন।

 কিন্তু উদয়াদিত্যের মনের ভিতরে একটি কষ্ট জাগিয়া আছে। তিনি ত ডুবিতেই বসিয়াছেন, তবে কেন এমন সময়ে এই অসম্পূর্ণ সুখ, অতৃপ্ত-আশা সুকুমার বিভাকে আশ্রয়স্বরূপে আলিঙ্গন করিয়া, তাহাকে পর্য্যন্ত ডুবাইতেছেন? প্রতিদিন মনে করেন, বিভাকে বলিবেন, “তুই যা বিভা!” কিন্তু বিভা যখন উষার বাতাস লইয়া উষার আলােক লইয়া তরুণী ঊষার হাত ধরিয়া কারার মধ্যে প্রবেশ করে, যখন সেই স্নেহের ধন সুকুমার মুখখানি লইয়া কাছে আসিয়া বসে, কত যত্ন কত আদরের দৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে একবার চাহিয়া দেখে, কত মিষ্ট স্বরে কত কথা জিজ্ঞাসা করে, তখন তিনি আর কোন মতেই প্রাণ ধরিয়া বলিতে পারেন না, “বিভা, তুই যা, তুই আর আসিস্ না,তােকে আর দেখিব না।” প্রত্যহ মনে করেন, কাল বলিব; কিন্তু সে কাল আর কিছুতেই আসিতে চায় না! অবশেষে একদিন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলেন। বিভা আসিল, বিভাকে বলিলেন, “বিভা, তুই আর এখানে থাকিস্‌নে। তুই না গেলে আমি কিছুতেই শান্তি পাইতেছি না। প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় এই কারাগৃহের অন্ধকারে কে আসিয়া আমাকে যেন বলে, বিভার বিপদ কাছে আসিতেছে। বিভা, আমার কাছ হইতে তােরা শীঘ্র পালাইয়া যা! আমি শনিগ্রহ, আমার দেখা পাইলেই চারিদিক্ হইতে দেশের বিপদ ছুটিয়া আসে। তুই শ্বশুর বাড়ি যা। মাঝে মাঝে যদি সংবাদ পাই, তাহা হইলেই আমি সুখে থাকিব।”

 বিভা চুপ করিয়া রহিল।

 উদয়াদিত্য মুখ নত করিয়া বিভার সেই মুখখানি অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার দুই চক্ষু দিয়া ঝরঝর করিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল। উদয়াদিত্য বুঝিলেন, “আমি কারাগার হইতে না মুক্ত হইলে বিভা কিছুতেই আমাকে ছাড়িয়া যাইবে না, কি করিয়া মুক্ত হইতে পারিব!”