ভূত ও মানুষ/বাঙ্গাল নিধিরাম/সপ্তম অধ্যায়


সপ্তম অধ্যায়

অদৃষ্টের লেখা

নিধিরাম থানায় গিয়া গত রাত্রির সমুদয় ঘটনা পুলিশের নিকট জানাইলেন। সাতভেয়েরা বদমায়েশ বলিয়া পুলিশের নিকট বিশেষরূপে পরিচিত। নিধিরামকে সঙ্গে লইয়া পুলিশের লোকে সাতভেয়েদের বাড়ী গিয়া উপস্থিত হইল। খিড়কির বাগান খুঁড়িয়া তিনটি মৃতদেহ পাইল। সাত ভাই সকলকে বঁধিয়া রামনগরে চালান করিল। পুলিশের নিকট নিধিরামকে চারি দিন থাকিতে হইল। তাহার পর তিনি পুনরায় চণ্ডীপুর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। সমস্ত দিন পথ চলিয়া সন্ধ্যার সময় তিনি চণ্ডীপুরের নিকট একটি মাঠে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সে স্থান হইতে এককড়ির বাড়ী অধিক দূর নয়, প্রায় একপোয়া পথ। হনহন করিয়া মাঠটুকু পার হইতেছেন, এমন সময় স্ত্রীলোকের কাতরস্বর তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। “ওগো, কে যাও গো! আমাকে রক্ষা কর।” এই কয়টি কথা শুনিতে পাইলেন। তাহার পর “গো-গো” শব্দ হইতে লাগিল। যেন কেহ কাপড় দিয়া স্ত্রীলোকটির মুখ বন্ধ করিয়া দিল। নিধিরাম সেই দিক পানে দৌড়িলেন!। নিকটে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে, চারি জন লোক একটি শায়িতা স্ত্রীলোককে কাঁধে করিয়া বলপূর্ব্বক লইয়া যাইতেছে ও একজন কাপড় দিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে। নিধিরাম বলিলেন,— “এ কি? কে তোমরা?” তাহাদের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিল,— “সেই বাঙ্গাল শালা রে! বেটা হিরণ্ময়ীকে বে করিবেন। বামন হইয়া চাঁদে হাত! মার বেটাকে।”

যখন এককড়ি বাড়ী ফিরিয়া আসিলেন, তখন বদরুদ্দিন অর্থাৎ বৈদ্যনাথ দেবশর্ম্মার ঘরে বড়ই ভাবনা উপস্থিত হইল। বৈদ্যনাথ মনে করিয়াছিলেন যে, অধিক দিন কারাগারের কষ্ট সহ্য করিতে না পারিয়া এককড়ি হিরণ্ময়ীর সহিত তাঁহার পুত্র গবীরুদিন অর্থাৎ গোবিন্দচন্দ্রের

বিবাহ দিতে স্বীকৃত হইবেন। কিন্তু তাহা হইল না। হতাশ গোবিন্দ একেবারে পাগল হইয়া উঠিলেন। বলপূর্ব্বক হিরণ্ময়ীকে লইয়া বিবাহ করিবেন, তিনি এইরূপ সঙ্কল্প করিলেন। টাকা দিয়া চারি জন ইতর লোককে বশ করিলেন। পাঁচ জনে হিরণ্ময়ীকে ধরিবার নিমিত্ত সুযোগ খুঁজিতে লাগিলেন। দৈবক্রমে আজ হিরণ্ময়ী সন্ধ্যার পর একটু বাড়ীর বাহিরে আসিয়াছিলেন। সেই অবসরে পাষণ্ডেরা তাঁহাকে ধরিল ও মুখে কাপড় দিয়া মাঠের দিকে লইয়া চলিল। বাটীর লোক কি গ্রামের লোক কেহই ইহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিলেন না। মাঠের মাঝখানে উপস্থিত হইলে, দৈবক্রমে হিরণ্ময়ীর মুখের কাপড় একটু আলগা হইয়া গিয়াছিল। তাই তিনি একবার চীৎকার করিতে পারিয়াছিলেন। দৈবক্রমে সেই সময় নিধিরামও মাঠ দিয়া যাইতেছিলেন।

