ভগ্নহৃদয়/দ্বিতীয় সর্গ

দ্বিতীয় সর্গ।

ক্রীড়া কানন। নলিনী ও সখীগণ।

নলিনী।—সখি! অলক-চিকুরে কিশলয় সাথে 
একটি গোলাপ পরায়ে দে।
চারু! দেখি ও আরশী খানি;
বালা! সিঁথিটি দে ত লো আনি;
লীলা! শিথিল কুন্তল দেখ্ বার বার
কপোল দুলিয়া পড়িছে আমার
একটু এপাশে সরায়ে দে।
সুরুচি।—মাধবী! বল্‌ত মােরে একবার 
আজিকে হোল কি তোর!
কতখণ ধ’রে গাঁথিছিস্ মালা
এখনো কি শেষ হোল না তা’ বালা?
এক মালা গেঁথে করিবি না কি লো
সারাটি রজনী ভোর?
অনিলের হবে ফুলশয্যা আজ,
সাঁঝের আগেই শেষ করি সাজ
সব সখী মিলি যেতে হবে সেথা
তা কি মনে আছে তোর?
অলকা।—মরি মরি কিবা সাজাবার ছিরি, 
চেয়ে দেখ্ একবার!

সখীর অমন ক্ষীণ দেহ মাঝে
কমল ফুলের মালা কিলো সাজে?
বিনোদিনী দেখ্ গাঁথিছে বসিয়া
কমলের ফুল হার!
নলিনী।—ওই দেখ সখি, দাঁড়ের উপরে, 
মাথাটি গুঁজিয়া পাখার ভিতরে
শ্যামাটি আমার—সাধের শ্যামাটি
কেমন ঘুমায়ে আছে!
আন্ সখি ওরে কাছে।
গান গেয়ে গেয়ে, তালি দিয়ে দিয়ে,
ঘিরে বসি ওরে সকলে মিলিয়ে,
দেখিব কেমন ফিরে ফিরে ফিরে
তালে তালে তালে নাচে।






(শ্যামার প্রতি গান)



নাচ্ শ্যামা, তালে তালে।
বাঁকায়ে গ্রীবাটি, তুলি পাখা দুটি,
এপাশে ওপাশে করি ছুটাছুটি
নাচ্ শ্যামা, তালে তালে।
রুণু রুণু ঝুনু বাজিছে নুপূর,
মৃদু মৃদু মধু উঠে গীত সুর,
বলয়ে বলয়ে বাজে ঝিনি ঝিনি,

তালে তালে উঠে করতালি ধ্বনি,
নাচ্ শ্যামা, নাচ্ তবে!


নিরালয় তোর বনের মাঝে
সেথা কি এমন নূপুর বাজে?
বনে তোর পাখী আছিল যত
গাহিত কি তারা মোদের মত
এমন মধুর গান?
এমন মধুর তান?
কমল-করের করতালি হেন
দেখিতে পেতিস্ কবে?
নাচ শ্যামা নাচ্ তবে!


বন্দী বোলে তোর কিসের দুখ?
বনে বল্ তোর কি ছিল সুখ?
বনের বিহগ কি বুঝিবি তুই,
আছে লোক কত শত,
যারা শ্যামা তোর মত
এমনি সোনার শিকলি পরিয়া
সাধের বন্দী হইতে চায়!
এই গীত-রবে হোয়ে ভরপূর,
শুনি শুনি এই চরণ-নূপুর
জনম জনম নাচিতে চায়!

সাধ কোরে ধরা দেয় গো তারা,
সাথে সাথে ভ্রমি হয় গো সারা,
ফিরেও দেখিনে—ফিরেও চাহিনে—
বড় জ্বালাতন করেগো যখন
অশরীরী বাজ করি বরিষণ—
উপেখা বাণের ধারা!
তবে দেখ্ পাখী তোর
কেমন ভাগ্যের জোর!
বড় পুণ্য ফলে মিলেছে বিহগ
এমন সুখের কারা!


আয় পাখী, আয় বুকে!
কপোলে আমার মিশায়ে কপোল
নাচ্ নাচ্ নাচ্ সুখে!
বড় দুখ মনে, বনের বিহগ,
কিছু তুই বুঝিলি না!
এমন কপোল অমিয়-মাখা
চুমিলি, তবুও ঝাপটি পাখা
উড়িতে চাহিস্ কি না!
প্রতি পাখা তোর উঠেনি শিহরি?
পুলকে হরষে মরমেতে মরি
ঘুরিয়া ঘুরিয়া চেতনা হারায়ে
পদতলে পড়িলি না?

নাচ্ নাচ্ তালে তালে!
বাঁকায়ে গ্রীবাটি তুলি পাখা দুটি
এ পাশে ও পাশে করি ছুটাছুটি
নাচ্ শ্যামা তালে তালে!




