মণিপুরের সেনাপতি (শেষ অংশ)/চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ
চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ।
মণিপুর-জয়।
প্রথম পরাজয়-সংবাদ পাইয়া গবর্ণর জেনারেল সাহেব ইংরাজসৈন্যের দুর্গতির কথা একটু ভাবিলেন, ও কয়েদীদিগকে মুক্ত করিবার উপায় স্থির করিতে লাগিলেন। এমন সময় সেই লোমহর্ষণকর সংবাদ আসিয়া তাঁহার কর্ণে উপনীত হইল। তখন জানিতে পারিলেন যে, চিফ· কমিসনর প্রভৃতি প্রধান প্রধান কর্ম্মচারিগণ, মণিপুরিগণ কর্ত্তৃক অকালে কালকবলে প্রোথিত হইয়াছেন। এই সংবাদে তিনি অতিশয় দুঃখিত হইলেন, ও তৎক্ষণাৎ মণিপুরিগণের এই নৃশংস কার্য্যের প্রতিবিধানের নিমিত্ত আয়োজন করিতে লাগিলেন।
জেনারেল গ্রেহেম সাহেব তখন মণিপুর গমনের নিমিত্ত আদেশ প্রাপ্ত হইলেন। মেকেব সাহেব পলিটিকেল এজেণ্টের পদ গ্রহণ করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলেন।[১] সপিট সাহেবও তাঁহাদের অনুগমন করিলেন। সিলচরে যে সৈন্য ছিল, মেকেব সাহেব তাহারই নেতা হইলেন। ভারতের চতুর্দ্দিক হইতে কেবল সৈন্য-সকল মণিপুর-অভিমুখে ছুটিতে লাগিল; গুলি-বারুদ লইয়া অসংখ্য শকট সকল রওনা হইল; নানাস্থানের, নানাপ্রকারের, নানা শ্রেণীর সৈন্যগণকে বহন করিয়া অসংখ্য স্পেসাল ট্রেণ যাতায়াত করিতে লাগিল। ভলেণ্টিয়ারগণও পরিশেষে বন্দুক হস্তে মণিপুর-যুদ্ধে যোগদান করিবার প্রত্যাশায় সেই স্থানে দলে দলে গমন করিতে লাগিলেন। ব্যাণ্ড সকল যেন রণবাদ্যে উন্মত্ত হইয়া, সৈন্যদলের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিল। জেনারেল
গ্রেহেম সাহেব চতুরঙ্গ সৈন্যে সুশোভিত হইয়া মণিপুর-যাত্রা করিলেন। সেই স্থানে গমনপূর্বক তিনি প্রথমেই ঘোষণা করিলেন যে, মণিপুর রাজবিদ্রোহী হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মহারাণীর বিপক্ষে মণিপুর যুদ্ধ-ঘোষণা করিয়াছে—মহারাণীর প্রধান প্রধান কর্ম্মচারিগণকে বিনা দোষে মণিপুর হত্যা করিয়াছে। সুতরাং তিনি আজ তাহার প্রতিবিধান করিতে আগমন করিয়াছেন।
গ্রেহেম সাহেব যেরূপ দর্পের সহিত ও যেরূপ সৈন্যের সহিত মণিপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন, তাহাতে তাহার গতিরোধ করিতে কে সমর্থ হইবে? তাহার সম্মুখীন হইতে কে সাহস করিবে? কিন্তু টিকেন্দ্রজিৎ একেবারে আত্মসমর্পণ করিলেন না। তিনি যতক্ষণ পারিলেন, সম্মুখ যুদ্ধে ততক্ষণ দণ্ডায়মান রহিলেন। যুদ্ধও যে নিতান্ত কম হইল, তাহা নহে; উভয় পক্ষেরই ক্ষতি হইতে লাগিল। কিন্তু মণিপুর বিশেষ ক্ষতি সহ্য করিলেন। পরিশেষে ইংরাজ-সৈন্য মণিপুরের কেল্লা দখল করিয়া লইল। ভীষণ তোপের সম্মুখে রাজবাড়ি অভগ্ন অবস্থায় থাকিতে পারিল না। স্থান স্থান চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া স্তূপরাশিতে পরিণত হইল। গুলি, বারুদ, তোপ, কামান, বন্দুক, তরবারী, খাদ্য প্রভৃতি যাহা ছিল, সমস্তই ইংরাজের হস্তে পতিত হইল। উষ্ট্র, হস্তি প্রভৃতি যাহা ছিল, সমস্তই ইংরাজের হইল। সৈন্য সকল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া যে যেদিকে পাইল, পলায়ন করিল। অনেকে ধৃত হইয়া সেই স্থানে কারারুদ্ধও হইল। গ্রেহেম সাহেব তখন মণিপুরকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করিয়া আপনার আয়ত্বাধীন করিলেন, ও মণিপুর-পতাকার পরিবর্তে ব্রিটিশ-পতাকা সেই স্থানে উড্ডীয়মান হইল।
যখন মণিপুর দখল হইল, তখন টিকেন্দ্রজিৎ ও কুলচন্দ্র প্রভৃতি রাজবংশীগণ—যাহারা ইংরাজের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া ব্রিটিশ-কর্ম্মচারিগণের এরূপ দুর্দ্দশা করিয়াছিলেন, তাহাদিগকে ধরিবার নিমিত্ত সৈন্য-সকল রাজবাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল, কিন্তু কাহাকেও প্রাপ্ত হইল না। তাহারা যে কথন্ সেই স্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক কোথায় গমন করিয়াছেন, তাহা কেহই জানিতে পারিল না। তখন উহাদিগকেও ধরিবার নিমিত্ত বিশেষ চেষ্টা হইতে লাগিল,চতুর্দ্দিকে সৈন্য-সামন্তু প্রেরিত হইতে লাগিল; কিন্তু কোন দিকেই তাঁহাদিগের কোনরূপ সংবাদ পাওয়া গেল না।
- ↑ See telegram No. 65-E, dated 6th Apil, 1891., and No. 768-E, dated 13th April, 189I, from Foreign Secretary to Government of India to General Graham.