ভগ্নহৃদয়/চতুর্দশ সর্গ

চতুর্দ্দশ সর্গ।

মুরলা ও কবি।

কবি।—কত দিন দেখিয়াছি তােরে লো মুরলে, 
একেলা কাঁদিতেছিস্ বসিয়া বিরলে।
করতনে রাখি মুখ—কি জানি কিসের দুখ—
বড় বড় আঁখি দুটি মগ্ন অশ্রুজলে!
বড়, সখি, ব্যথা লাগে হেরি তোর মুখ;
এমন করুণ আহা! ফেটে যায় বুক্।
ভাল কি বাসিস্ কারে? কতদিন বল্
পোষণ করিবি হৃদে হৃদয়-অনল?
যত তোর কথা আছে বলিস্ আমার কাছে,
এত স্নেহ কোথা পাবি—এত অশ্রুজল?
মুরলা।—কারে বা ভাল বাসিব কবিগাে আমার? 
ভালবাসা সাজে কিগো এই মুরলার?
সখা, এত আমি দীন, এতই গো গুণ হীন,
ভালবাসিতে যে কবি, মরিগো লজ্জায়!
যদি ভূলি আপনারে, যদি ভালবাসি কারে,
সে জন ফিরেও কভু দেখে কি আমায়?
যদি বা সে দয়া কোরে আদর করে গো মোরে,
সঙ্কোচেতে দিবানিশি দহিনা কি তবু?

ভাই কবি বলি তাই—ভাল মে বাসিতে নাই,
ভালবাসা মুরলারে সাজে কিগো কভু?
দূর হোক্-মুরলার কথা দূর হোক্—
মুরলার দুখজ্বালা মুরলার হোক্—
বল কবি গেছিলে কি নলিনীর কাছে?
নলিনীর কথা কিছু বলিবার আছে?
কবি।—সখিলো, বড়ই মনে পাইয়াছি ব্যথা! 
কাল আমি সন্ধ্যাকালে গিয়েছিনু সেথা;
পথ পার্শ্বে সেই বনে নীরবে আপন মনে
দেখিতে ছিলাম একা বসি কতক্ষণ
সন্ধ্যার কপোল হোতে সুধীরে কেমন
মিলায়ে আসিতেছিল সরমের রাগ;
একটি উঠেছে তারা, বিপাশা হরষে হারা
ছায়া বুকে লোয়ে কত করিছে সোহাগ!
কতক্ষণ পথ চেয়ে রোয়েছি বসিয়া—
এমন সময়ে হেরি—সখীদের সঙ্গে করি
আসিছে নলিনী বালা হাসিয়া হাসিয়া;
নাচিয়া উঠিল মন হরষে উল্লাসে,
রহিনু অধীর হোয়ে মিলনের আশে।
কিন্তু নলিনীর কেন চরণ উঠেনা যেন,
দুই পা চলিয়া যেন পারে না চলিতে,
কেহ যেন তার তরে বোসে নাই আশা কোরে,
সে যেন কাহারো সাথে আসেনি মিলিতে!
কোন কাজ নাই তাই এসেছে খেলিতে!

যেতে যেতে পথ মাঝে যদি হেরে ফুল
করতালি দিয়ে উঠে, তাড়াতাড়ি যায় ছুটে,
আনে তুলে, পরে চুলে, হেসেই আকুল!
কভু হেরি প্রজাপতি কৌতুহলে ব্যগ্র অতি
ধীরে ধীরে পা টিপিয়া যায় তার কাছে।
কভু কহে, “চল্ সখি সেই চাঁপা গাছে
আজিকে সকাল বেলা কুঁড়ি দেখেছিনু মেলা,
এতক্ষণে বুঝি তারা উঠিয়াছে ফুটে,
চল্ সখি একবার দেখে আসি ছুটে!”
কত না বিলম্ব পথে করিল এমন,
বড়ই অধীর হোয়ে উঠিল গো মন।
কতক্ষণ পরে শেষে গান গেয়ে হেসে হেসে
যেথা আমি বোসেছিনু আসিল সেথায়;
চলিয়া গেল সে যেন দেখেনি আমায়।
একেলা বসিয়া আমি রহিনু আঁধারে,
সমস্ত রজনী, সখি, সেই পথ ধারে।
কেন সখি, এত হাসি, এত কেন গান?
কিসের উল্লাসে এত পূর্ণ ছিল প্রাণ?
মন এক দলিবার আছেগো ক্ষমতা,
যখন তখন খুসী দিতে পারে ব্যথা,
তাই গর্ব্বে কোন দিকে ফিরেও না চায়?
তাই এত হাসি হাসে এত গান গায়?
কৃপান যে হাসি হাসে ঝলসি নয়ন,
বিদ্যুৎ যে হাসি হাসে অশনি-দশন!

