ভূতের বিচার/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 জজ সাহেবের বাড়ীতে ডাকাতির অনুসন্ধানের নিমিত্ত পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী হইতে সর্ব্বনিম্ন কর্ম্মচারী পর্য্যন্ত সকলেই বিশেষরূপে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে সকলেই হানিফ খাঁর দ্বারা যে ডাকাতি হইয়াছে, এ কথা বিশ্বাস করুন বা না করুন, কিম্বা ভূতের কথা বিশ্বাস করুন বা না করুন, জজ সাহেবের বাড়ীতে যে ডাকাতি হইয়াছে ও তাঁহার বাড়ী হইতে যে অনেক দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, ইহা কিন্তু সকলকেই বিশ্বাস করিতে হইল। আরও বিশ্বাস করিতে হইল যে, ঐ কার্য্য ডাকাতের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। সেই সকল ডাকাত যাহারাই হউক না কেন, তাহারা কিন্তু ভূত নহে, কারণ উহারা যদি ভূত হইত, তাহা হইলে কেবলমাত্র উৎপাত করিয়াই চলিয়া যাইত। চেন, ঘড়ী, আংটী, রূপার বাসন, কাপড় চোপড় প্রভৃতি দ্রব্যাদি ভূতে অপহরণ করিবে কেন? ঐ সকল দ্রব্যে ভূতের প্রয়োজন কি?

 এই ডাকাতির কিনারা করিবার নিমিত্ত পুলিস কর্ম্মচারীগণ বিধিমতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। দুইজন প্রসিদ্ধ ডিটেকটিভ্ কর্ম্মচারী তাঁহাদিগের সকল কার্য্য পরিত্যাগ করিয়া এই ডাকাতির অনুসন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। কিন্তু সহজে কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না, বা শীঘ্র যে তাহার একটা কিনারা হইবে, তাহারও কোন উপায় দেখিতে পাওয়া গেল না।

 এইরূপে ক্রমে দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল। একদিবস বেলা আন্দাজ দশটার সময় ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীদ্বয়, থানায় দারোগার নিকট বসিয়া এই ডাকাতি সম্বন্ধে কথা-বার্ত্তায় নিযুক্ত আছেন, এরূপ সময় একজন চৌকিদার একটী স্ত্রীলোককে লইয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া দারোগা বাবু সেই চৌকিদারকে কহিলেন, “এই স্ত্রীলোকটীর কি হইয়াছে?”

 চৌকিদার। এই স্ত্রীলোকটী কোন বিষয় আপনাকে জানাইতে ইচ্ছা করেন, তাই আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।

 দারোগা। কি বিষয় জানাইতে ইচ্ছা করে?

 চৌ। উহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই সমস্ত বিষয় জানিতে পারিবেন।

 দা। কি গো বাছা, কি হইয়াছে?

 স্ত্রী। আমরা আর ঘরে সুস্থ হইয়া বাস করিতে পারি না।

 দা। কেন?

 স্ত্রী। ভূতের অত্যাচারে।

 দা। ভূতের অত্যাচার আমরা কিরূপে নিবারণ করিব? আমরা তো ভূতের ওঝা নহি। কি হইয়াছে বল দেখি শুনি?

 স্ত্রী। গত রাতে আমি আমার ঘরে শুইয়াছিলাম, বাহির হইতে কে আমার দরজায় ধাক্কা দিল; আমি প্রদীপ হস্তে দরজা খুলিয়া দেখি, আমার ঘরের সম্মুখে সেই ভূত দাঁড়াইয়া। ঐ ভূত দেখিয়াই আমি একেবারে অজ্ঞান হইয়া সেই স্থানে পড়িয়া গেলাম, আমার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। আমি কতক্ষণ ঐরূপ হতজ্ঞান অবস্থায় সেই স্থানে পড়িয়াছিলাম, তাহা আমি জানি না। যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন দেখলাম, আমার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহা নাই। ঘরের ভিতর আমার যে সকল বাক্স পেটরা ছিল, তাহা সমস্তই ভাঙ্গা অবস্থায় পতিত রহিয়াছে, ও তাহার মধ্যে আমার যাহা কিছু ছিল তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। আমার বিশ্বাস, ঐ ভূত ভিন্ন অপর কেহ আমার ঐ সকল দ্রব্য অপহরণ করে নাই। আমার সমস্ত দ্রব্য যখন ভূতে লইয়া গিয়াছে, তখন আমার ঘাড়টী যে সে মটকাইয়া রাখিয়া যায় নাই, ইহাই আশ্চর্য্য!

 দা। তুমি বলিতেছ, “সেই ভূত”! কোন্ ভূত?

