ভূত ও মানুষ/বাঙ্গাল নিধিরাম/পঞ্চম অধ্যায়


পঞ্চম অধ্যায়

ঐ গাছে

সন্ধ্যার সময় কতকগুলি ব্রাহ্মণ এই স্থানে মড়া পোড়াইতে আসিয়াছিলেন। সেদিনকার ঘোর দুর্য্যোগে তাহাদিগের কাপড় ভিজিয়া গিয়াছিল। কাঠ, পাতা, সমস্ত ভিজিয়া গিয়াছিল। তাহারা চিতা সাজাইলেন। মড়াটি চিতার উপরে রাখিলেন, কিন্তু আগুন কিছুতেই ধরাইতে পারিলেন না। সেই ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে কর্ত্তা-ব্যক্তি ছিলেন—উদ্ধবদাদা। মড়াটি না পোড়াইয়া জলে ফেলিয়া দিবার নিমিত্ত উদ্ধবদাদা প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু আর সকলে সে কথায় সম্মত হইলেন না। অবশেষে উদ্ধবদাদা বলিলেন,— “তা যদি না করিবে, তবে চল, এই গ্রাম হইতে শুষ্ক কাঠ, পাতা ও পাঁকাটি লইয়া আসি। আর অমনি মদ খাইয়া আসি বৃষ্টিতে ঠিক যেন ভিজা বিড়াল হইয়া গিয়াছি। হাড়ের ভিতর কনকন করিতেছে।” মদের নাম শুনিয়া সকলে একবাক্য হইয়া সম্মত হইলেন। তার উপর পড়িয়া রহিল, কাছে কেহ রহিল না। একক্রোশ মাঠ পার হইয়া সকলে গিয়া উপস্থিত হইলেন। শুঁড়ির দোকানে বসিয়া মনের সুখে খাইতে লাগিলেন। তাহার পর, ক্রমে সেই তুমুল ঝড় উঠিল। তখন আর ঘরের বাহিরে যায় কার সাধ্য! সুতরাং সকলকে বসিয়া বসিয়া একটু ভাল করিয়া মদ খাইতে হইল। রাত্রি প্রায় দুইটার সময় ঝড় থামিল। তখন লোকের গোয়াল হইতে পাকাটি ও পাতা চুরি করিয়া উদ্ধবদাদার দল পুনরায় শ্মশান অভিমুখে যাত্রা করিলেন। রাস্তায় টলিতে টলিতে কেহ গান করিতে লাগিলেন, কেহ বাজে বকিতে লাগিলেন। বক্তা সকলেই, শ্রোতা কেহই নয়।

 একজন বলিলেন,— “উদ্ধবদাদার মদ চুকু খাওয়া আছে, আবার টিকিটও রাখা আছে।” উদ্ধবদাদা উত্তর করিলেন,— “ওহে, তোমাদের টিকি না রাখিলে চলে, আমার চলে না। বংশজ ব্রাহ্মণ, বিয়ে হয় নাই। কাওরাণীর ঘরে থাকি, দেখা-সাক্ষাৎ কাওরাণীর ভাত খাই। কেহ কিছু গোল তুলিলে অমনি টিকিট খাড়া করিয়া ধরি। বলি, “এই দেখ, বাবা, টিকি আছে।” আমনি সবাই চুপ, আর কথাটি কবার যো থাকে না।”

 কেহ কিছু গোল তুলিলে অমনি টিকিট খাড়া করিয়া ধরি। বলি— “এই দেখ বাবা, টিকি আছে।”

 আর একজন বলিলেন,— “কেন? ফোঁটা কাটিলেই তো হয়? রামেশ্বর খুড়োর মত ফোঁটা দেখাইলেই তো চলে?”

 উদ্ধবদাদা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “রামেশ্বর খুড়ো কি করিয়াছিলেন?”

 লোকটি বলিল,— “রামেশ্বর খুড়োর নাতনীর বিবাহের কথা হইতেছিল। পাত্রপক্ষীয়

লোকেরা কন্যা দেখিতে আসিবেন। রামেশ্বর খুঁড়োর ছেলে কিনু বলিল,— “বাবা! আজ আর মন্দ খাইও না। বাড়ীতে আজ দুই জন ভদ্রলোক আসিবে, একটা দিন নাই খাইলে?”

