মা/দ্বিতীয় খণ্ড/দুই
—দুই—
মা যেন এক ছেলের বাড়ি থেকে আর এক ছেলের বাড়ি এসেছেন। কোন সংকোচ, কোন অসুবিধা নেই তাঁর। সংসারে কোন কিছু গোছানো ছিল না, মা তা’ পরিপাটি করে গুছিয়ে নিলেন।
চা খেতে খেতে আইভানোভিচ বললো, আমি যে বোর্ডে কাজ করি, মা, তার কাজ হল চাষীদের অবস্থা নিরীক্ষণ ক’রে রিপোর্ট দেওয়া— বাস, ঐ পর্যন্ত। তাদের দুঃখমোচন করার কোনো চেষ্টা আমরা করি নে। আমরা দেখি···তাদের ক্ষুধার জ্বালা, তাদের অকাল মৃত্যু—আমরা দেখি, তাদের ছেলেরা জন্মায় ক্ষীণপ্রাণ, মরে মাছির মতো···তাদের দুঃখের কারণ কি, তাও আমরা জানি, আর তার জন্য বেতন পাই।
মা জিগ্যেস করলো, তুমি ছাত্র নও?
না। আমি বোর্ডের অধীনে জনৈক গ্রাম্য শিক্ষক।···চাষীদের বই পড়তে দিতুম···এই অপরাধে আমার জেল হ’ল···জেল থেকে বেরিয়ে এক বইয়ের দোকানে কাজ নিলুম এবং সেখানেও সতর্ক হ’য়ে চললুম না ব’লে আবার জেল···তারপরে আর্চাঞ্জেলে নির্বাসন।···সেখানে হ’ল গভর্নরের সঙ্গে সংঘর্ষ···ফলে ঠেলে পাঠালো শ্বেত-সাগরের উপকূলে···পাঁচ বছর সেখানে কাটিয়ে এলুম।···
এমন ভীষণ দুঃখকেও মানুষ কেমনভাবে এতো সহজ করে নিতে। পারে।···মা সেই কথা ভাবতে লাগলেন।
আইভানোভিচ বললো, শোফি আসছে আজ।
বিয়ে হয়েছে তার?
সে বিধবা।···তার স্বামী সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হয়। তারপর পালায়, সেখান থেকে। পথে ঠাণ্ডায় সর্দি হয়ে মারা যায় —প্রায় দু’বছর আগে।
শোফি কি তোমার ছোট?
দু’বছরের বড়। তার কাছে আমি বহুঋণে ঋণী। ওঃ, সে যা’ পিয়ানো বাজায়, চমৎকার!
থাকে কোথায়?
সর্বত্র। যেখানে সাহসী লোকের দরকার সেইখানেই শোফি হাজির। এ কাজে আছে?
নিশ্চয়!
দুপুরের দিকে শোফি এসে হাজির হ’ল। আসতে-না-আসতেই মার সঙ্গে ভাব হ’য়ে গেলো তার, বললো, পেভেলের মুখে তোমার কথা শুনেছি, মা।
পেভেল অন্যের কাছেও তাঁর কথা বলতো শুনে মার মনটা খুশিতে ভ’রে উঠলো।
শোফি বললো, মার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে?
মা বললেন, কষ্ট, হাঁ, কষ্ট বৈ কি! আগে হলে কষ্টই হত—কিন্তু এখন জানি, সে একা নয়, আমিও একা নই।
শোফি তখন কাজের কথা পাড়লো, বললো, এখন সব চেয়ে দরকারী কথা হচ্ছে, ওদের যাতে জেলে না পচতে হয়। বিচার শিগগিরই হচ্ছে। তারপর যক্ষুণি তাদের নির্বাসনে পাঠানো হবে, আমরা পেভেলকে মুক্ত করার চেষ্টা করব। সাইবেরিয়ায় তার কিছু করার নেই, তাকে এখানে দরকার।
মা বললেন, মুক্ত যেন সে হ’ল, কিন্তু ফেরারী হ’য়ে থাকবে কি ক’রে?
