মণিপুরের সেনাপতি (শেষ অংশ)/উপসংহার
উপসংহার।
গত ৩১ শে জুলাই কলিকাতা হাইকোর্টের সুযোগ্য কৌন্সলি বাবু মনমোহন ঘোষ টিকেন্দ্রজিৎ, কুলাচ প্রভৃতির পক্ষ হইতে বড়লাটের নিকট লিখিত জবাব দাখিল করেন। ঘোষ মহাশয় জবাবে আইন-কানুন সম্বন্ধে অনেক অনেক কথা বিশদরূপে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। অধিকন্তু মণিপুররাজ্য যে স্বাধীন, সুতরাং সেই রাজ্যের উপর যে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন চলিতে পারে না, ধীরভাবে, বিশেষ বুদ্ধিমত্তার সহিত তাহা প্রতিপাদন করিয়াছিলেন; কিন্তু মহামতি বড়লাটের নিকট সে সকল আপত্তি যুক্তিযুক্ত বলিয়া প্রতীয়মান হয় নাই। টিকেন্দ্রজিৎ প্রভৃতি মণিপুরের রাজবংশধর গণ মহারাণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া, বৃটিশ রাজকর্মচারিদিগকে অন্যায়রূপে বধ করিয়াছেন, এই ধারণাই বড়লাটের মনে বদ্ধমূল হইয়াছিল। অতএব বড়লাট, মণিপুর কোর্টের রায় সম্পূর্ণ বাহাল না রাথিয়া, নিম্নলিখিতরূপে দণ্ডাজ্ঞা প্রচার করেন যে;— মণিপুরের সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ এবং বৃদ্ধ মন্ত্রি টঙ্গল জেনারেল প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইবে, আর মহারাজ কুলচন্দ্র সিংহ ও অঙ্গোসেনা যাবজ্জীবনের জন্য দ্বীপান্তর প্রেরিত হইবেন।
গত ৯ই আগষ্ট বড়লাট বাহাদুরের এই আদেশ তারযোগে মণিপুরের বর্তমান বৃটিশ শাসনকর্তার নিকট প্রেরিত হয়। গত ১৩ই আগষ্ট, অপরাহ্ন ৫ ঘটিকার সময় মণিপুরস্থ ইংরেজের “পলোখেলার" স্থানে টিকেন্দ্রজিৎ ও টঙ্গল জেনারেলের ফাঁসী হইয়া গিয়াছে। বীরবর টিকেন্দ্রজিতের দণ্ডাজ্ঞা বীরোচিত সাজসজ্জাতেই প্রতিপালিত হইয়াছিল। বধ্যভূমিতে মণিপুর সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ সিংহকে ৫০০ সশস্ত্র গােরা সৈনিক বেষ্টন করিয়া লইয়া আসিয়াছিল। সেনাপতি টিকেন্দ্রজিৎ বীরের ন্যায় নির্ভিক চিত্তে ইংরাজ-রাজের দণ্ডাজ্ঞা পালন করিলেন। অসংখ্য মণিপুরবাসী নর-নারীর সমক্ষে ফাঁসীকাষ্ঠে প্রাণ বিসর্জ্জন দিয় ইহজগতের সমস্ত কষ্ট হইতে পরিত্রাণ পাইলেন। এখন আর টিকেন্দ্রের জন্য কাহাকেও ভীত হইতে হইবে না— টিকেন্দ্রের অত্যাচারে আর এখন কোন রাজপুরুষকে ব্যতিব্যস্ত হইতে হইবে না। মহারাজ সুরাচন্দ্রকেও আর টিকেন্দ্রজিতের ভয়ে ভীত হইতে হইবে না। এখন মহারাজ সুরাচন্দ্র নির্ভিকচিত্তে মণিপুররাজ্যে রাজত্ব করিতে পারিলেই সুখের বিষয় বটে। এই মহারাজ সুরাচন্দ্রের জন্যইত মণিপুরের বিভ্রাট উপস্থিত। ইহার জন্যই আসামের চিফ কমিসনর মিঃ কুইণ্টনের মণিপুরের অভিযান, এবং তাহা হইতে বৃটিশ কর্ম্মচারীগণের হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটন। মহারাজা সুরাচন্দ্রের জন্যই ভারত-গভর্ণমেণ্টকে এত কষ্ট সহ্য করিতে হইল। কিন্তু এখন যদি আমরা সুরাকে পুনরায় মণিপুর রাজতক্তে উপবিষ্ট দেখিতে পাই, তবেই মনে করিব, বৃটিশ গভর্ণমেণ্টের কষ্ট সফল হইল, সুরাচন্দ্রেরও কষ্টের অবসান হইল। তাহা না হইলে মনে করিব, এ বহ্নি অনর্থক প্রজ্জ্বলিত হইয়াছিল, মণিপুর ছারখার করিয়া নির্বাপিত হইল!
বৃদ্ধ মন্ত্রী টঙ্গল জেনারেলের বয়স হইয়াছিল—পঞ্চাধিক অশীতি বর্ষ; চলচ্ছক্তি এক প্রকার রহিতই হইয়াছিল। শুনা যায়, ফাঁসীর সময় যখন তাঁহাকে বধ্যভূমিতে আনয়ন করা হয়, তখন তিনি চলিয়া আসিতে পারেন নাই,—যানে আবোহণ করাইয়া, অন্য লোক দ্বারা বহন করাইয়া আনা হইয়াছিল এবং বধকার্যের সময়েও অন্য লোকের সাহায্যে তাঁহাকে বধ-মঞ্চে উত্তোলন করা হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে যদি সত্য সত্যই টঙ্গলের অবস্থা এরূপ হইয়াছিল, তাহা হইলে, তাঁহাকে আর এই ভীষণ দণ্ডে দণ্ডিত না করিলেই ভাল হইত। আমাদের বিশ্বাস, আমাদের রাজপ্রতিনিধি লর্ড ল্যান্সডাউন ইহার বর্তমান অবস্থা জ্ঞাত ছিলেন না; যদি তাহা জানিতেন, তবে কখনই এই অর্ধ মৃতের উপর এরূপ কঠোর দণ্ডবিধান করিতেন না।
টিকেন্দ্রজিতের ফাঁসী হইবার পরদিবস তাহার শ্রাদ্ধ হইবে কি না, এই মত গ্রহণ করিবার জন্য মহারাজ সুরাচন্দ্রের নিকট তারে সংবাদ আইসে। মহারাজ সুরাচন্দ্র শ্রাদ্ধের অনুমতি প্রদান করিয়াছেন। তদনুসারে গত ২০ শে আগষ্ট টিকেন্দ্রজিতের শ্রাদ্ধকার্য্য সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে।
সম্পূর্ণ।