মানিনী/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।


 রজনীকান্ত বা বিপিনের সংসারে স্ত্রীলোকের মধ্যে কেবল রাজকিশোরী এবং মানিনী। কিন্তু উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। রাজকিশোরী অশিক্ষিতা, মানিনী শিক্ষিতা; সুতরাং রাজকিশোরীর চাল-চলন মানিনী হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। রাজকিশোরী প্রত্যুষে উঠিয়া সংসারের সমস্ত কার্য্য আপন হস্তে নির্ব্বাহ করেন, এবং পরিশেষে রন্ধনাদি করিয়া আপন স্বামী ও দেবরকে সময়মত প্রদান করেন।

 মানিনীর নিদ্রা দিবা নয়টার কম কোনরূপেই ভঙ্গ হয় না। নিদ্রাভঙ্গ হইলে হস্ত-মুখাদি প্রক্ষালন করিতেও প্রায় এক ঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া যায়। তাহার পর সাবান মাখিতে, স্নান করিতে ও পোষাক পরিচ্ছদ আদি পরিধান করিতেও অনেক সময়ের আবশ্যক হয়। ইহা ব্যতীত নাটক, নভেল পাঠ করা আছে, কারপেট বোনা আছে। সুতরাং সংসারে কোন কার্য্যের দিকে লক্ষ্য করিতে তিনি কিছুমাত্র সময় পান না। অধিকন্তু তাঁহার আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিয়া তাঁহার সম্মুখে আনিয়া দিতে রাজকিশোরীর যদি কিছুমাত্র বিলম্ব হয়, তাহা হইলেই সর্ব্বনাশ! অমনি সংসারের খরচ বন্ধ!

 অশিক্ষিতা রাজকিশোরী তাঁহার স্বামীকে কিরূপ ভালবাসেন, তাহা প্রকাশ্যে দেখিতে পাওয়া যায় না। কারণ সর্ব্বদা স্বামীর নিকট তিনি বসিয়া থাকিতে পারেন না, বা “তোমার অদর্শন আমি সহ্য করিতে পারি না—মুহূর্তের নিমিত্ত আমার চক্ষুর অন্তরাল হইলে আমি চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখি—তোমাকে আমি প্রাণের সহিত ভালবাসি—” প্রভৃতি বাক্য সকল কখন কেহ রাজকিশোরীর মুখে শ্রবণ করেন নাই। সর্ব্বদাই তাঁহাকে সংসারের কার্য্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইত।

 শিক্ষিতা মানিনী তাঁহার স্বামীকে প্রাণের সহিত ভালবাসেন, এ বিশ্বাসে বিপিনের অন্তঃকরণ পরিপূর্ণ। কারণ, অফিস হইতে আগমন করিবামাত্রই মানিনী বিপিনের নিকট গমন করিয়া ইজি চেয়ারের উপর অর্দ্ধ-শায়িতভাবে উপবেশন করেন। জলখাবারের সময়ে, পূর্ব্বে আপনি অর্ধেক ভোজন করিয়া অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট(?) খাদ্য বিপিনকে প্রদান করেন। কারণ, খাদ্যের মধ্যে কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য আছে কি না, তাহা পরীক্ষা না করিয়া উহা স্বামীকে কিরূপে প্রদান করিবেন? জল-পূর্ণ গ্লাসের জল পূর্ব্বে আপনি না পান করিয়াই বা কিরূপে উহা স্বামীর হস্তে প্রদান করেন? সুতরাং মানিনী যেরূপ ভাবে স্বামীকে ভক্তি করিয়া থাকেন, সেইরূপ ভাবে এ দেশীয় কয়টী অশিক্ষিতা স্ত্রীলোক স্বামীভক্তি দেখাইতে পারে? ইহা ব্যতীত স্বামীর নিকট বসিয়া “প্রাণেশ্বর, প্রাণবল্লভ” প্রভৃতি অনিন্দদায়িনী ভাষায়, মানিনী বা মানিনী-সদৃশ শিক্ষিতা স্ত্রীলোক ভিন্ন আর কোন্ রমণী আপন পতির হৃদয় আনন্দে পূর্ণ করিতে সমর্থ হয়?

 অশিক্ষিতা রাজকিশোরী বৈকালে রন্ধনাদির উদ্যোগ করিতে পুনরায় ব্যস্ত হইয়া পড়েন, এবং রন্ধনাগারে প্রবেশ করিয়া উনানে ফুঁ পাড়িতে পাড়িতে মুখমণ্ডল ঘর্ম্মে আপ্লুত করিয়া ফেলেন। কিন্তু শিক্ষিতা মানিনী নূতন সাজে সজ্জিত হইয়া, পাউডারে মুখ মাজিয়া, ছাদের উপর উঠিয়া বায়ু সেবন করেন, কোন দিবস বা গাড়ী ডাকাইয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইয়া চলিয়া যান।

 এই সকল ঘটনা দেখিয়া রাজকিশোরীর বা রজনীকান্তের কোন কথা কহিবার উপায় নাই। কারণ মানিনী যাহা করেন, বিপিন তাহারই অনুমোদন করিয়া থাকেন। বিপিনকেও কোন কথা বলিবার কাহারও সাধ্য নাই। কারণ, দুই ভ্রাতার মধ্যে বিপিনের উপার্জ্জনই অধিক। মানিনীর বিপক্ষে তাঁহার নিকট কোন কথা বলিলে, তিনি তাহা শ্রবণ করেন না। অধিকন্তু খরচের টাকা বন্ধ করিয়া দিবেন বলিয়া ভয় প্রদর্শন করেন।

 এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। অশিক্ষিতা রাজকিশোরী বিস্তর সহ্য করিয়া আসিতেছিলেন, কিন্তু আর কোনরূপেই সহ্য করিয়া উঠিতে পারিলেন না। শিক্ষিতা মানিনীর গুণের কথা সকল ক্রমে রজনীকান্তের কর্ণগোচর করাইলেন। রজনীকান্তও দেখিলেন যে, মানিনী প্রকৃতই সংসারের কোন কার্য্যে হস্তক্ষেপ করেন না, অথচ কোন বিষয়ে একটু ত্রুটি হইলে রাজকিশোরীকে সহস্র কথা শুনাইয়া দেন।

 এই সময়ে রাজকিশোরী হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়ায় সংসারের কোন কার্য্য দেখিতে বা রন্ধনাদি করিতে সমর্থ হইলেন না। কিন্তু মানিনী তাঁহার দিকে একবারও দৃষ্টিপাত করিলেন না, বা কোনরূপ রন্ধনাদি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিলেন না। সুতরাং অনাহারেই রজনীকান্তকে অফিসে গমন করিতে হইল। বিপিন বাজার হইতে কিছু আহারীয় আনিয়া কিয়দংশ আপনি আহার করিয়া অফিসে গমন করিলেন, কিয়দংশ মানিনীর নিমিত্ত রাখিয়া গেলেন। বাজারের খাবার খাইলে পাছে মানিনীর অসুখ হয়, এই ভয়ে মানিনী উহা স্পর্শও করিলেন না। একখানি গাড়ী অনাইয়া তৎক্ষণাৎ তিনি তাহার কোন বন্ধুর বাড়ীতে গমন করিয়া আহারাদি করিলেন; এবং যে পর্য্যন্ত রাজকিশোরী আরোগ্য না হইবেন, সেই পর্য্যন্ত তিনি তাঁহার সেই শিক্ষিত বন্ধুর বাড়ীতেই অবস্থিতি করিবেন, ইহাই স্থির করিলেন। শিক্ষিত বন্ধুর অর্থের অনাটন ছিল না, সুতরাং তিনি শিক্ষিতা মানিনীকে তাঁহার থাকিবার স্থান প্রদান করিতে অসমর্থ হইলেন না। মধ্যে মধ্যে বিপিনও সেইস্থানে গমন করিয়া আহারাদি করিতে লাগিলেন। মানিনী তাঁহার শিক্ষিত বন্ধুর শিক্ষিতা স্ত্রী ও শিক্ষিতা কন্যার সহিত আহার বিহার করিয়া মনের সুখে কাল কাটাইতে লাগিলেন, এবং সভা-সমিতি প্রভৃতি স্থানে ইচ্ছামত গমনাগমন করিতে লাগিলেন।

 পাঠকগণ পূর্ব্ব হইতেই অবগত আছেন যে, বিপিনের মাসিক আয় ৬০ টাকা। যত দিবস পর্য্যন্ত মানিনী, রাজকিশোরী বা রজনীকান্তের সহিত একত্র বাস করিতেছিলেন, সেই পর্য্যন্ত বিপিন আপনার বেতন হইতে ২৫ টাকা সংসারের খরচের নিমিত্ত প্রদান করিতেন। অপর ৩৫ টাকা দ্বারা তিনি তাঁহার শিক্ষিত বনিতার ফরমাইস্ সকল কষ্টে নির্ব্বাহ করিতেন।

 যে দিবস হইতে রাজকিশোরী অসুস্থ হইয়া পড়িলেন, বা যে দিবস হইতে মানিনী আপনার বন্ধুর বাড়ীতে বাস করিতে লাগিলেন, সেই দিবস হইতে বিপিন সাংসারিক খরচও বন্ধ করিয়া দিলেন। এই কার্য্য বিপিন নিজের ইচ্ছামত করিলেন, কি তাহার শিক্ষিতা বনিতার পরামর্শ মত বাধ্য হইয়া করিলেন, তাহা লেখক অবগত নহেন। সে বিষয়ের বিচারের ভার পাঠকগণের উপর রহিল।

 ক্রমে রাজকিশোরী আরোগ্যলাভ করিয়া পুনরায় সংসারের কার্য্যে মনঃসংযোগ করিলেন। কিন্তু মানিনী সেই অশিক্ষিতার নিকট আর আগমন করিলেন না। ক্রমে বিপিনও বাড়ী আসা বন্ধ করিয়া আপনার শিক্ষিতা বনিতার বন্ধুর বাড়ীতেই বাস করিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য, সেইস্থানে বিপিনের যত্নে কিছুমাত্র ত্রুটি হইত না।

 ভ্রাতার এই অবস্থা দেখিয়া রজনীকান্ত বিপিনকে আর কোন কথা বলিলেন না, বা তাহার স্ত্রীকে পুনরায় বাড়ীতে আনিতে কোনরূপ অনুরোধও করিলেন না; ভাবিলেন, অশিক্ষিতের সহিত একত্র বাস করিয়া যদি ভিক্ষা করিয়াও দিনপাত করিতে হয়, তাহাও ভাল, তথাপি শিক্ষিতার সহিত একত্র বাস করিয়া স্বর্গীয় সুখেরও বাসনা করা বিড়ম্বনা মাত্র।

 তাঁহার মাসিক ২৫ টাকা কমিয়া গেল সত্য, কিন্তু ভ্রাতা ও ভ্রাতৃজায়া বাড়ী পরিত্যাগ করায় তাঁহার খরচও অনেক কমিয়া গেল। নিজের উপার্জ্জনের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহার খরচপত্র অনায়াসে চলিতে লাগিল। অধিকন্তু মাসে মাসে কিছু কিছু জমিতেও লাগিল।