শোফিয়া বললো, আরও শত শত ফেরারী যেমন করে থাকে। এইতো, এই মাত্র একজনকে বিদায় দিয়ে এলুম। দক্ষিণ অঞ্চলে কাজ করতো সে। পাঁচবছরের নির্বাসন-দণ্ড ছিল···রইল মাত্র সাড়ে তিন মাস···তাইতো আমার এই পোশাকের জাঁকজমক···নইলে সত্যিই কি আর আমি এতোটা বাবু!
পুলিসের চোখে ধুলো দিতেই শোফি সাজ-পোশাক করেছিল ফ্যাশান-দুরস্ত, মুখে ছিল তার সিগারেট! এবার সে-সব ধরাচূড়া ছেড়ে সহজ, সরল, স্বাভাবিক মানুষ হ’য়ে পিয়ানো নিয়ে বসলো।
আইভানোভিচ মিথ্যা বলেনি। শোফি পিয়ানো বাজায় অপূর্ব! তার হাতে পিয়ানো যেন কথা কইতে লাগলো। নানা ভাব, নানা রস শ্রোতাদের মনের মধ্য দিয়ে ঢেউ খেয়ে গেলো। মা মুগ্ধ হ’য়ে শুনলেন সে সঙ্গীত। তাঁর সমস্ত অতীত যেন বুকের মধ্যে তোলপাড় করে উঠলো দুঃখ-করুণ ছন্দে ছন্দে। মার মুখ ফুটলো। ধীরে ধীরে তিনি বর্ণনা ক’রে গেলেন তাঁর দুর্বিষহ বন্দিনী জীবনের মর্মস্তুদ দুঃখ কাহিনী।···এতো তিনি শুধু তাঁর নিজের কথা বলছেন না—তাঁরই মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত নরনারীর অকথিত কাহিনী ব্যক্ত হচ্ছে। সেই জীবনের পর এই জীবন—জাগ্রত, জ্বলন্ত জীবন···যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, মানুষ কি ছিল, কি সে হয়েছে এবং কি সে হতে পারে।
মার কাহিনী শুনে শোফি বললো, একদিন আমি মনে করেছিলুম, আমি অসুখী···তখন আমি একটি ক্ষুদ্র শহরে নির্বাসিত···হাতে কোন কাজ নেই···নিজের কথা ছাড়া আর কিছু ভাববার নেই—কাজেই দুঃখগুলিকে জড়ো ক’রে ওজন করতে বসে গেলুম···তারপর বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ হল—জিম্নাসিয়াম থেকে আমি বিতাড়িত, লাঞ্ছিত হলুম··· তারপর জেল-সহকর্মীর বিশ্বাস-ঘাতকতা, স্বামীর নির্বাসন···আমার পুনরায় কারাদণ্ড এবং নির্বাসন, স্বামীর মৃত্যু—এম্নি বহু দুঃখ পেয়েছি আমি। কিন্তু এসব এবং এর দশগুণ দুঃখ একত্র করেও তোমার জীবনের একমাসের দুঃখের সমান হয় না, মা! বছরের পর বছর, প্রত্যেকটি দিন তুমি কি যাতনাই না সহ্য করেছো। এমন সহ্যশক্তি তোমরা কোথায় পাও, মা!
মা বললেন, আমদের সইতে সইতে অভ্যাস হ’য়ে যায়।
শোফি বললো, আমি ভেবেছিলুম, জীবনকে আমি পুরোপুরি চিনেছি। কিন্তু আজ দেখছি ভুল। বইয়ে যা পড়েছি, কল্পনায় যা তার আন্দাজ করে নিয়েছি—তােমার মতাে ভুক্তভােগীর কথা শুনে বুঝলুম, তার চাইতে ঢের, ঢের বেশি ভীষণ বাস্তব জীবন!···
এমনি আরাে অনেক কথা হল।
কাগজ সম্বন্ধে স্থির হ’ল, শোফি মার সঙ্গে গ্রামে গিয়ে সেই চাষীর সঙ্গে সব ঠিকঠাক করে আসবে। গ্রামটা সেখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে।