ঊনবিংশ সর্গ।

অনিল।

উঁহু, কি না করিলাম হৃদয়ের সাথ!
ঘোর উন্মত্তের মত সবলে যুঝিনু কত,
অশান্তির বিপ্লাবনে গেছে দিন রাত!
নিশীথে গিয়েছি ছুটে দারুণ অধীর,
নয়নেতে নিদ্রা নাই—চোখে না দেখিতে পাই
হাহা কোরে ভ্রমিয়াছি বিপাশার তীর!
কোরেছে দারুণ ঝড় বজ্রদন্ত কড়মড়,
চারিদিকে অন্ধকার সম্মুখে পশ্চাতে;
মাথার উপরে চাই একটিও তারা নাই,
সৃষ্টি যেন ঠাঁই নাহি পেতেছে দাঁড়াতে!
সাধ গেছে, ঝটিকার রুদ্রদেব গণ
বিশাল চরণ দিয়া দলি যায় এই হিয়া—
নিষ্পেষিত করি ফেলে কীটের মতন।
চূর্ণ হোয়ে একেবারে মিশে ধূলিরাশে,
উড়ে পড়ে চারিদিকে বাতাসে বাতাসে!
অশান্তির এক উপদেবহার মত
নিজের হৃদয় সাথে যুঝিয়াছি কত!
করি অশ্রুবারি পাত গেছে চলি দিনরাত

অবশেষে আপনি হলেম পরাভূত!
ইচ্ছা করে ছিঁড়ি ছিঁড়ি হৃদয় আমার
শকুনী গৃধিনীদের যোগাই আহার!
এহেন অসার, দীন, হৃদি অতি বলহীন,
যোগ্য শুধু শিশুর খেলেনা গড়িবার!
এ হৃদি কি বলবান পুরুষের মন—
সামান্য বহিলে বায়, সঘনে কাঁপিবে কায়
মাটিতে নোয়াবে মাথা লতার মতন!
কেন ধরা, কেন ওরে! জন্ম দিয়েছিলি মোরে?
এমন অসার লঘু দুর্ব্বল এ প্রাণ?
এখনি গো দ্বিধা হও, লও মোরে কোলে লও!
এ হীন জীবন-শিখা করগো নির্ব্বাণ!
আর একবার দেখি, যদি এ হৃদয়
পারি আমি বজ্রবলে করিবারে জয়!
কিন্তু হায় কে আমরা? ভাগ্যের খেলেনা,
প্রচণ্ড অদৃষ্ট স্রোতে ক্ষুদ্র তৃণ কণা!
অন্তরে দুর্দান্ত হৃদি পড়িছে উঠিছে,
বাহিরে চৌদিক হোতে ঝটিকা ছুটিছে;
যা কিছু ধরিতে চাই কিছুই খুঁজে না পাই,
স্রোতোমুখে ছুটিয়াছি বিদ্যুতের মত
দিগ্বিদিক হারাইয়া হোয়ে জ্ঞান হত।
চোখে না দেখিতে পাই, কানে না শুনিতে পাই,
তীব্রবেগে বহে বায়ু বধিরি শ্রবণ,
চারিদিকে টলমল—তরঙ্গের কোলাহল,

আকাশে ছুটিছে তারা উল্কার মতন;
ঘুরিতে ঘুরিতে শেষে পড়িগো আবর্ত্তে এসে,
চৌদিকে ফেনায়ে উঠে উর্ম্মির পর্ব্বত;
মস্তক ঘুরিয়া উঠে, সঘনে শোণিত ছুটে,
ঘুরিতে ঘুরিতে যাই—কোথায় ভেবে না পাই—
তলায়ে তলায়ে যাই পাতালের পথ;
আঁধারে দেখিতে নারি এনু কোন্ ঠাঁই—
ঊর্দ্ধে হাত তুলি কিছু ধরিতে না পাই—
ঘুরি ঘুরি রাত্রি দিন হোয়ে পড়ি জ্ঞান হীন,
নিম্নে কে চরণ ধরি করে আকর্ষণ!
কোথায় দাঁড়াব গিয়ে কে জানে তখন!
তবে আর কি করিব! যাই—যাই ভেসে—
পাষাণ বজ্রের মত অদৃষ্টের মুষ্টি শত
হৃদয়েরে আকর্ষিছে ধরি তার কেশে!
কি করিতে পারি বল আমি ক্ষুদ্র নর
অদৃষ্টের সাথে কভু সাজে কি সমর?
দিন রাত্রি তুষানলে মরি তবে জ্বোলে জ্বোলে,
হাসুক সমস্ত ধরা তীব্র ঘৃণা-হাসি,
সে মোরে করুক্ ঘৃণা যারে ভাল বাসি!
আপনার কাছে সদা হোয়ে থাকি দোষী,
হৃদয়ে ঘনাতে থাক্ কলঙ্কের মসী!
যার ভালবাসা তরে আকুল হৃদয়—
যার লাগি সহি জ্বালা তীব্র অতিশয়—
তারে ভালবাসি বোলে, তারি লাগি কাঁদি বোলে,

তারি লাগি সহি বোলে এতেক যাতনা—
সেই মোরে ঘৃণা কোরে ভাল বাসিবেনা!
তাই হোক্—তাই হোক্—ভাগ্য, তাই হোক্,
অভাগার কাছ হোতে সবে দুরে রোক্!
যাই যাই ভেসে যাই—যা হবার হবে তাই—
কে আছে আমার তরে করিবারে শোক?

