সপ্তম সর্গ।

অনিল, ললিতা।

অনিল।—(গাহিতে গাহিতে) 
কাছে তার যাই যদি কত যেন পায় নিধি,
তবু হরষের হাসি ফুটে ফুটে ফুটেনা!
কখনো বা মৃদু হেসে আদর করিতে এসে
সহসা সরমে বাধে মন উঠে উঠে না!
রোষের ছলনা করি দূরে যাই, চাই ফিরি,
চরণ বারণ তরে উঠে উঠে উঠে না;
কাতর নিশ্বাস ফেলি, আকুল নয়ন মেলি
চাহি থাকে, লাজ বাঁধ তবু টুটে টুটে না!
যখন ঘুমায়ে থাকি মুখ পানে মেলি আঁখি
চাহি থাকে, দেখি দেখি সাধ যেন মিটেনা,
সহসা উঠিলে জাগি, তখন কিসের লাগি
সরমেতে ম’রে গিয়ে কথা যেন ফটে না।
লাজময়ি! তোর চেয়ে দেখিনি লাজুক মেয়ে,
প্রেম বরিষার স্রোতে লাজ তবু টুটেনা!
ললিতা।—(স্বগত) 
পাষাণে বাঁধিয়া মন আজ কোরেছিনু পণ

কাছে যাব—কথা কব-যাচিব আদর আজ!
ওরে মন, ওরে মন, কার কাছে তোর লাজ?
আপনার চেয়ে যারে কোরেছিস্ আপনার
তার কাছে বল দেখি কিসের সরম আর?
অনিল।—ফুল তুলিবার ছলে ওই সে ললিতা আসে, 
মনে মনে জানা আছে এলেই আমার কাছে
অমন হাতটি ধরি বসাব’ আমার পাশে।
অন্য দিক পানে আমি চাহিয়া রহিব আজ,
দেখিব কেমন করি কোথা তার থাকে লাজ?
ললিতা।—(ফুল তুলিতে তুলিতে 
না-হয় বসিনু কাছে— কি তাহাতে দোষ আছে?
বসিব নাথের পাশে তাহাতে কি আসে যায়?
আর, লজ্জা—লজ্জা নয়–লজ্জারে করিব জয়—
না হয় বসিনু কাছে কিসের সরম তার!
কোথা লজ্জা—লজ্জা কোথা? এইত বসিনু হেথা—
এইত করিনু জয়, এইত বসিনু কাছে—
বসিব নাথের পাশে কি তাহাতে দোষ আছে?
এখনো—এখনো মোরে দেখিতে পান নি তবে—
তবে কিগো আরো কাছে—আরো কাছে যেতে হবে?
আর নয়—আরো কাছে যাইব কেমন কোরে?
হেথা তবে বোসে থাকি, মালা গুলি গেঁথে রাখি
এখনি ভাবনা ভাঙ্গি দেখিতে পাইবে মোরে!
যদিবা দেখিতে পায় কি তবে করিবে মনে?
যদিগো বুঝিতে পারে দেখিতে এসেছি তারে,

মিছে মালা গাঁথা হলে বোসে আছি এই খানে?
অনিল।—এই যে ললিতা হােথা—ফুরালো কি মালা গাঁথা? 
আরেকটু এসে না হয় গাঁথিতে মালা!
এই হেথা কাছে আয়—কিসের সরম তায়?
কেমন গাঁথিলি ফুল একবার দেখি বালা!
আদরিণী—আদরিণী—দেখি হাতখানি তোর,
এমনি করিয়া সখি বাঁধ্‌লো হৃদয় মোর!
একবার দেখি সখি, কাছে আন্ মুখখানি,
এমনি করিয়া রাখ্ বুকের মাঝারে আনি!
কেন, লাজ এত কেন—আঁখি দুটি নত কেন?
কি কোরেছি? একটি শুধু চুম্বন বইত নয়!
আরেকটি এই লও—আরেকটি এই লও—
আর নয় করিব না বড় যদি লাজ হয়!
না হয় কুন্তল দিয়ে ঢেকে দিই মুখ খানি!
দেখিতে আনন তোর ওই চন্দ্র ভাবে—ভোর
এক দৃষ্টে চেয়ে, সখি, রোয়েছে অবাক্ মানি!
ওই দেখ্ তারা গুলি সহস্র নয়ন খুলি
ওই মুখটির তরে খুঁজিছে সমস্ত ধরা,
উচিত কি সখি তাদের নিরাশ করা?
নয়নে নয়ন রাখি একবার মেল আঁখি,
মিশাও কপোলে মোর ললিত কপোল তব;
কথা কও কানে কানে—মৃদু প্রণয়ের গানে
জাগাও ঘুমন্ত হৃদে সুখ-স্বপ্ন নব নব!
মনে আছে সেই রাত্রে কত সাধনার পরে