 স্ত্রী। তাহা তো আপনারা সকলেই জানেন। যে ভূত কোটাল বৌর ঘাড়-মটকাইয়া রাখিয়া গিয়াছিল; যে ভূত রাস্তার উপর বাঁশ ফেলিয়া সকলের যাতায়াত সময় সময় বন্ধ করিয়া দেয়; যে ভূত গাছের উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়া থাকিয়া সকলকে ভয় দেখাইয়া থাকে, ও সেই ভূত, সকলেই উহাকে চিনে।

 দা। উহার নাম কি?

 স্ত্রী। হানিফ খাঁ মরিয়া ভূত হইয়াছে, তাহা তো আপনারা সকলেই জানেন। ও সেই ভূত।

 দা। সে ভূত থাকে কোথায়?

 স্ত্রী। ভূত যে কোথায় থাকে তাহা কে জানে, কিন্তু প্রায়ই তো তাহাকে কেহ না কেহ দেখিতে পায়।

 দা। কোথায় ভূতকে দেখিতে পাওয়া যায়?

 স্ত্রী। আমাদের গ্রামে ও তাহার নিকটবর্ত্তী স্থান সমূহে—মাঠের ভিতর, জঙ্গলের ভিতর, বাগানের ভিতর, পুকুরের ধারে প্রভৃতি যে সকল স্থানে লোকের যাতায়াত কম, প্রায় সেই সকল স্থানে কেহ না কেহ ঐ ভূতকে দেখিতে পায়, ইহা তো প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায়।

 দা। তুমি ঐ ভূতকে আমাদিগকে দেখাইতে পার?

 স্ত্রী। আমি স্ত্রীলোক, আমি কিরূপে ঐ ভূত আপনাদিগকে দেখাইব; আপনারা চেষ্টা করিলেই, ঐ সকল স্থানে কোন দিন না কোন দিন ভূতকে দেখিতে পাইবেন। কিন্তু সে যদি আপনাদিগের ঘাড় মট্‌কাইয়া দেয়?

 ঐ স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া পুলিস-কর্ম্মচারীত্রয় ভূতের ব্যাপার বিশেষ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না, তবে এই মাত্র বুঝিলেন যে, যে চোর তাহার বাড়ীতে চুরি করিতে আসিয়াছিল, তাহাকে দেখিয়া ঐ স্ত্রীলোকটী অতিশয় ভয় পাইয়া অজ্ঞান হইয়া পড়ে। এই সুযোগে ঐ চোর ইহার যথাসর্ব্বস্ব অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে।

 স্ত্রীলোকটীর কথা শুনিয়া দারোগা বাবু সেই চৌকিদারকে কহিলেন, এই স্ত্রীলোকটী যেরূপ ভূতের কথা বলিতেছে, তাহা তুমি শুনিয়াছি কি?

 চৌ। হাঁ হুজুর, শুনিয়াছি।

 দা। এ কি সত্য কথা কহিতেছে?

 চৌ। হাঁ হুজুর, এ সব সত্য কথা কহিতেছে। আমার মহলে হানিফ খাঁ ভূত হইয়া অজ-কাল বড়ই অত্যাচার করিতেছে।

 দা। তুমি কি সেই ভূত কোন দিন দেখিয়াছ?

 চৌ। না, আমি নিজে একদিনও দেখি নাই। কিন্তু যাহারা যাহারা দেখিয়াছে, তাহাদেরই মুখে শুনিয়াছি। অনেকেই ভয় পাইয়াছে, এ কথা আপনি সেই স্থানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন।

 চৌকিদারের কথা শুনিয়া ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীদ্বয়ের মধ্যে একজন কহিলেন, হানিফ খাঁ ভূত হইয়া যখন ঐ সকল স্থানে নানারূপ অত্যাচার করিতেছে, এ কথা যখন ঐ স্থানের স্থানীয় লোকদিগের বিশ্বাস, তখন একবার ঐ স্থানে গিয়া একটু অনুসন্ধান করিয়া দেখা মন্দ নহে।

 ইহাঁর কথায় সকলেই অনুমোদন করিলেন। দারোগাবাবু ঐ স্ত্রীলোকটীর এজাহার লিখিয়া লইয়া তাহাকে কহিলেন, “তুমি এখন ঘরে যাও, আমি একটি ভূতের ওঝার জোগাড় করিয়া তোমাদিগের বাড়ীতে যত শীঘ্র পারি গিয়া উপস্থিত হইব ও দেখিব, তোমার যে সকল দ্রব্য চুরি গিয়াছে, তাহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি কি না এবং যে ভূত তোমাদিগের গ্রামের লোকের উপর অত্যাচার করিতেছে, সেই ভূতকে ঐ গ্রাম হইতে তাড়াইতে পারি কি না?

 দারোগা বাবুর কথা শুনিয়া চৌকিদার ঐ স্ত্রীলোকটীকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল।

 উহারা প্রস্থান করিবার পর দারোগাবাবু আহারাদি সমাপন করিয়া সেই স্থানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলেন। বলা বাহুল্য, ডিটেকটিভ কর্ম্মচারীদ্বয়ও তাঁহার সহিত সেই স্থানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়া আসিলেন।