মানিনী/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।


 মানিনী তাঁহার যে বন্ধুর বাড়ীতে বাস করিতেন, সেই বাড়ীতে একজন ডাক্তারও থাকিতেন। পরিবারবর্গের ভিতর কাহারও পীড়া হইলে সেই ডাক্তারই তাহার চিকিৎসা করিতেন। উক্ত বাড়ীর স্ত্রীলোকমাত্রেই শিক্ষিতা; সুতরাং প্রয়োজন হইলে যাহাকে ইচ্ছা তাহার নিকট গমন করিতে ডাক্তার বাবুর কোনরূপ প্রতিবন্ধক হইত না। বিশেষতঃ পরস্পরের মধ্যে “ভ্রাতা ভগ্নী” সম্বন্ধ হইয়া পড়িয়াছিল।

 মানিনীর সহিত ডাক্তার বাবুর বিশিষ্ট ভালবাসা থাকা প্রযুক্ত বিপিনের সহিতও তাঁহার অত্যন্ত ভালবাসা জন্মিয়াছিল। ডাক্তার বাবুর স্ত্রী শিক্ষিতা, কি অশিক্ষিতা, তাহা আমরা অবগত নহি। কারণ তিনি তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া এই স্থানে বাস করিতেন না। একাকীই সেই বাড়ীতে থাকিতেন! কিন্তু কোন নাচে বলুন, থিয়েটারে বলুন, কি গড়ের মাঠে বলুন, এইরূপ স্থানে যখন ডাক্তার বাবু গমন করিতেন, তখন মানিনীকে তিনি তাঁহার গাড়ীতে করিয়া লইয়া যাইতেন, এবং বিপিনও সকল দিবস তাঁহাদিগের সহিত গমন করিতে না পারিলেও প্রায়ই তাঁহাদিগের সঙ্গে থাকিতেন।

 ডাক্তার বাবুর ব্যবহারে বিপিন সর্ব্বদা তাঁহার উপর বিশেষরূপে সন্তুষ্ট থাকিতেন। তাঁহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, ডাক্তার বাবু তাঁহাকে ও তাঁহার স্ত্রীকে যতদূর ভালবাসেন, ততদূর ভালবাসা তিনি তাঁহার সহোদর ভ্রাতা বা অপর কোন ব্যক্তির নিকট প্রাপ্ত হন নাই।

 এইরূপ ভাবে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। বন্ধুর বাড়ীতে এইরূপ ভাবে অধিক দিবস বাস করা আর ভাল দেখায় না বিবেচনা করিয়া, বন্ধুর বাড়ীর সন্নিকটেই একটী ছোট গোছের বাড়ী ভাড়া করিয়া বিপিন আপন স্ত্রীর সহিত বাস করিতে লাগিলেন।

 তিনি তাঁহার শিক্ষিতা প্রণয়িনীর প্রণয়ে বিশেষরূপে মোহিত থাকিলেও আর্থিক কষ্টে তাঁহাকে বিশেষরূপ কষ্ট পাইতে হইল। কারণ, তাঁহার সংস্থানের মধ্যে কেবলমাত্র মাসিক নগদ ৬০ টাকা, তাহা হইতে বাড়ী ভাড়া, একটী চাকর, একটী চাকরাণী ও একটী পাচকের বেতন ও খরচ বাদে যাহা কিছু অবশিষ্ট থাকিত, তাহাতে আপনাদিগের আবশ্যক মত ব্যয়ের সঙ্কুলান করা অতীব কষ্টকর হইয়া পড়িতে লাগিল। মানিনী শিক্ষিতা; সুতরাং সংসারিক কাজ-কর্ম্ম করিবার ক্ষমতা তাঁহার নাই! তজ্জন্ত চাকরাণী না রাখিলে কোন প্রকারেই চলে না। রন্ধনের ক্ষমতা তাঁহার নাই; বিশেষতঃ রন্ধনাদির নিমিত্ত তাঁহার যে সময়ের আবশ্যক হইবে, সেই সময়ে তাঁহার পাঠের সবিশেষ ক্ষতি হয়; অথচ রান্নাঘরের ধোঁয়া শিক্ষিতা মানিনী কিরূপে সহ করিতে পারেন? সুতরাং পাচকের একান্ত প্রয়োজন। বাবু নিজেও শিক্ষিত, বি-এ পাস করা, সুতরাং হাটবাজার করা কি অপর কোন দ্রব্যাদি সংগ্রহ করা, তাঁহার পক্ষে অসম্ভব; কাজেই চাকরেরও নিতান্ত প্রয়োজন।

