ভূত ও মানুষ/বাঙ্গাল নিধিরাম/দ্বিতীয় অধ্যায়


দ্বিতীয় অধ্যায়

বদরুদ্দিনের বেটা গবীরুদ্দিন

নিধিরামকে ঘরে আনিয়া এককড়ি সপরিবারে তাঁহার চিকিৎসা ও সেবায় প্রবৃত্ত হইলেন। ক্রমে তাহার পীড়া উপশম হইয়া আসিল। কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলে, এককড়ি তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। পরিচয় পাইয়া তখন বুঝিলেন যে, নিধিরাম উচ্চশ্রেণীর স্বভাব কুলীন। এককড়ি মনে করিলেন,— “বিধাতা এইবার বুঝি আমার প্রতি সুপ্রসন্ন হইয়াছেন। এরূপ পাত্রে কন্যা

দান করিতে পারিলে, পিতৃকুলের মুখ উজ্জ্বল হইবে।”

 নিধিরাম ক্রমে আরোগ্য লাভ করিলেন। সুস্থ হইয়া তিনি এককড়ির নিকট বিদায় প্রার্থনা করিলেন। বলিলেন,— “মহাশয়! যদিও এ প্রাণ আমার অতি তুচ্ছ পদার্থ, তথাপি আপনার দয়া-মায়া কখনও ভুলিতে পারিব না, আপনার ধার কখনও শুধিতে পারিব না। আমার এমন কিছু নাই, যাহা দিয়া আপনার ঋণ পরিশোধ করিতে পারি। এক্ষণে আপনি অনুমতি করুন, আমি বিদায় হই।”

 এককড়ি বলিলেন,— “প্রাণরক্ষা করি, এমন ক্ষমতা আমার কোথায়! সমুদয় ঈশ্বরের হাত। আপনার আয়ু ছিল, আপনি রক্ষা পাইলেন। আমি আপনার কিছুই করিতে পারি নাই। দরিদ্র ব্রাহ্মণ, আমি কোথায় কি পাইব? তবে, যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তাহা হইলে একটি ভিক্ষা আপনার নিকট আমি প্রার্থনা করি।”

 নিধিরাম জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কি মহাশয়? আজ্ঞা করুন। ক্ষমতা থাকিলে অবশ্য আপনার আজ্ঞা পালন করিব।”

 এককড়ি বলিলেন,— “ক্ষমতা আপনার সম্পূর্ণ আছে। মনে করিলেই আপনি করিতে পারেন। সত্য করুন যে, আপনি করিবেন, তাহা হইলেই বলি।”

 নিধিরাম বলিলেন,— “ক্ষমতা থাকিলে নিশ্চয় আপনার আজ্ঞা প্রতিপালন করিব।”

 এককড়ি বলিলেন,— “আমি কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র কুলীন ব্রাহ্মণ। টাকার অভাবে কন্যার বিবাহ দিতে পারি নাই। আপনি মহাকুলীন, স্বমেল স্বভাব। আপনাতে কন্যা অৰ্পণ করিলে আমার কুল রক্ষা হয়, পিতৃপুরুষদিগের মুখ উজ্জ্বল হয়। আপনি আমাকে কন্যাদায় হইতে উদ্ধার করেন, আপনার নিকট আমার এই ভিক্ষা।”

 নিধিরাম স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। হিরন্ময়ীর রূপে-গুণে তিনি মুগ্ধ হইয়াছিলেন। হিরণয়ীকে দেখিয়া পর্য্যন্ত তাহার চিত্ত বিচলিত। তবে অধিক বয়স হইয়াছে। এ-বয়সে এরূপ লাবণ্যবতী বালিকাকে বিবাহ করা উচিত নয় বলিয়া হিরণ্ময়ীর চিন্তা মন হইতে দূর করিতে সর্ব্বদাই চেষ্টা তিনি করিতেছিলেন। সেই জন্যই পীড়া হইতে উঠিয়া সম্পূর্ণভাবে পূর্ব্বারূপে বল পাইতে না পাইতে, এ-স্থান হইতে পলাইতেছিলেন। সংসার একেবারে পরিত্যাগ করিয়া দেশপর্য্যটন, তীর্থদর্শন প্রভৃতি ধর্ম্মকর্ম্মে অবশিষ্ট জীবনযাপন করিবেন, এইরূপ মনে মনে সঙ্কল্প করিয়াছিলেন।

 নিধিরাম বলিলেন,— “মহাশয়! আমার বয়স হইয়াছে। পুনরায় বিবাহ করিবার সময় নাই। বিশেষতঃ আপনার কন্যা হিরণ্ময়ী পরম রূপবতী, কিছুতেই আমি তাহার উপযুক্ত নই। আর সংসার করিব না, এইরূপ সঙ্কল্প করিয়াছি। অতএব এ অনুরোধটি আমাকে করিবেন না। আমাকে ক্ষমা করুন।”

 এককড়ি বলিলেন,— “আপনি এইমাত্র সত্য করিলেন। দরিদ্র ব্রাহ্মণকে কন্যাদায় হইতে উদ্ধার না করিলে আপনি সত্যে পতিত হইবেন। আপনার বিবাহ করিবার বয়স যায় নাই। আপনার মত পাত্র পাইলে হিরণ্ময়ীকে ভাগ্যবতী বলিয়া জানিব। সত্যভ্রষ্ট হইবেন না।”

 নিধিরাম বলিলেন,— “আপনি আমাকে ঘোর বিপদে ফেলিলেন। হিরণ্ময়ী রূপবতী, আমি কিছুতেই তাহার উপযুক্ত পতি নই। আমাকে ক্ষমা করুন।”