ললিতার প্রবেশ।


এই যে, এই যে হেথা, ললিতা আমার,
আয়, আয়, মুখখানি দেখি একবার!
আসিবি কি ফিরে যাবি, তাই যেন ভাবি ভাবি
অতি ধীর মৃদুগতি সঙ্কোচে তোমার,—
আয় বুকে ছুটে আয় ভাবিস্‌নে আর!
কেনলো ললিতা রাণি, বিষণ্ন ও মুখখানি?
কেনলো অধরে নাই হাসির আভাস?
নয়ন এ মুখে কেন চাহিতে চাহেনা যেন,
কি কথা রোয়েছে মনে, বলিতে না চাস্!
অপরাধ কোরেছি কি প্রেয়সী আমার?
বল্‌লো কি শাস্তি মোরে দিতে চাস্ তার!
যা’ দিবি তাহাই সব,’ মাথায় পাতিয়া লব,’
তাহে যদি প্রায়শ্চিত্ত হয়লো তাহার!
সজনি, জানিস্ হা রে ভাল তু বাসিস্ যারে
মন তার অতি নীচ, অতি অন্ধকার!
অপরাধ করিবে সে, আশ্চর্য্য কি তার?

সখিলো, মার্জ্জনা তুই করিস্‌নে তারে,
চিরকাল ঘৃণা কর হৃদয় মাঝারে;
সখি, তুই কেন ভাল বাসিলি আমায়?
তাই ভেবে দিবানিশি মরি যাতনায়;
কেন সখি, দুজনের দেখা হোল আমাদের,
দারুণ মিলন হেন কেন হোল হায়?
জানি যে রে এ হৃদয়, দারুণ কলঙ্কময়!
কি বোলে দিব এ হৃদি চরণে তোমার!
চরণে ফেললো দলি হেন উপহার!
সতত সরমে বিঁধি লুকাতে চাহি এ হৃদি,
এ হৃদে বাসিলে ভাল মরে যাই লাজে,
হেন নীচ হৃদয়েরে ভাল বাসা সাজে!
ভাল আমি বাসি তোরে—চিরকাল বাসিবরে,
তবু চাহিনাকো আমি তোর ভালবাসা,
লোয়ে তোর নিজ মন সুখে থাক্ অনুক্ষণ,
হেন নীচ হৃদয়ের রাখিস্‌নে আশা!
বল্‌লো কিসের ব্যথা পেয়েছিস মনে?
থাক্‌, থাক্‌, কাজ নেই—থাক্‌ তা গোপনে—
হোয়েছেত যা হবার বোলে তা কি হবে আর!
হয় ত আমিই কিছু করিয়াছি দোষ!
কাজ কি সে কথা তুলে, সে সব যা’ না লো ভুলে,
একবার কাছে আয় এই খেনে বোস্‌।
আধেক অধর-ভরা দেখি সেই হাসি,
ঢাল্‌লো তৃষিত নেত্রে সুধা রাশি রাশি,

সখি মুখ তুলে চা’লো একটি কথা ক’ না লো!
ললিতা রে, মৌন হয়ে থাকিস্‌নে আর,
একবার দয়া কোরে কর্ তিরষ্কার!
সন্ধ্যা হোয়ে আসিয়াছে গেল দিনমান,
একটি রাখিবি কথা? গাহিবি কি গান?

ললিতার গান।


বুঝেছ বুঝেছি সখা, ভেঙ্গেছে প্রণয়,
ও মিছা আদর তবে না করিলে নয়?
ও শুধু বাড়ায় ব্যথা, সে সব পুরাণো কথা
মনে কোরে দেয় শুধু, ভাঙ্গে এ হৃদয়।
প্রতি হাসি প্রতি কথা প্রতি ব্যবহার
আমি যত বুঝি তব কে বুঝিবে আর!
প্রেম যদি ভূলে থাক,’ সত্য ক’রে বলনাক,’
করিব না মুহূর্ত্তের তরে তিরষ্কার!
আমি ত বোলেই ছিনু ক্ষুদ্র আমি নারী,
তোমার ও প্রণয়ের নহি অধিকারী।
আর কারে ভালবেসে সুখী যদি হও শেষে
তাই ভাল বেসো নাথ, না করি বারণ।
মনে কোরে মোর কথা মিছে পেয়োনাকো ব্যথা,
পুরাণো প্রেমের কথা কোর’ না স্মরণ!




অনিল (স্বগত)—কি! শেষে এই হােল, এই হােল হায়! 
কি করেছি যার লাগি এ গান সে গায়?