 “রামেশ্বর খুড়ো বলিলেন,—'রাম রাম! আজি কি মদ খাইতে পারি? যাই, সকাল সকাল স্নান করিয়া আসি। তুমি জলখাবার আর রান্না-বান্নার যোগাড় করিয়া দাও।' এই বলিয়া রামেশ্বর খুড়ো স্নান করিতে গেলেন। স্নান-টান কিছুই নয়, আস্তে আস্তে গিয়া শুঁড়ির বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন। সেই স্থানে দুই প্রহর পর্যন্ত বসিয়া মদ খাইতে লাগিলেন। এদিকে নাতিনীকে দেখিতে ঘরে সেই ভদ্রলোকেরা আসিয়াছেন। ‘কর্ত্তা কোথায়’ বলিয়া কিনুকে তাহারা বারবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। 'স্নান করিতে গিয়াছেন, এখনি আসিবেন’ এইরূপ বলিয়া কিনু তাহাদিগকে বুঝাইতে লাগিলেন। দুই প্রহর হইয়া গেল, রান্না প্রস্তুত, তবুও কর্ত্তার দেখা নাই। যা হইয়াছে, কিনু তাহা বুঝিলেন। বাড়ি আসিয়া পাছে ভদ্রলোকদিগের সমক্ষে ঢলঢলি করেন, সে জন্য পিতাকে সাবধান করিবার নিমিত্ত কিনু শুঁড়ির বাড়ীর দিকে চলিলেন। শ্রদ্ধাস্পদ পিতার সহিত পথে সাক্ষাৎ হইল। বগলে একবোতল মদ লইয়া টলিতে টলিতে আসিতেছেন। কিনু বলিলেন, —'বাবা! তোমার কি মান অপমানের ভয় একেবারেই গিয়াছে? তোমাতে আর কি কোনও পদার্থই নাই? এই বৃদ্ধ বয়সে তোমার কি জ্ঞানগোচর একেবারেই গিয়াছে?' রামেশ্বর খুড়ো বলিলেন,— 'কেন বাবা! হইয়াছে কি? এত রাগ কেন?' কিনু উত্তর করিলেন,—'হইয়াছে কি? বগলে ও কি!' রামেশ্বর খুড়ো বলিলেন,—'বগলে এ কি! বটে! আর কপালে এ কি? এটি দেখিলে আর ওটি বুঝি দেখিলে না।' রামেশ্বর খুড়ো শুঁড়ির বাড়ী হইতে বাহির হইয়া, পানাপুকুর হইতে একটু লইয়া কপালে একটি ফোটা কাটিয়াছিলেন। ছেলেকে সেই ফোঁটাটি দেখাইলেন। টিকি না রাখিয়া ফোঁটা কাটিলেও চলে, না চলে এমন নয়।

 আর একজন বলিলেন,— “মড়াটা যারা পোড়ায়, টিকি রাখা তাদের পক্ষে ভাল নয়। একবার একটা মড়া দানো একজনের টিকি ধরিয়াছিল। আর একটু হইলেই তাহার ঘাড়টি ভাঙ্গিয়া দিত। ভাগ্যে তাহার কোমরে একখানি কাস্তে ছিল, চট্‌ করিয়া সে কাস্তেখানি বাহির করিয়া টিকিটি কাটিয়া ফেলিল, তাই তার প্রাণ বাঁচিল।”

 আর একজন বলিলেন,—“ভাই! আমাদের মড়া যদি দানো পাইয়া থাকে? যদি গিয়া দেখি, চুলির উপর মন্দারাম গাঁটু হইয়া বসিয়া আছেন? তাহা হইলে কি হইবে?”

