ভূত ও মানুষ/বাঙ্গাল নিধিরাম/ষষ্ঠ অধ্যায়


ষষ্ঠ অধ্যায়

আড় কাটায়

নিধিরামের নিকট অনেক টাকা আছে, নৌকার মাঝিরা কেহ কেহ একথা শুনিয়াছিল। একদিন রাত্রিকালে নৌকার তলদেশে ছিদ্র করিয়া তাহারা নৌকাখানি ডুবাইবার উপক্রম করিল। শরীরে জল লাগিতেই নিধিরামের সহসা নিদ্রাভঙ্গ হইল। নৌকখানি সম্পূর্ণভাবে ডুবিতে না ডুবিতে তিনি জলে ঝাঁপ দিলেন। দাড়ি-মাঝিরাও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে জলে পড়িয়া তাঁহাকে ধরিল।

 কেহ হাত কেহ পা ধরিয়া জলে ডুবাইয়া তাহার প্রাণবধ করিতে চেষ্টা করিল। বাঁচিবার নিমিত্ত সেই অন্ধকার রাত্রিতে জলের মাঝখানে নিধিরাম মাঝিদের সঙ্গে ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু তিনি একলা, মাঝিরা চারিজন, কতকক্ষণ আর তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে পরিবেন? বারবার তাঁহাকে জলে ডুবাইয়া ক্রমে নির্জ্জীব করিয়া ফেলিল। আর অল্পক্ষণ পরেই মাঝিরা তাঁহার প্রাণবধ করিত, কিন্তু এই সময়ে কোথা হইতে একটি কুম্ভীর আসিয়া নিধিরামের

কোমর ধরিল ও লেজের আঘাতে দুই জন মাঝির প্রাণবধ করিল। নিধিরামকে কুমীরে লইয়া চলিল। একবার ডুবাইয়া পুনরায় যখন কুমীরে জলের উপর ভাসিল, তখনও নিধিরামের শরীরে প্রাণ ছিল। নিধিরামকে মুখে করিয়া কুমীর পুনরায় ডুবিল ও অল্পক্ষণ পরে নদীর তীরে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে নলের বন ছিল। নিধিরাম এক্ষণে মৃতপ্রায় হইয়াছিলেন, কিন্ত তথাপি জ্ঞান ছিল। কুমীর তাঁহার কোমর ছাড়িয়া পা ধরিল। মাটির ভিতর তাহার মুখ পুতিয়া তাহাকে মারিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিতে লাগিল। এই সময়ে নিধিরাম কুমীরের দুইটি উজ্জ্বল চক্ষু দেখিতে পাইলেন। কুমীরের চক্ষুতে অঙ্গুলি দিয়া অনেকের প্রাণরক্ষা হইয়াছে, তাহার সেই কথা মনে পড়িল। কুমীরের দুইটি চক্ষুতে তিনি দুইটি অঙ্গুলি প্রবিষ্ট করিয়া দিলেন। যাতনায় কুম্ভীর তাঁহাকে ছাড়িয়া জলে গিয়া পড়িল। কুমীরের কামড়ে নিধিরামের শরীর ক্ষতবিক্ষত হইয়া গিয়াছিল। তথাপি প্রাণের দায়ে কোনরূপে তিনি নল-বন পার হইয়া নদীর উপর গিয়া উঠিলেন। আর অধিক দূর যাইতে পারিলেন না। সেই স্থানে বসিয়া আপনার দূরদৃষ্টির বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। ভাবিলেন যে,— “হা ভগবান! আমার কপালে তুমি এত লিখিয়াছিলে? কিন্তু হিরণ্ময়ি! তোমার মত দুৰ্লভ রত্ন কি অনায়াসে লাভ হয়? তোমার জন্য, তোমার পিতার জন্য, যে আমি এই নিদারুণ ক্লেশ পাইতেছি, তাহাতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নাই, তাহাতে আমার সুখ। এখন, একবার তোমার পিতাকে উদ্ধার করিতে পারিলে হয়!”