দামিনী।—শুনেছিস সখি, বিবাহ-সভায় 
বিনোদ আসিবে আজ!
ভালো কোরে কর্ সাজ!
নলিনী।—আহা মােরে যাই কি কথা বলিলি! 
শুনিয়া যে হয় লাজ!
বিনোদ আসিবে আজ?
এ বারতা দিয়ে কেন লো স্বজনি,
মাথায় হানিলি বাজ?
সারাখণ মোর সাথে সাথে ফিরে
ক্ষান্ত নহে একটুক,
মুখখানা তার দেখিবারে পাই।
যে দিকে ফিরাই মুখ!
এক-দৃষ্টে হেন রহে সে তাকায়ে
থেকে থেকে ফেলে শ্বাস,
মুখেতে আঁচল চাপিয়া চাপিয়া
রাখিতে পারিনে হাস!
লীলা।—শুনেছি প্রমােদ আসিবে, যাহারে 
ভ্রমর বলিয়া ডাকি,

যাহারে হেরিলে হরষে তোমার
উজলিয়া উঠে আঁখি।
নলিনী।—গা ছুঁয়ে আমার বল্‌লো স্বজনি, 
সত্য সে আসিবে নাকি?
দেখ দেখি সখি, অভাগীর তরে
কোথাও নিস্তার নাই,
মরি মরি কিবা ভ্রমর আমার!
ভ্রমরের মুখে ছাই!
সে ছাড়া ভ্রমর আর কি নাই?
তা হোলে এখুনি—সখিরে, এখনি
নলিনি-জনম ঘুচাতে চাই!
চারুশীলা।—লুকাস্‌নে মােরে, আমি জানি সখি, 
কে তোমার মনোচোর।
বলিব? বলিব? হেথা আয় তবে,
বলি কানে কানে তোর!
(কানে কানে কথা)
নলিনী।—জ্বালাস্‌নে চারু, জ্বালাস্‌নে মােরে 
করিস্‌নে নাম তার!
সুরেশ?—তাহার জ্বালায় স্বজনী,
বেঁচে থাকা হোল ভার!
কে জানিত আগে বলত সখিলো,
রূপের যাতনা অতি?
সাধ যায় বড় কুরূপা হইয়া
লতি শান্তি এক রতি!

(লীলার প্রতি জনান্তিকে)
মাধবী।—শােন্ বলি লীলা, জানি কারে সখি 
মনে মনে ভাল বাসে।
দেখিনু সে দিন বিজয়ের সাথে
বসি আছে পাশে পাশে।
মৃদু হাসি হাসি কত কহে কথা,
কভু লাজে শির নত,
কভু ল’য়ে কেশ বেণী ফেলি খুলে,
জড়ায়ে জড়ায়ে মৃণাল আঙ্গুলে
অনি-মনে খেলে কত!
কখন বা শুনে অতি এক মনে
বিজয়ের কথাগুলি,
শুনিতে শুনিতে শির নত করি
তুলি কুঁড়ি এক, কতখণ ধরি
খুলি খুলি দেয় মুদিত পাপড়ি,
ফুটাইয়া তারে তুলি।
কভু বা সহসা উঠিয়া যায়—
কভু বা আবার ফিরিয়া চায়—
মৃদু মৃদু স্বরে গুন্ গুন্ কোরে
উঠে এক গান গেয়ে;
এমন মধুর অধীরতা তার!
এমন মোহিনী মেয়ে!
বিনো।—সখীলাে, তা’ নয়, কতবার আমি 
দেখিয়াছি লুকাইয়া,

অশোকের সাথে বসি আছে এক
প্রমোদ কাননে গিয়া!
জানি আমি তারে হেরিলে সখীর
সুখে নেচে উঠে হিয়া।
নলিনী।—হেথা আয় তােরা, দে দেখি সাজায়ে 
শ্যামা পাখীটিরে মোর!
দুটি ফুল বসা দুইটি ডানায়;
বেলকুঁড়ি মালা কেমন মানায়
সুগোল গলায় ওর!
ওই দেখ্ সখি! দেখিনি কখনো
এমন দুরন্ত পাখী!
যত গুলি ফুল দিলেম পরায়ে
সব গুলি দেখ্ ফেলেছে ছড়ায়ে,
শত শত ভাগে ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া
একটি রাখেনি বাকী!
ভাল, পাখী যদি না চায় সাজিতে
আমারে সাজালো তবে।
চারু।—তাের সাজ ফুরাইবে কবে? 
লীলা।—সখি, আবার কিসের সাজ! 
সুরুচি।—দেখ, এসেছে হইয়া সাঁঝ। 
নলিনী।—দেখলাে সুরুচি, লীলা ভাল কোরে 
বাঁধিতে পারেনি চুল;
এই দেখ্ হেথা পরায়ে দিয়াছে
অলকে শুকানো ফুল;

বেণী খুলে চুল বেঁধে দে আবার
কানে দে পরায়ে দুল।
সুরুচি।—না লাে সখী, দেখ, আঁধার হােতেছে 
দেরি হোয়ে যায় ঢের—
চল ত্বরা কোরে, যাই দেখিবারে
ফুলশয্যা অনিলের।
অলকা।—এত খণে সখি, এসেছে সেখায় 
যতেক গ্রামের লোক।
দামিনী।—(হাসিয়া) এসেছে বিনােদ! 
লীলা।—(হাসিয়া) এসেছে প্রমােদ! 
বিনো।—(হাসিয়া) এসেছে সেথা অশােক! 
মাধবী।—হাসিয়া) এসেছে বিজয়! 
চারু।—(চিবুক ধরিয়া) সুরেশ রয়েছে 
পথ চেয়ে তোর তরে!
অলকা।—আয় তবে ত্বরা কোরে! 
নলিনী।—ভাল, সখি, ভাল, চল্ তবে চল্ 
জ্বালাস্‌নে আর মোরে!