 সকলের মুখ শুকাইয়া গেল। তাই তো! বড় ভয়ের কথা বটে! মড়াটি দানো পাইয়া থাকুক, আর নাই থাকুক, কিন্তু চিতার উপর নাই। বোধ হয়, শৃগালে টানিয়া লইয়া গিয়াছিল। যাহা হউক, উদ্ধবদাদা প্রভৃতি সকলে আসিয়া দেখিলেন যে, চিতাটি খালি পড়িয়া রহিয়াছে। চারিদিকে তাহারা মড়া খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। নিকটে একটি ঝোঁপ দেখিতে পাইয়া, একজন সেই ঝোঁপের ভিতর প্রবেশ করিলেন। গাছপানে চাহিয়াই তিনি “আঁ আঁ” করিতে করিতে বাহিরে আসিয়া ধড়াস করিয়া পড়িলেন। “কি হইয়াছে? কি হইয়াছে?” বলিয়া আর সকলে তাঁহার নিকট দৌঁড়িয়া আসিলেন। পড়িয়া পড়িয়া সে লোকটি “গোঁ-গোঁ” করিতে লাগিলেন, কোনও উত্তর করিতে পারিলেন না। মুখে-হাতে জল দিয়া সকলে তাহাকে চেতন করিলে, তিনি বলিলেন,—“ঐ গাছে!” সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“গাছে কি? গাছে কি দেখিয়াছ?” কিন্তু সে লোকটি আর কিছুই বলিতে পারেন না। “ঐ গাছে!” এই কথা সকলে উদ্ধব দাদাকে বলিলেন,— “উদ্ধব দাদা! তুমি গিয়া দেখিয়া এস, গাছে কি আছে।” উদ্ধব দাদা উত্তর করিলেন,—“তোমরা যাও না কেন? মড়া পোড়াইতে আসিয়াছি, তা বলিয়া নিজের কাঁচা মাথাটি বাড়াইয়া দিতে পারি না।” এ বলে তুমি যাও; ও বলে তুমি যাও; কিন্তু যাইতে কাহারও সাহস হয় না। অবশেষে সকলে একসঙ্গে গাছের নিকট যাইলেন। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় না, তথাপি সকলে জানিতে পারিলেন যে, গাছের ডালে একটি মানুষের মত কি বসিয়া রহিয়াছে। সকলে নিশ্চয় বুঝিলেন যে, তাঁহাদের মড়াটি দানো পাইয়া গাছে বসিয়া আছে। গাছ হইতে লাফ দিয়া এখনও খাইতে কি ঘাড় ভাঙ্গিতে আসিল না, সেজন্য সকলের মনে অনেকটা সাহসী হইল। দানো পাইলো যেরূপ প্রতিকার করিতে হয়, তখন সকলে সেইরূপ করিতে আরম্ভ করিলেন। দা, কোদাল, কুঠারি যাহার হাতে যা ছিল, সেই সকল ছুড়িয়া মারিতে লাগিলেন। গাছে নিধিরাম বসিয়া ছিলেন। গাছে বসিয়া তাঁহাদের কথাবার্ত্তা তিনি কতক কতক শুনিয়াছিলেন।

 নিধিরাম বলিলেন,— “মহাশয়গণ! আমাকে মারিবেন না। আমি আপনাদের মড়া নাই। আমি পথিক ব্রাহ্মণ, আজ রাত্রির ঝড়ে আমার নৌকা ডুবিয়া গিয়াছে। অতি কষ্টে আমার প্রাণ বঁচিয়াছে। প্রাতঃকালের প্রতীক্ষায় আমি এই গাছে বসিয়া আছি।”

 সকলে বলিলেন,— “আমাদের মড়া নয়, তবে শালা তুই কাদের মড়া? দানো পাইয়া মনের সুখে গাছে বসিয়া আছেন, আবার বলেন কি না,—'আমি তোমাদের মড়া নাই, আমি পথিক ব্রাহ্মণ!' নামিয়া আয়, শালা, শীঘ্র নামিয়া আয়!”

 নিধিরাম আস্তে আস্তে গাছ হইতে নামিয়া আসিলেন, যদিও অন্ধকার, তথাপি উদ্ধব দাদা প্রভৃতি সকলে দেখিলেন যে, লোকটি প্রকৃতই তো মড়া নয়। সকলে ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। সঙ্গে যে বোতল আনিয়াছিলেন, সকলে তাহা হইতে এক-আধা ঢোক মদ খাইলেন। পুনরায় মদ খাইয়া বুদ্ধি যখন উত্তমরূপে পাকিয়া উঠিল, তখন উদ্ধব দাদা বলিলেন,— “তা তুমি আমাদের মড়া হও আর নাই হও আমরা পোড়াইতে বাধ্য হইতেছি। কারণ, আমাদের নিজের মড়া কোথায় গিয়াছে, তাহার ঠিক নাই।”

 নিধিরাম বলিলেন,— “সে কি মহাশয়! আমি জীয়ন্ত মানুষ, আমাকে পোড়াইবার কথা কি বলেন! তামাসা করিতেছেন বুঝি?”