 এই সকল নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যয় বাদে উভয়ের জুতা, কাপড় আছে; ধোপা, নাপিত আছে; আতর, গোলাপ আছে; মোজা, পাউডার আছে; চেয়ার, টেবিল আছে; বরফ, লেমনেড আছে, নাটক, নভেল, খবরের কাগজ আছে; এবং সন্ধ্যার সময় বায়ু সেবনের নিমিত্ত গাড়ীভাড়া আছে। অথচ বেতন নিতান্ত সামান্য, ইহাতে কিরূপে সঙ্কুলান হইতে পারে? ইহা ব্যতীত মধ্যে মধ্যে আপনার বন্ধু-বান্ধব এবং ভ্রাতা-ভগিনীদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া না খাওয়াইলে, তাহাদিগের নিকট নিতান্ত অপদস্থ হইয়া থাকিতে হয়।

 এইরূপ নানাকারণে ক্রমে বিপিনচন্দ্র ঋণজালে বিশেষরূপে জ্বালাতন হইয়া পড়িলেন। অথচ পূর্ব্ববর্ণিত নিতান্ত প্রয়োজনীয় খরচের মধ্য হইতে যে কোন একটী খরচ কমাইতে পারেন, তাহারও কোন উপায় দেখিলেন না।

 ডাক্তার বাবু, মানিনী ও বিপিনকে অশেষ ভালবাসিতেন; সুতরাং মধ্যে মধ্যে তিনি বিশেষরূপে অর্থ সাহায্য করিতেও ত্রুটী করিতেন না। তথাপি বিপিন আপনাদিগের খরচ-পত্র কোনরূপেই সুচারুরূপে নির্ব্বাহ করিয়া উঠিতে পারিতেন না।

 ক্রমেই মাসে মাসে ঋণের সংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। উত্তমর্ণগণ ক্রমে তাগাদা আরম্ভ করিলেন; কিন্তু বিপিন তাঁহাদিগের ঋণ কোনরূপেই পরিশোধ করিতে পারিলেন না। মাসে মাসে হ্রাস হওয়া দূরের কথা—ক্রমে বৃদ্ধিই পাইতে লাগিল।

 উত্তমর্ণগণ এই রূপে যখন কিছুতেই আপন আপন প্রাপ্য টাকা আদায়ের কোনরূপ উপায় করিতে পারিলেন না, তখন অনন্যোপায় হইয়া ক্রমে ক্রমে সকলেই আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করিতে লাগিলেন। আর ডিক্রী করিয়া কেহ বা তাঁহার তৈজসপত্র বিক্রয় করিয়া লইতে লাগিলেন, কেহ বা তাঁহার বেতনের টাকা ক্রোক দিয়া বসিলেন। এইরূপে একের টাকা পরিশোধ হইতে না হইতে অপর ব্যক্তি তাঁহার বেতন ক্রোক করিতে লাগিলেন।

 এই সকল অবস্থা দেখিয়া বিপিনের মনিব সাহেব তাঁহার উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া পড়িলেন, এবং পরিশেষে বিনাবেতনে বিপিনকে ছুটী দিয়া কহিলেন, “যে পর্য্যন্ত তুমি তোমার সমস্ত দেনা পরিষ্কার করিতে না পারিবে, সেই পর্য্যন্ত তুমি চাকরী পাইবে না। সমস্ত দেনা পরিশোধ করিয়া উঠিতে পার, তবে চাকরীর নিমিত্ত