অথবা হয়ত, সখি, আমারিই ভূল;
হয়ত সে মনে মনে কল্পনায় অকারণে
প্রণয়ে সন্দেহ করে হোয়েছে আকুল।
অভিমানে জানাইতে চায় মোর কাছে—
রাখেনা আমার আশা, নাই কিছু ভালবাসা,
ভাল না বেসেও মোরে বড় সুখে আছে!
যখন গাহিতেছিল মরমে দহিতে ছিল,
হাসি সে মুখের হাসি আর কিছু নয়,
গোপনে কঁদিতেছিল অশান্ত হৃদয়!
আজ আমি তার কাছে যাই একবার;
শুধাই,—অমন কোরে কেন সে নিষ্ঠুরা মোরে
দিয়াছে বেদনা, দলি হৃদয় আমার? (কবির প্রস্থান)
মুরলা।—আসিয়াছে সন্ধ্যা হোয়ে নিস্তব্ধ গভীর, 
তারা নাহি দেখা যায় কুয়াশা ভিতরে,
একটি একটি কোরে পড়িছে শিশির
মুবলার মাথার শুকানো ফুল পরে!
জীর্ণ-শাখা শীত-বায়ে উঠে শিহরিয়া,
গাছের শুকনো পাতা পড়িছে ঝরিয়া;
ওঠ্লো মুরলা, ওঠ্, দিন হোল শেষ,
পর্‌লো মুরলা, পর্‌ সন্ন্যাসিনী বেশ!
মুরলা? মুরলা কোথা? গেছে সে মরিয়া;
সেই যে দুখিনী ছিল বিষণ্ন মলিন,
সেই যে ভাল বাসিত হৃদয় ভরিয়া,
সেই যে কাঁদিত বনে আসি প্রতিদিন,

সে বালা মরিয়া গেছে, কোথায় সে আর?
ছিন্ন বস্ত্র, ম্লান মুখ,লোয়ে দুঃখ ভার,
তাহার সে বুকের লুকানো কথা বোহে
মোরেছে সে বালা আজ সন্ধ্যায় উদরে!
তবে এ কাহারে হেরি নিশীথে শ্মশানে?
ও একটি উদাসিনী সন্যাসিনী যায়—
কারেও বাসেনা ভাল, কারেও না জানে
আপনার মনে শুধু ভ্রমিয়া বেড়ায়!
একটি ঘটনা ওর্ ঘটেনি জীবনে,
একটি পড়েনি রেখা ওর শূন্য মনে,
পথ ছাড়’ পান্থ, কিবা শুধাইছ আর?
জীবন কাহিনী কিছু নাই বলিবার!
মুরলা, সত্যই তবে হলি সন্যাসিনী?
সতাই ত্যজিলি তোর যত কিছু আশা?
তবেরে বিলম্ব কেন, বসিয়া আছিস্ হেন?
এখনো কি—এখনো কি সব ফুরায় নি?
এখনো কি মনে মনে চাস্ ভালবাসা?
বড় মনে সাধ ছিল রহিব হেথায়,
কষ্ট পাই দুঃখ পাই রব’ তাঁরি সাথ,
আজন্ম কালের তাঁর সহচরী হায়
আমরণ বেড়াইব ধরি তাঁরি হাত!
কিছুতে নারিনু অশ্রু করিতে দমন,
কিছুতে এল না হাসি বিষণ্ন বদনে,
সদাই এড়াতে হোত কবি নয়ন,

কাঁদিতে আসিতে হ’ত এ আঁধার বনে!
আজিকে সুখের দিন কবির আমার,
হৃদয়ে তিলেক নাই বিষাদ আঁধার,
নূতন প্রণয়ে মগ্ন তাঁহার হৃদয়
বিশ্ব চরাচর হেরে হাস্য-সুধাময়;
এখন, মুরলা আমি, কেন রহি আর?
যেখানেই যান্ কবি হর্ষে হাসি হাসি,
সেথাই দেখিতে পান্ এ মুখ আমার—
বিষাদের প্রতিমূর্তি অন্ধকার রাশি!
ওঠ্লো মুরলা তবে, দিন হোল শেষ,
পর্‌লো মুরলা তবে সন্যাসিনী বেশ!
বেড়াইবি তীর্থে তীর্থে, ত্যজিবি সংসার,
ভূলে যাবি যত কিছু আছে আপনার!
কত শত দিন, কত বর্ষ যাবে চলি—
তখন কপালে তোর পড়েছে ত্রিবলী,
নয়ন হইয়া তোর গেছে জ্যোতি হীন,
কত কত বর্ষ গেছে, গেছে কত দিন;
এই গ্রামে ফিরিয়া আসিবি একবার,
যাইবি মাগিতে ভিক্ষা কবির দুয়ার,
দেখিবি আছেন সুখে নলিনীরে লোয়ে
দুই জনে একমন এক প্রাণ হোয়ে!
কতনা শুনাইছেন কবিতা তাহারে!
কতনা সাজাইছেন কুসুমের হারে!
মোরে হেরে কবি মোর অবাক্ নয়নে

মোর মুখ পানে চেয়ে রহিবেন কত,
মনে পড়ি পড়ি করি পড়িবেনা মনে
নিশীথের ভূলে-যাওয়া স্বপনের মত!
কতক্ষণ মুখ পানে চেয়ে থেকে থেকে
সবিস্ময়ে নলিনীরে কহিবেন ডেকে—
“যেন হেন মুখ আমি দেখেছিনু প্রিয়া!
কিছুতেই মনে তবু পড়িছেনা আর!”
অমনি নলিনীবালা উঠিবে হাসিয়া
কহিবে “কল্পনা, কবি, কল্পনা তোমার!”
শুনিয়া হাসিবে কবি, ফিরাবে নয়ন,
নলিনীর পাখীটীরে করিবে আদর;
আমিও সেখান হোতে করিব গমন
ভ্রমিয়া বেড়াতে পুনঃ দূর দেশান্তর!
ওঠ্লো মুরলা তবে দিন হোল শেষ,
পর্‌লো মুরলা তবে সন্যাসিনী বেশ!

থাক্ থাক্, আজ থাক্, আজ থাক্ আর!
কবিরে দেখিতে হবে আরেকটি বার!
কাল হব সন্যাসিনী বরিব বিরাগে,
দেখি আরেকবার যাইবার আগে।