 উদ্ধব দাদা উত্তর করিলেন,— “তুমি আমার শালাসম্বন্ধী কিছুই নাও যে, তোমার সহিত তামাসা করিব! আমরা মড়া পোড়াইতে আসিয়াছি। শুধু হাতে কি করিয়া ঘরে ফিরিয়া যাই? তুমিই বুঝিয়া দেখ, সেটা কি ভাল কাজ হয়? অবুঝের মত কথা বলিও না। চল, ভালমানুষের মত পুড়িবে চল। গণ্ডগোল করিও না। চল যাদু, পুড়িবে চল।”

 নিধিরাম প্রথমে তামাসা মনে করিয়াছিলেন। অবশেষে বুঝিলেন যে, মাতালেরা সত্য সত্যই তাঁহাকে পোড়াইবে। তিনি অনেক অনুনয়-বিনয় করিলেন। পলাইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। মাতালেরা বলপূর্ব্বক তাঁহাকে ধরিয়া চিতায় শয়ন করাইল, চিতার সহিত বাঁধিয়া দিল, নিম্নে পাতা ও পাকাটি দিয়া তাহাতে আগুন ধরাইয়া দিল।

 প্রাণে একবারে হতাশ হইয়া, নিধিরাম বলিলেন,—“যদি আমি তোমাদের মড়াই হইলাম, তবে আমাকে স্নান করাইয়া তাহার পর পোড়াও। সকলেই জানে যে মাড়াকে স্নান করাইয়া তাহার পর পোড়াইতে হয়।”

 সকলে বলিলেন,— “হা! একথা সত্য বটে। মড়াকে স্নান করাইয়া পোড়াইতে হয়।”

 আগুন নিবাইয়া নিধিরামকে চিতা হইতে তাহারা উঠাইলেন ও দুই জনে দুই হাত ধরিয়া তাহাকে স্নান করাইতে যাইলেন।

 নদীতে উপস্থিত হইয়া নিধিরাম বলিলেন,— “একবার ছাড়িয়া দাও, একটি ডুব দিই।”

 নিধিরাম ডুব দিলেন, কিন্তু আর উঠিলেন না। “মড়া পলাইল,” বলিয়া সকলে গোল করিয়া উঠিলেন। কিন্তু অন্ধকারে নিধিরামের সন্ধান তাহারা আর পাইলেন না। নিধিরাম নদীর স্রোতে ভাসিয়া চলিলেন। অনেকদূরে তিনি পুনরায় নদীর তীরে গিয়া উঠিলেন। কিন্তু সমস্ত রাত্রি জলে ভিজিয়া ও নানারূপে কষ্ট পাইয়া নিধিরামের শরীর একেবারে অবশ হইয়া গিয়াছিল! উপরে উঠিয়া তিনি অধিক দূর যাইতে পারিলেন না। তাঁহার ঘোরতর কম্প উপস্থিত হইল। সেই মাঠের উপর শুইয়া পড়িলেন। শয়ন করিতে না করিতে অজ্ঞান হইয়া যাইলেন।

 নদীর উপর প্রায় একক্রোশ মাঠ! মাঠের পর একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম। গ্রামখানিতে কেবল চণ্ডাল ও মুসলমানের বাস। রাত্রিতে ঝড় হইয়াছিল। অনেক ডুবিয়া থাকিবে, জলমগ্ন নৌকায় দ্রব্যাদি পাইবে, এই আশায় প্রাতঃকাল হইতে না হইতে গ্রামের লোকে নদীর ধারে আসিয়াছিল। চণ্ডালেরা মৃতপ্রায় ভূতলশায়ী নিধিরামকে দেখিতে পাইল। তখনও তাঁহার দেহে প্রাণ ছিল। কোমরে তাহার টাকা আছে দেখিয়া কাহারও কাহারও লোভ হইল। তাহার নির্জ্জীব দেহটি নদীতে ফেলিয়া দিয়া টাকাগুলি লইবার নিমিত্ত কেহ কেহ পরামর্শ করিল। কিন্তু সেই চণ্ডালদিগের মধ্যে দুই-একজন বৃদ্ধ ছিল। নিধিরামকে ব্রাহ্মণ দেখিয়া, তাহারা এ প্রস্তাবে সম্মত হইল না; নিধিরামকে তাহারা বাটী লইয়া যাইল। অগ্নির উত্তাপ দিয়া ও নানারূপ সেবা করিয়া তাহারা নিধিরামকে কিঞ্চিৎ সুস্থ করিলা বটে, কিন্তু তাহার চেতন হইতে না হইতে জ্বর-বিকার উপস্থিত হইল। অনেক দিন তিনি এই চণ্ডালের গৃহে অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া রহিলেন। সম্পূর্ণভাবে আরোগ্যলাভ করিতে প্রায় একমাস অতীত হইয়া গেল। আরোগ্যলাভ করিলে, চণ্ডালেরা তাঁহাকে একখানি নৌকা করিয়া দিল, সেই নৌকা করিয়া নিধিরাম পুনরায় রামনগর অভিমুখে যাত্রা করিলেন।