 গোবিন্দের কথা শুনিয়া নিধিরাম বুঝিলেন যে, তাহারা হিরণ্ময়ীকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে। নিমিষের মধ্যে তিনি এক ঘা লাঠি মারিয়া দুইটি লোককে ভূতলশায়ী করিলেন। বাকি তিনজন হিরণ্ময়ীকে ছাড়িয়া নিধিরামের উপর লাঠি-বর্ষণ করিতে লাগিল। “কে কোথা আছে গো! এস গো! ওগো, এখানে সর্ব্বনাশ হয় গো|” এই বলিয়া হিরণ্ময়ী চীৎকার করিতে লাগিলেন। দূর হইতে কে শব্দ করিল,—“যাই, যাই, ভয় নাই।” এইরূপ শব্দ শুনিয়া গোবিন্দ ও তাহার সঙ্গিগণ পলাইল। নিধিরামের লাঠিতে যে দুই জন প্রথমেই মাটিতে পড়িয়া গিয়াছিল, তাহারাও উঠিয়া পলাইল।

 গোবিন্দ ও তাহার সঙ্গিগণ যখন পলাইয়া গেল, তখন হিরণ্ময়ী দেখিলেন যে, নিধিরাম মাটিতে পড়িয়া রহিয়াছেন। তাড়াতাড়ি হিরন্ময়ী গিয়া তাঁহার মাথাটি তুলিয়া ধরিলেন। দেখিলেন, তাঁহার জ্ঞান নাই, সর্ব্বশরীরে রক্তে প্লাবিত হইতেছে। কাঁদিতে কাঁদিতে হিরণ্ময়ী তাঁহাকে ডাকিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে দূর যে লোকটি সাড়া দিয়াছিলেন, উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িতে দৌড়িতে আসিয়া সেই স্থলে উপস্থিত হইলেন। তিনি অতি সুন্দর যুবাপুরুষ আর কেহ নয়, জয়দেবপুরের ধনবান কুলীনের ছেলে নবীন, যাহার মাতুলাশ্রয় চণ্ডীপুরে, যাহার সহিত হিরণ্ময়ীর বিবাহের কথা হইয়াছিল। নবীন আসিয়া উপস্থিত হইলে, হিরণ্ময়ী কাঁদিতে কাঁদিতে দুই-চারি কথায় তাহাকে ঘটনার বিষয় বলিলেন। নিধিরামের নাকে মুখে বুকে হাত দিয়া নবীন বলিলেন,— “বোধ হয়, ইনি এখনও জীবিত আছেন। কিন্তু অতি শীঘ্র ইহাকে গ্রামে লইয়া যাইতে হইবে। আমরা দুই জনে এত পথ লইয়া যাইতে পারিব না। রও, আমি লোক ডাকি।” এই বলিয়া নবীন চীৎকার করিয়া লোক ডাকিতে লাগিলেন।