আমার নিকট পুনরায় আসিও; নতুবা আমার নিকট আসিবার আর কোন প্রয়োজন নাই।”

 মনিবের নিকট এই কথা শ্রবণ করিয়া বিপিন বিষণ্ণবদনে আপন বাসায় প্রত্যাগমন করিলেন, এবং মানিনীকে সকল কথা কহিলেন। উত্তরে মানিনী কহিলেন, “যদি একমাত্র স্ত্রীর খরচের সংস্থান করিয়া উঠিবার ক্ষমতা তোমার না থাকে, তাহা হইলে বিবাহ করিতে তোমাকে কে পরামর্শ দিয়াছিল? তোমার হস্তে পড়িয়া আমি যেরূপ কষ্টে কালযাপন করিতেছি, সেরূপ কষ্ট কখন কোন স্ত্রীলোকে সহ করিয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। অপর স্ত্রী হইলে তুমি নিশ্চয়ই দেখিতে, এরূপ কষ্ট সে কখনই সহ করিতে পারিত না; তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া এতদিবস সে কোথায় চলিয়া যাইত। আমি তোমাকে নিতান্ত ভালবাসি বলিয়াই এখনও তোমাকে পরিত্যাগ করি নাই।”

 শিক্ষিতা স্ত্রীর কথা শুনিয়া শিক্ষিত যুবক মস্তকে হাত দিয়া সেইস্থানে বসিয়া পড়িলেন, এবং মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, “দাদা আমা অপেক্ষা এত অল্প বেতন পাইয়া কিরূপে খরচ-পত্র নির্ব্বাহ করিয়া থাকেন, আমি তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি না। আমি এমন শিক্ষিতা বনিতা পাইয়াও অর্থের অপ্রতুল নিবন্ধন এক দিবসের নিমিত্তও সুখী হইতে পারিলাম না! আর দাদা অশিক্ষিতা স্ত্রীর সহবাসে থাকিয়াও মনের সুখে সর্ব্বদা বাস করিয়া থাকেন! ভগবানের লীলা বোঝা ভার।”

 যে সকল ব্যক্তির নিকট বিপিন ঋণগ্রস্ত, তাঁহারা যখন দেখিলেন যে, তাঁহাদিগের টাকা আদায়ের একমাত্র উপায় বিপিনের চাকরী পর্য্যন্ত গেল, তখন কিরূপ উপায়ে যে তাঁহারা তাঁহাদিগের প্রাপ্য টাকা আদায় করিয়া লইতে সমর্থ হইবেন, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে না পারায় স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন। কিন্তু উঁহাদিগের মধ্যে একজন মহাজন ছিলেন, তাঁহার উপজীবিকাই ঋণদান ও সুদগ্রহণ। তিনি কিন্তু অপরাপর মহাজনদিগের ন্যায় স্থির থাকিতে পারিলেন না। প্রথমতঃ একদিবস বিপিনের বাড়ীতে আসিয়া টাকার নিমিত্ত বিপিনকে অযথা গালি দিয়া প্রস্থান করিলেন, এবং তাঁহাকে উত্তমরূপে জব্দ করিবার অভিপ্রায়ে আদালতে গিয়া বিপিনকে কয়েদ করিবার প্রার্থনা করিলেন। পরে প্রয়োজনীয় খরচের টাকা জমা করিয়া দিলেন।

 সময়মত বিপিনের নামে ওয়ারেণ্ট বাহির হইল, এবং আদালতের একজন লোক আসিয়া তাঁহাকে ধৃত করিয়া লইয়া গেল। সেই টাকা পরিশোধ করিবার ক্ষমতা বিপিনের ছিল না। সুতরাং কারাগারের ভিতর গমন করিয়া সেইস্থানেই কিছুদিবসের নিমিত্ত তাঁহাকে অবস্থান করিতে হইল।