তবে সে সন্দেহ করে প্রণয়ে আমার!
বিশ্বাস নাইক’ তবে মোর পরে আর!
বিশ্বাস নাইক তবে? তাই হবে, তাই হবে—
এত কোরে এই তার হোল পুরষ্কার!
সন্দেহ করিবে কেন? কি আমি কোরেছি হেন!
সন্দেহ করিতে তার কোন্ অধিকার?
আমি কি রে দিন রাত রহিনি তাহারি সাথ?
সতত করিনি তারে আদর যতন?
বাব বার তারে কিরে শুধাইনি ফিরে ফিরে
মুহূর্ত্তের তরে হেরি বিহ্বল মানস?
একটি কথার তরে কতনা শুধাই তারে—
একটি হেরিতে হাসি রজনী পোহাই!
তাই কি রে এই হোল? শেষে কি রে এই হোল?
তাইতে সংশয় এত? অবিশ্বাস তাই?
কল্পনায় অকারণে সে যদি কি করে মনে,
আমি কেন তার লাগি সব’ তিরস্কার?
তবে কি সে মনে করে ভাল বাসিনাকো তারে!
সকলি কপট তবে প্রণয় আমার?
না হয় ভাল না বাসি, দোষ তাহে কার?
কখনো সে কাছে এসে করেছে আদর?
কখনো সে মুছায়েছে অশ্রুবারি মোর?
আমি তারে যত্ন যত করেছি সতত
বিনিময় আমি তার পেয়েছি কি তত?
করেছিত আমার যা’ ছিল করিবার;

সহিতে হয়নি কভু অনাদর তার!
তবু সে কি করে আশা! হৃদয়ের ভালবাসা?
আদরেই ভালবাসা বাহিরে প্রকাশ,
তবু সে করিবে কেন মোরে অবিশ্বাস?

(প্রস্থান।)

ললিতা।—আর কেন অনুক্ষণ রহি তার পাশে 
নিতান্তই যদি মোরে ভাল নাহি বাসে?
বিরক্তিতে ওষ্ঠ তার কঁপিতেছে বার বার
তবুও ললিতা তার পাশে পোড়ে আছে!
সঙ্গ তাঁর তেয়াগিয়া আছেন বিরলে গিয়া
সেথাও ললিতা ছুটে গেছে তাঁর কাছে!
এই মুখে হাসি ছিল তারে দেখি মিলাইল,
তবু সে রোয়েছে বসি পদতলে তাঁর!
যেখানেই তিনি যান্ সেথাই দেখিতে পান
এই এক পুরাতন মুখ ললিতার!
প্রমোদ আগারে বসি—সেথা এই মুখ!
বিরলে ভাবনা মগ্ন-সেথা এই মুখ!
বিজনে বিষাদ ভরে নয়নে সলিল ঝরে,
সেথাও সমুখে আছে এই—এই মুখ!
কি আছে এ মুখে তোর ললিতা অভাগী?
ওই মুখ—ওই মুখ—দিবানিশি ওই মুখ
যেথা যান্ সেথা লোয়ে যাস্‌রে কি লাগি?
ছিনু এই পদতলে প’ড়ে দিন রাত—

করেছিনু পথ-রোধ, দিয়েছে তাহার শোধ
ভালই কোরেছ সখা করেছ আঘাত!
মনে কোরেছি, সখা, প্রণয় আমার
ফুলময় পথ হবে, তোমারে বুকেতে লবে,
চরণে কঠিন মাটি বাজিবে না আর!
কিন্তু যদি ও পদের কাঁটা হোয়ে থাকি
এখনিই তুলে ফেল, এখনিই দোলে ফেল,
এমন পথের বাধা কি হবে গো রাখি?
আজ হেতে দিবানিশি রব’নাকো কাছে?
নিতান্তই ফাটে বুক, অশ্রুবারি আছে—
বিজনে কঁদিতে পারি—একেলা ভাবিতে পারি—
আর কি করিগো আশা? হবে যা’ হবার,
না ডাকিলে কাছে কভু যাবেনাকো আর!
এক দিন, দুই দিন, চোলে যাবে কত দিন,
তবু যদি ললিতারে না পান দেখিতে—
যে ললিতা দিন রাত রহিত গো সাথে সাথ,
সতত রাখিত তাঁরে আঁখিতে আঁখিতে,
বহু দিন যদি তারে না দেখেন আর
তবু কি তাহারে মনে পড়েনাকো তাঁর?
ভাবেন কি একবার—“তারে যে দেখিনা আর?
ললিতা কোথায় গেল? কোথায় সে আছে?”
হয়ত গো একবার ডাকিবেন কাছে;
দেখিবেন ললিতার মুখে হাসি নাই আর,
কেঁদে কেঁদে আঁখি গেছে জ্যোতিহীন হোয়ে;

একবার তবু কিরে আদর করেন মোরে
অতি শীর্ণ মুখ মোর বুকে তুলে লোয়ে?
তখন কঁদিয়া কব পা দুখানি ধোরে
“বড় কষ্ট পেয়েছিগো, আর সখা সহেনাকো!
মাঝে মাঝে একবার দেখা দিও মোরে।”