 সন্ধ্যাবেলা হিরণ্ময়ী বাহিরে গিয়াছিলেন। সন্ধ্যার পর ক্রমে অন্ধকার হইয়া আসিল, তথাপি হিরণ্ময়ী ফিরিয়া আসিলেন না। এককড়ি ও তাঁহার গৃহিণী প্রথমে বাড়ীর আশেপাশে খুঁজিয়া দেখিলেন, কিন্তু তাঁহাকে পাইলেন না। কত ডাকিলেন, কিন্তু কোনও উত্তর পাইলেন না। মহা ভাবনা উপস্থিত হইল। প্রতিবাসিগণ চারিদিকে হিরণ্ময়ীকে খুঁজিতে দৌড়িল। যাহারা মাঠের দিকে খুঁজিতে আসিয়াছিলেন, তাহারা নবীনের চীৎকার শব্দ শুনিতে পাইল। যে স্থানে ভূতলশায়ী নিধিরামকে লইয়া হিরণ্ময়ী ও নবীন ছিলেন, সেই স্থানে আসিয়া তাহারা উপস্থিত হইল। ঘটনার বিষয় সকলে অবগত হইয়া ধরাধরি করিয়া মুমূর্ষ নিধিরামকে এককড়ির বাড়ীতে লইয়া গেল। প্রদীপ আনিয়া সকলে দেখিল যে, নিধিরামের আর কিছু বাকী নাই। বক্ষঃস্থলে প্রাণটুকু কেবল অল্পমাত্র ধুকধুক্‌ করিতেছে। মস্তক দুই-চারি স্থানে ফাটিয়া গিয়াছে, একটি চক্ষু বাহির হইয়া পড়িয়াছে, নাসিকা একেবারে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, দুই পাটি দন্ত একেবারে গিয়াছে। রক্তে রক্ত। নিধিরামের সেই সুন্দর, গৌরবান্বিত মুখখানি একেবারে পিণ্ডাকার হইয়া গিয়াছে। মনুষ্যের মুখ বলিয়া আর চিনিতে পারা যায় না।

 এককড়ির ঘরে সে রাত্রিতে কান্নাকাটি পড়িয়া গেল। যাহা হউক, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। নিধিরামকে বাঁচাইবার নিমিত্ত আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া সকলে যত্নবান হইলেন। সে রাত্রিতে নিধিরামের মৃত্যু হইল না। তাহার পরদিনও হইল না। তিন দিনের দিনও মৃত্যু হইল না। একটু যেন আশা হইল। কিন্তু জ্ঞান নাই, গোচর নাই, কিছু নাই। কেবল নিশ্বাসটি পড়িতেছে, এইমাত্র।

 হিরণ্ময়ী নিধিরামের সেবা করিতে লাগিলেন। হিরণ্ময়ী সর্ব্বদা অচেতন নিধিরামের নিকট বসিয়া থাকেন। নবীন প্রতিদিন নিধিরামকে দেখিতে আসেন। নিধিরামের নিকট অনেকক্ষণ ধরিয়া বসিয়া থাকেন। একদিন নবীন বলিলেন,—“হিরণয়ি! আমি শুনিয়াছি, তোমার সহিত আমার বিবাহের কথা হইয়াছিল। আমার পিতা অনেক টাকা চাহিয়াছিলেন, তাই হয় নাই। তখন যদি জানিতাম যে, তোমার কি অপূর্ব্ব রূপ, তুমি কি অমূল্য রত্ন, তাহা হইলে বাবাকে কি অমত করিতে দিতাম? মা-বাপের আমি একমাত্র সন্তান। আমাদের টাকা-কড়ির অভাব নাই। মায়ের নিকট কাঁদিয়া কাটিয়া যেমন করিয়া হউক, পিতাকে সম্মত করাইতাম। বড়ই দূরদৃষ্ট, হিরণ্ময়ি! যে, তোমার সহিত আমার বিবাহ হইল না।” হিরণ্ময়ী উত্তর করিলেন,— “মহাশয়! আমাকে ওরূপ কথা বলিবেন না।”

 হিরণ্ময়ী একথা বলিলেন বটে। কিন্তু সেই দিন তাহার চিত্ত একটু চঞ্চল হইল। একদিকে দরিদ্র, অৰ্দ্ধ বৃদ্ধ, একচক্ষুহীন, দন্তহীন, কিম্ভূতকদাকার ভয়াবহ নিধিরামের পিণ্ডাকার মুখ, অপরদিকে ধন-সম্পত্তি, নবযৌবনসম্পন্ন, রূপবান নবীনের মুখ। নিধিরাম না বাঁচেন, হিরন্ময়ীর এইরূপ একটু ইচ্ছা হইল। সেই দিন হইতে নিধিরামের সেবার একটু কমও পড়িল।

 তাহার পরদিন নবীন পুনরায় বলিলেন। সে দিন হিরণ্ময়ী আর তাঁহাকে বকিলেন না। তাহার পরদিন নবীন পুনরায় সেই ভাবের কথা বলিলেন। হিরণ্ময়ী ঘাড় হেঁট করিয়া শুনিতে লাগিলেন। চক্ষু দিয়া তাঁহার ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়িতে লাগিল। হিরণ্ময়ী অবশেষে উত্তর করিলেন,— “আমাকে এ সব কথা বলা বৃথা। আমি স্ত্রীলোক, আমার কি হাত আছে? আমার পিতা-মাতা আছেন, কিছু বলিতে হয়, তাহাদিগকে বলুন।” দুই দিন নবীন আর আসিলেন না। তাঁহাকে না দেখিয়া হিরণ্ময়ীর প্রাণ উদাস হইল। দুইদিন পরে নবীন আসিয়া হিরণ্ময়ীকে বলিলেন,— “আমি বাড়ী গিয়াছিলাম। তোমার সহিত বিবাহ-বিষয়ে আমার পিতামাতাকে সম্মত করিয়াছি। কিন্তু তোমার পিতা কিছুতেই সম্মত হইতেছেন না। তিনি বলিলেন,— “নিধিরামকে আমি কন্যা সমৰ্পণ করিয়াছি। নিধিরাম যদি এ যাত্রা রক্ষা না পান, তাহা হইলে জানিব, আমার কন্যা বিধবা হইয়াছে। বিধবা হইয়া কন্যা আমার ঘরে থাকিবে।” নবীন বিলাপ করিতে লাগিলেন, হিরণয়ীও কাঁদিতে লাগিলেন।

 যাহার পরমায়ু আছে, তাহাকে কে মারিতে পারে? নিধিরামের ক্রমে জ্ঞান হইল, নিধিরাম ক্রমে সুস্থ হইতে লাগিলেন। প্রায় একমাস পরে নিধিরাম উঠিয়া বসিতে পারিলেন। আরও কিছুদিন পরে তিনি একটু-আধটু চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতে সমর্থ হইলেন! নিধিরামের প্রাণ বাঁচিল বটে, কিন্তু তাঁহার রূপ দেখিলে আর জ্ঞান থাকে না। মাথায় ও মুখের চারিদিকে সেলাই করার মত দাগ। একটি চক্ষুতে ঢেলা বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। নাসিকাটি বিলুপ্তপ্রায়। দন্ত একটিও ছিল না। এরূপ কিম্ভূত-কদাকার রূপ কেহ কখনও দেখে নাই। দেখিলে ভয় হয়। “ইনি আমার পতি হইবেন!” এই কথা ভাবিয়া হিরণ্ময়ীর প্রাণ শিহরিয়া উঠিল।

 যে দিন হইতে নিধিরাম চেতন হইলেন, সেই দিন হইতে নবীন আর হিরণ্ময়ীর সহিত মনের কথা বলিতে পারিলেন না। নিধিরাম যখন একটু-আধটু বেড়াইতে সমর্থ হইলেন, তখন একদিন সুযোগ পাইয়া নবীন হিরণ্ময়ীকে বলিলেন,— “হিরণ্ময়ি! পৃথিবীতে আর আমাদের কোনও আশা-ভরসা নাই। তোমার নিকট দুইটা মনের কথা বলি, এরূপ অবসর আর পাইব না। আজ সন্ধ্যার পর যদি তুমি তোমাদের বাটীর পশ্চাতে অশ্বত্থতলায় একবার আসিতে পার, তাহা হইলে দুইটা মনের কথা বলিয়া তোমার নিকট হইতে চির বিদায় হই।

 হিরণ্ময়ী কোনও উত্তর করিলেন না। “যাইব কি না যাইব” সমস্ত দিন এই কথা ভাবিতে লাগিলেন। যাওয়া উচিত নয়, তাহা তিনি নিশ্চয় বুঝিলেন। কিন্তু পুনরায় ভাবিলেন,— “একবার যাই না কেন? একবার গিয়া চির বিদায় হইয়া আসি না কেন? তাহাতে আর দোষ কি?”