 এককড়ি বলিলেন,— “আপনার আর বিপদ কি? বিপদ আমার। কন্যাদায়গ্রস্ত হইয়া আজি কয় বৎসর আমি লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরিতেছি। কিন্তু আমার টাকা নাই। বিনা টাকায় কেহ বিবাহ করিবেন না। সম্প্রতি আমি জয়দেপুরে গিয়াছিলাম। সেখানকার জমীদার আমাদের ঘর। তিনি এই গ্রামে বিবাহ করেন। তাঁহার পুত্র নবীন যেমন কুলে-শীলে, সেইরূপ রূপে-গুণে সুপাত্র। সে মাতুলালয়ে আসিয়াছিল। গৃহিণীর বড় সাধ হইল যে, তাহাকে জামাতা করেন। আমি তাহার পিতার নিকট গিয়া হাতে পৈতা জড়াইয়া কত কাঁদিলাম। তিনি তিন হাজার টাকা চাহিলেন! তিন হাজার টাকা কোনও পুরুষে কখনও চক্ষে দেখি নাই। যেমন উচ্চ আশা করিয়াছিলাম, সেইরূপ ফল পাইয়া আস্তে আস্তে ফিরিয়া আসিলাম।”

 এককড়ি পুনরায় বলিলেন,— “তাহার পর আবার বিপদের উপর বিপদ। এই গ্রামে বদরুদিন সেখ বলিয়া একজন ডাক্তার আছেন। এখন আর তিনি বদরুদিন নাই। চিকিৎসা করিয়া তিনি অনেক অর্থ উপাৰ্জ্জন করিয়াছিলেন। ক্রমে জমীদারী কিনিলেন, এই স্থানে ইমারত বাড়ী করিলেন, ও টাকার মহাজনী করিতে লাগিলেন। তিনি এখন অনেক টাকার মানুষ! যখন তাহার অনেক টাকা লইল, তখন তিনি “বদরুদিন সেখ” নাম ছাড়িয়া “বৈদ্যনাথ সেন” নাম লাইলেন। টাকা হইলে কি না হয়? ব্রাহ্মণ কায়স্থ সকলেই তাঁহাকে লইয়া চলিতে লাগিল। কিছুদিন পরে একগাছা সূতা তিনি পরিলেন। প্রথম প্রথম সূতাগাছটি কোমরে রাখিতেন, নাভির উপরে তুলিতেন না। ক্রমে আস্তে আস্তে সূতাগাছটি কাঁধের উপর তুলিলেন। তখন সেটি যজ্ঞোপবীত হইয়া দাঁড়াইল। সেই সময় তিনি “সেন” ছাড়িয়া “শর্ম্মা” উপাধি গ্রহণ করিলেন। আজকাল তিনি “দেব-শর্ম্ম।” হইয়াছেন। এখন তাঁহার নাম বৈদ্যনাথ দেব-শর্ম্মা। তাহার পুত্র গবীরুদিন এখন গোবিন্দচন্দ্র দেবশর্ম্মা হইয়াছেন। বেশ চলিয়া গিয়াছেন। কোনও উৎপাত নাই। গোপীকৃষ্ণ চক্রবর্ত্তীর কন্যার সহিত গোবিন্দচন্দ্রের বিবাহ হয়। সেই উপলক্ষে দেশদেশান্তর হইতে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত জমা হইয়াছিলেন। এক এক ঘড়া আর দশ দশ টাকা হইতে একশত টাকা নগদ দিয়া পণ্ডিতসমাজকে বিদায় করিয়াছিলেন। চারিদিকে একেবারে ধন্য ধন্য পড়িয়া গিয়াছিল। গোবিন্দচন্দ্রের সম্প্রতি গৃহশুন্য হইয়াছে। হিরণ্ময়ীর রূপের কথা শুনিয়া হিরণ্ময়ীকে বিবাহ করিবেন এই তাঁহার একান্ত ইচ্ছা। হিরণ্ময়ীর সহিত বিবাহ না দিলে তিনি আত্মহত্যা হইয়া মরিবেন, বাপ-মার এই কথা বলিয়াছিলেন। আমি বৈদ্যনাথ দেবশৰ্মার ৫০০ টাকা ধারি। তিনি আমার নামের ডিক্রি করিয়া রাখিয়াছেন। তিনি আমাকে ডাকাইয়া প্রথম নানা প্রলোভন দেখাইলেন। অনেক টাকা দিবেন, অনেক গহনা দিবেন, কত কি বলিলেন। আমি যখন তাঁহার কথায় স্বীকৃত হইলাম না, তখন নানারূপ ভয় দেখাইলেন। আমাকে জেলে দিবেন, বৃদ্ধবয়সে কয়েদখানায় পাঠাইবেন, এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন। আজ যেন তিনি বৈদ্যনাথ দেবশর্ম্মা হইয়াছেন, কিন্তু আমি ত’ জানি তিনি কে? না হিন্দু, না মুসলমান, না ব্রাহ্মণ, না কায়স্থ। প্রাণ থাকিতে তাঁর ঘরে আমি কি করিয়া কন্যা দিই? এখন বুঝিয়া দেখুন, আমি কিরূপ বিপদে পড়িয়াছি। আপনি যদি উদ্ধার করেন, তবেই হয়।”

 ব্রাহ্মণের বিপদের কথা শুনিয়া নিধিরাম অনেকক্ষণ মৌন থাকিয়া অবশেষে বলিলেন;— “আচ্ছা মহাশয়! ক’ল্য আপনাকে আমি একথার উত্তর দিব।”