 নদীর উপর যে স্থানে নিধিরাম বসিয়াছিলেন, সে স্থানটি জনশূন্য প্রান্তর। নিকটে মনুষ্যের বসবাস নাই। উপরে কেবল একটি ভগ্ন কালীর মন্দির ছিল। নিকটস্থ গ্রামসমূহ হইতে লোক আসিয়া কালে-ভদ্রে এই কালীর পূজা দিয়া থাকে। উপরে মন্দির আছে, কি, কি, আছে, নিধিরাম তাহার কিছুই জানেন না। রাত্রিকাল, অন্ধকার, কি করিয়া তিনি জানিবেন? একদল ডাকাত এই রাত্রিতে কোথায় ডাকাতি করিতে যাইতেছিল। কালীর পূজা দিয়া তবে তাহারা ডাকাতি করিতে যাইবে। মহা-সমারোহে কালীর পূজা হইতেছিল। যেখানে নিধিরাম বসিয়া আছে, সেই স্থানে দুই জন ডাকাত বলি দিবার নিমিত্ত পাঠা স্নান করাইতে আনিল। নিধিরামকে দেখিতে পাইয়া ধরিল। তাহারা বলিল,— “ভাই! মা’র কি কৃপা! মা আজ আমাদের মানুষপাঁঠা মিলাইয়া দিলেন। এখন বলি, হাঁ, কালী জাগ্রত বটে! অনেককাল পরে মা'র আজ নরবলি খাইতে সাধ হইয়াছে। আজ আমাদের অনেক টাকা মিলিবে।” নিধিরাম তাহাদিগের নিকট হাত-যোড় করিয়া কত মিনতি করিলেন, কিন্তু তাহারা কিছুতেই ছাড়িল না। তাহাকে ধরিয়া তাহারা মন্দিরের সম্মুখে দলের মাঝখানে লইয়া গেল। ডাকাতের দলে আর আনন্দের পরিসীমা নাই। মা নিজে আজ নরবলির যোগাড় করিয়াছেন। প্রাণরক্ষার নিমিত্ত নিধিরাম কত কি বলিলেন, কিন্তু কেহ তাঁহার কথায় কর্ণপাতও করিল না। ডাকাতদিগের পুরোহিত যথারীতি নিধিরামকে উৎসর্গ করিলেন। ডাকাতেরা তাহাকে ধরিয়া খর্পারে শোয়াইল। কেহ পায়ের দিক ধরিল, কেহ মাথার দিক ধরিল। ডাকাতদিগের সর্দার নিজে কোপ মারিবার নিমিত্ত খাড়া তুলিলেন। নিধিরাম বলপূর্ব্বক খর্পর হইতে মাথা সরাইতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন, আর বলিলেন,— “পাপিষ্ঠ নরাধমেরা! ব্রহ্মহত্যায় তোদের ভয় নাই?” কণ্ঠস্বর শুনিয়া ও মশালের আলোকে নিধিরামের মুখ দেখিয়া, ডাকাতদিগের সর্দ্দার খাড়া নামাইল। সর্দ্দার বলিল,— “ইহার। সর্ব্বশরীর ক্ষত-বিক্ষত, সর্ব্বশরীর হইতে ইহার রক্তধারা পড়িতেছে। মা'র নিকট এরূপ বলি কিছুতেই দেওয়া যাইতে পারে না। ইহাকে ছাড়িয়া দাও।” বিরাসবদনে ডাকাতেরা নিধিরামকে ছাড়িয়া দিল। নিধিরাম উঠিয়া দাড়াইলেন। সর্দ্দার বলিল,— “ব্রাহ্মণ! তোমার খুব পরমায়ু! এস, তোমাকে গ্রামে যাইবার পথ দেখাইয়া দিই।” একটু দূরে গিয়া উপস্থিত হইলে সর্দ্দার বলিল,— “আমি কে জোন? আমি উদ্ধব দাদা। মদ খাইয়া সে দিন তোমার প্রাণবধ করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম। ভাগ্যক্রমে সে দিন তুমি রক্ষা পাইয়াছিলে। আজ সাদা চক্ষে তোমার মাথা কাটিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না। যাও; কিন্তু অন্ধকার রাত্রি, মাঠের পথ তুমি দেখিতে পাইবে না। কোনও গাছতলায় পড়িয়া রাত্রিযাপন কর। প্রাতঃকাল হইলে যেখানে ইচ্ছা যাইও।”

 সকাল হইলে নিধিরাম অতিকষ্টে নিকটস্থ একটি গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কুমীরের কামড়ে সর্ব্বশরীর তাহার ক্ষত-বিক্ষত হইয়া গিয়াছিল। পথ চলিবার তাঁহার শক্তি ছিল না। এই গ্রামে এক সদ্গোপের বাড়ী গিয়া আশ্রয় লইলেন। সেই স্থানে থাকিয়া যথাবিধি আপনার চিকিৎসা করাইতে লাগিলেন। আরোগ্যলাভ করিয়া পুনর্ব্বার রামনগর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পথ চলিতে চলিতে বহুদূর চলিয়া যাইলেন। ক্রমে রামনগরের নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিলেন। এক-দিন সন্ধ্যাবেলা কোথাও বাসা না পাইয়া, তিনি একটি ব্রাহ্মণের বাড়ীতে অতিথি হইলেন। ব্রাহ্মণের দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ সাত বেটা। মকদ্দমা মামলা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, চুরি, ডাকাতি, সকল বিষয়ে তাহারা পরিপক্ক। কর্ত্তাটি মকদ্দমা করিতে রামনগর গিয়াছিলেন। পুত্রেরা নিধিরামকে চণ্ডীমণ্ডপে স্থান দিয়া আহারাদির সমুদয় আয়োজন করিয়া দিলেন। আহারাদি করিয়া নিধিরাম শয়ন করিয়া আছেন, এমন সময়ে পাশের একটি দ্বার দিয়া দুইটি বালক উঁকি মারিল! তারা দুই জনে বলাবলি করিতে লাগিলেন, —“ভাই! এই বামুনের কাছে অনেক টাকা আছে। আজ রাত্রিতে বাবা, কাকা, মিলিয়া ইহাকে মারিয়া ফেলিবেন। ইহার পালাইবার যো নাই। চারিদিকে তাঁহারা প্রহরা দিয়া আছেন। কি করিয়া মানুষ মারে, কখনও তাহা দেখি নাই। আয় ভাই, এক কর্ম্ম করি। আরও রাত্রি হইলে চুপি-চুপি বাটির ভিতর হইতে আসিয়া ঐ খড়ের গাদার ভিতর লুকাইয়া থাকিব। উহার ভিতর হইতে মানুষ মারা দেখিব।” নিধিরাম শুইয়া কথা শুনিলেন। প্রাণরক্ষার নিমিত্ত কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারেন না। চিন্তা করিয়া তিনি কোনওরূপে চণ্ডীমণ্ডপের আড়কাটার উপর উঠিয়া বসিয়া রহিলেন। রাত্রি যখন দুই প্রহর হইল, বাড়ীর কর্ত্তাটি রামনগর হইতে ফিরিয়া আসিলেন। চণ্ডীমণ্ডপের মাদুর ও বালিশ রহিয়াছে দেখিতে পাইলেন। মনে করিলেন, “রাত্রি অধিক হইয়াছে, কাহাকেও আর ডাকাডাকি করিব না। এইখানেই শুইয়া থাকি।” চাদর মুড়ি দিয়া নিধিরামের বিছানায় বাড়ীর কর্ত্তাটি শুইয়া রহিলেন। ঘোর রাত্রিতে ব্রাহ্মণের পুত্ররা লাঠি, বল্লম প্রভৃতি লইয়া চণ্ডীমণ্ডপের নিকট উপস্থিত হইল। দুই জন আস্তে আস্তে চণ্ডীমণ্ডপের উপর উঠিয়া তাঁহাদের নিদ্রিত পিতার মাথায় সবলে এক মুগুর মারিল। মস্তক একেবারে চূর্ণ হইয়া ব্রাহ্মণের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হইল। তাহার পর তাহারা ব্রাহ্মণের কোমরে হাত দিয়া টাকা অন্বেষণ করিতে লাগিল! কিন্তু টাকা পাইল না। ভাল করিয়া খুঁজিবার নিমিত্ত প্রদীপ আনিল। প্রদীপ আনিয়া দেখে না, পিতাকে হত্যা করিয়াছে! শোকে, ভয়ে, ক্রোধে সকলে আকুল হইয়া পড়িল। পথিক ব্রাহ্মণ কোথায় গেল? এই স্থানেই অবশ্য কোথায় লুকাইয়া আছে! এইরূপ চিন্তা করিয়া তাহারা প্রথমেই খড়ের গাদায় চারিদিক হইতে বল্লমের খোচা মারিতে লাগিল। খড়ের গাদার ভিতর হইতে বালক দুইটি ভয়ে “আঁ আঁ” করিয়া উঠিল, আর কিছুই বলিতে পারিল না। কিন্তু অধিক আর বলিতে হইলও না, সেই মুহূর্ত্তেই বল্লমের আঘাতে তাহারা প্রাণ পারিল যে, কি সর্ব্বনাশ হইয়াছে! তাহারা মনে করিল যে, বিধাতা আজ তাহাদের প্রতি নিতান্ত বিমুখ হইয়াছেন। প্রতিবাসীদিগের ভয়ে অধিক আর গোলমাল করিতে পারিল না। তিনটি মৃতদেহ লইয়া খিড়কির বাগানে পুতিতে যাইল।

 নিধিরাম আড়কাটার উপর বসিয়া এই সমুদয় ঘটনা দেখিতেছিলেন। এই লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিয়া ভয়ে তাহার শরীর কাঁপিতে ছিল। যখন তাহারা মৃতদেহ লইয়া খিড়কির বাগানের দিকে যাইল, তখন আস্তে আস্তে তিনি আড়কাটা হইতে নামিলেন, নামিয়া উৰ্দ্ধশ্বাসে রামনগরের দিকে দৌড়াইলেন। তাহার পরদিন রামনগরে উপস্থিত হইয়া প্রথমেই এককড়িকে কারাগার হইতে মুক্ত করিলেন। কারাগার হইতে মুক্ত হইয়া এককড়ি তাহাকে অগণ্য আশীর্ব্বাদ করিলেন। নিধিরাম বলিলেন,— “মহাশয়! আপনি আজ বাড়ী গমন করুন। আপনার নিমিত্ত বাড়ীতে সকলেই চিন্তিত আছেন। আমার এখানে বিশেষ কোনও কাজ আছে। দুই-চারি দিন পরে আমিও চণ্ডীপুরে গিয়া উপস্থিত হইব।” এককড়ি কি করিবেন? একেলা বাটী গমন করিলেন।