একটি সঙ্গীত, সখি, গিয়াছিলে গাহিবারে,
আরম্ভ কোরেই সবে অমনি থামালে গীত,
নিজের কণ্ঠের স্বরে নিজে হোয়ে সচকিত!
সেই কাজের কথা এখনো রোয়েছে কানে,
সেই আরম্ভের সুর এখনো বাজিছে প্রাণে!
সে আরম্ভ শেষ, বালা, আজিকে করতে চাই।
বড় কি হোতেছে লাজ? ভাল সখি কাজ নাই!
ললিতা।—(স্বগত) 
কি কহিব? বড়, সখা, মনে মনে পাই ব্যথা,
না জানি গাহিতে গান, না জানি কহিতে কথা!
কত আজ বেছে বেছে তুলেছি কুসুম-ভার,
কতখণ হোতে আজ ভেবেছি ভুলিয়া লাজ
নিশ্চয় এ ফুল গুলি দিব তাঁরে উপহার!
হাতটি এগিয়ে আজ গিয়েছিনু কতবার,
অমনি পিছনে হাত লইয়াছি শতবার;
সহস্র হউক লাজ, এ কুসুম গুলি আজ
নিশ্চয় দিবগো তাঁরে না হবে অন্যথা তার!
কিন্তু কি বলিয়া দিব?—কি কথা বলিতে হবে?
বলিব কি—“ফুল গুলি যতনে এনেছি তুলি
যদি গো গলায় পর’ মালা গেঁথে দিই তবে”?
ছি ছি গো বলি কি কোরে—সরমে যে যাব’ মোরে
নাইবা বলিনু কিছু, শুধু দিই উপহার,—
দিই তবে? দিই তবে?—দিই তবে এইবার?
দুর হোক্—কি করিব?—বড় যেগো লজ্জা করে!

থাক্‌গো এখন থাক্—দিব আরেকটু পরে।
অনিল।—কি হােয়েছে? দিতে কি লাে চাস্ ফুল-উপহার? 
দে না লো গলায় গেঁথে, কিসের সরম তার?
একটি দাওত সখি, পরাই তোমার চুলে,
আর দুটি দাও সখি পরাইব কর্ণ-মূলে।
মোরে দাও সব গুলি গাঁথিব ফুলের বালা,
গলায় দুলায়ে দিব গাঁথিয়া চাঁপার মালা;
আসন রচিয়া দিব দিয়ে শত শতদল,
তা’ হেলে কি দিবি মোরে—বল্ সখি, বল্ বল—
যত গুলি ফুল গাঁথি যত তার দল আছে
ততেক চুম্বন আমি লইব তোমার কাছে;
যত দিন না পারিবি শুধিতে চুম্বন—ধার
এ ভুজে রহিবি বদ্ধ এই বক্ষ কারাগার!
দিবানিশি সজনি লো রেখে দেব চোখে চোখে,
বল্ তবে—ফুলসাজে সাজায়ে দেব কি তোকে?
বলিবি না? ভাল সখি দুইটি চুম্বন দাও—
না হয় একটি দিও, মহার্ঘ তেল কি তাও?
ললিতা।—(স্বগত) 
আরেকটি বার সখা করগো চুম্বন মোরে,
আরেকটি বার সখা, রাখগো বুকেতে ধোরে!
জান’ আমি মুখ ফুটে সরমে বলিতে নারি,
তাই কি সহিতে হবে? এত শান্তি সখা তারি?
আদরে হৃদয়ে যদি রাখ’ এ মাথাটি মোর,
আদরে চুম’ গো যদি আঁখির পাতাটি মোর,

তাহাতে আমার, সখা, অসাধ কি হেতে পারে!
তবে কেন ব্যথা দিতে শুধাইছ বারে বারে?
আকুল ব্যাকুল হৃদি মিলিবারে তব পাশে
শতবার ধায়, সখা, শতবার ফিরে আসে!
দীন আপনারে হেরে এমন সে লাজ পায়
তোমায় কাছেতে সখা সঙ্কোচে না যেতে চায়,
সখা তারে ডেকে নাও—তুমি তারে ডেকে নাও,
তোমারি সে মুখ চেয়ে দাঁড়াইয়া একধার,
একটু আদর পেলে স্বর্গ হাতে পাবে তার!
অনিল।—ডুবিছে চতুর্থী চাঁদ বিপাশার নীরে, 
আয় সখি, আয় মোরা ঘরে যাই ফিরে।
আঁধারে কানন-পথ দেখা নাহি যায়,
আয় তবে আরো কাছে—আরো কাছে আয়।
হাত খানি রাখ্ মোর হাতের উপর,
শ্রান্ত যদি হোস্ মোর কাঁধে দিস্ ভর।
দেখিস্, বাধে না যেন চরণ লতায়—
আঁচল না ছিঁড়ে যায় গাছের কাঁটায়!
চমকি উঠিলি কেন? কিছু নাই ভয়—
বাতাসের শব্দ শুধু, আর কিছু নয়!
এই দিকে পথ, বালা, এই দিকে আয়,
বাম পাশে বিপাশার স্রোত ব’হে যায়।
শ্রান্তি কি হতেছে বোধ? লজ্জা কেন প্রিয়ে?
বেষ্টন করনা মোর স্কন্ধ বাহ দিয়ে!
কিসের তরাস এত—ওকি বালা ওকি?

ঝরিয়া পড়েছে শুধু শুষ্ক পত্র সখি!
ওই গেল গেল চাঁদ ওই ডোবে ডোবে—
একটু জোছনা-রেখা এখনো যেতেছে দেখা,
আর নাই—আর নাই—ওই গেল ডুবে!