ভগ্নহৃদয়/অষ্টাদশ সর্গ

অষ্টাদশ সর্গ।

ললিতা।

আদর করিয়া কেন না পাই আদর?
লজ্জা নাই কিছু নাই—না ডাকিতে কাছে যাই
সঙ্কোচে চরণ যেন করে থর থর,
ধীরে ধীরে এক পাশে বসি পদতলে,
বড় মনে সাধ যায়—মুখ খানি তুলে চায়
বারেক হাসিয়া কাছে বসিবারে বলে!
বড় সাধ কাছে গিয়ে, মুখ খানি তুলে নিয়ে
চাপিয়া ধরিগো এই বুকের মাঝার,
মুখ পানে চেয়ে চেয়ে কাঁদি একবার!
সে কেন বারেক চেয়ে কথাও না কয়,
পাষাণে গঠিত যেন, স্থির হোয়ে রয়!
যেনরে ললিতা তার কেহ নয়—কেহ নয়—
দাসীর দাসীও নয়—পথের পথিকো নয়!
যেন একেবারে কেহ—কেহ নাই কাছে,
ভাবনা লইয়া তার একেলা সে আছে!
কি যেন দেখিছে ছবি আকাশের পটে,
মুহূর্ত্তের তরে যেন—মনে মনে ভাবে হেন
“ললিতা এসেছে বুঝি, বোসেছে নিকটে,
সে এমন মাঝে মাঝে এসে থাকে বটে!”

মাঝে মাঝে আসে বটে, পারে না যে নাথ,
সখাগো নিতান্ত তাই কথাটি শুধাতে নাই?
বারেক করিতে নাই স্নেহনেত্র পাত?
নিতান্তই পদতলে পোড়ে থাকে বটে!
সখা তাই কিগো তারে তুলিয়া উঠাবে না রে,
বারেক রাখিবে নাকি বুকের নিকটে!
লতা আজ লুটাইয়া আছে পদমুলে,
মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে—আপনারে ভুলে—
প্রাণপণে ভালবেসে জড়ায়ে জড়ায়ে শেষে
একদিন উঠিবে সে বুকে মাথা তুলে;
শাখাটি বাঁধিতে দিবে আলিঙ্গনে তার;
দুখিনীর সে আশা কি বড় অহঙ্কার?
কি কোরেছি অপরাধ বুঝিতে না পারি,
দিন রাত্রি সখা আমি রোয়েছি তোমারি;
কিসে তুমি ভাল রবে, কিসে তুমি সুখী হবে,
দিন রাত সে ভাবনা জাগিছে অন্তরে;
মুহূর্ত ভাবিনা আমি আপনার তরে।
তারি বিনিময়ে কিগো এত অনাদর!
শতখানা ফেটে যায় বুকের ভিতর।
সখা আমি অভিমান কভু করি নাই,
মনে করিতেও তাহা লাজে মরে যাই।
ধীরে ধীরে এসে কাছে মনে মনে হাস’ পাছে
“দুখিনী ললিতা সেও অভিমান করিয়াছে!”
তাই অভিমান কভু মনেও না ভার,

অশ্রু জল হেরে পাছে হাসি তব পায়!
বুকে বড় ব্যথা বাজে, তাই ভাবি মাঝে মাঝে
ভিক্ষুকের মত গিয়া পড়ি তব পায়;—
কেঁদে গিয়ে ভিক্ষা করি করিয়া বিনয়—
“সর্বস্ব দিয়েছি ওগো—পরাণ হৃদয়—
হৃদয় দিয়েছি বোলে হৃদয় চাহিনা ভুলে,
একটু ভালবাসিও—আর কিছু নয়।”
পাছেগো চাহিলে ভিক্ষা ধরিলে চরণে
বিরক্ত বা হও তাই ভয় করি মনে।
তবেগো কি হবে মোর? জানাব’ কি কোরে?
এমন ক’দিন আর রব’ প্রাণ ধোরে?
হা দেবি! হা ভগবতি! জীবন দুর্ভর অতি;
কিছুতে কি পাবনাক’ ভালবাসা তাঁর?
তবে নে মা—কোলে নে মা’—কোথাও আশ্রয় দে মা
একটু স্নেহের ঠাঁই দেখা, মা আমার!

চপলার প্রবেশ।


চপলা।—ললিতাও হলি নাকি মুরলার মত! 
তেমনি বিষাদময় আঁখি দুটি নত।
তেমনি মলিন মুখে আছিস্ কিসের দুখে,
তোদের একি এ হ’ল ভাবিলো কেবল,
চপলারে তোরা বুঝি করিবি পাগল!
ছেলেবেলা বেশ ছিলি ছিলনা ত জ্বালা,
সদা মৃদুহাস্যময়ী লাজময়ী বালা।

একদিন—মনে পড়ে?—সরসীর তীরে,
ব’সেছিলি নিরিবিলি, কেবল দেখিতেছিলি
নিজের মুখের ছায়া প’ড়েছিল নীরে।
বুঝি মেতে গিয়েছিলি রূপে আপনার!
(তোর মত গরবিনী দেখিনি ত আর!)
সহসা পিছন হ’তে ডাকিলাম তোরে,
কি দারুণ সরমেতে গিয়েছিলি মোরে?
আজ তোর হ’ল কিলো ললিতা আমার?
সে সব লাজের ভাব নাই যেনো আর!
শুধু বিষাদের হাসি, মুরলার মত!
বল্ তোরা হলি একি? পৃথিবীর মাঝে দেখি
কেবল চপলা সুখী, দুঃখী আর যত!
মোরে কিছু বলবিনে?—আহা ম’রে যাই!—
অনিল সে কত ক’রে, আদর করে যে তোরে,
লুকায়ে লুকায়ে আমি যেন দেখি নাই!
ভাল, ভাল, বলিস্‌নে, আমার কি তায়?
চল্ তুই, ললিতা লো, মুরলা যেথায়!
যাহা তোর মনে আছে কহিস্ তাহারি কাছে,
তাহ’লে ঘুচিয়া যাবে হৃদয়ের ভার।
ত্বরা করে চল্‌ তবে, ললিতা আমার!

কবির প্রবেশ।


চপলা।—(কবির প্রতি)— 

চল কবি মুরলার কাছে,
বড় সে মনের দুঃখে আছে!

তুমি, কবি, তারে দেখো, সদা কাছে কাছে রেখো,
তুমি তারে ভাল ক’রে করিও যতন,
তুমি ছাড়া কে তাহার আছে বা স্বজন!
কবি।—মুরলার মুখ দেখে প্রাণে বড় বাজে, 
কিসের যে দুঃখ তার শুধায়েছি কতবার
কিছুতে আমার কাছে প্রকাশে না লাজে!
কত দিন হ’তে মোরা বাঁধা এক ডোরে,
যাহা কিছু থাকে কথা, যাহা কিছু পাই ব্যথা,
দুজনে তখনি তাহা বলি দুজনেরে।
কিছু দিন হ’তে একি হ’ল মুরলার!
আমারে মনের কথা বলে না সে আর;
মাঝে মাঝে ভাবি তাই, বড় মনে ব্যথা পাই,
বুঝি মোর পরে নাই প্রণয় তাহার!
এত কথা বলি তারে এত ভালবাসি,
সে কেন আমারে কিছু কহেনা প্রকাশি?