মা/দ্বিতীয় খণ্ড/সাত
—সাত—
তারপর ইয়েগরকে বালিশের ওপর শুইয়ে দিয়ে, তার হাত দু’খানা ভেঙে বুকের ওপর রেখে মা লিউদ্মিলার কাছে এসে তার ঘন চুলে হাত বুলোতে লাগলেন। লিউদ্মিলা কম্পিতকণ্ঠে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো···অনেকদিন ধরে জানতুম ওকে। একসঙ্গে নির্বাসনে ছিলুম, এক সঙ্গে হেঁটেছি ··একসঙ্গে কারাবাস করেছি। মাঝে মাঝে বিপদ এসেছে, দুঃখ এসেছে, বহু লোক হতাশ হয়ে পড়েছে কিন্তু ইয়েগরের আনন্দের কম্তি ছিল না কখনো। হাসি-কৌতুকের প্রলেপ দিয়ে সে বেদনাকে ঢাকতো— দুর্বলকে বল দিতো। সাইবেরিয়ায়··· অলস জীবন যেখানে মানুষকে করে তোলে নিজের ওপর বিতৃষ্ণ,···সেখানেও সে ছিল দুঃখ-জয়ী···যদি জানতে কতবড় সঙ্গী ছিল সে! নির্যাতন অনেক সয়েছে, কিন্তু কেউ কখনো অভিযোগ করতে শোনেনি তাকে। আমি তার কাছে বহুঋণে ঋণী—তার মনের কাছে ঋণী···তার অন্তরের কাছে ঋণী। বন্ধু··· সঙ্গী···প্রিয় আমার!··· বিদায়··· বিদায়···তোমার চিহ্নিত পথে চলবো আমি···সন্দেহে না টলে···সমস্ত জীবন···বিদায় বন্ধু, বিদায়!
লিউদ্মিলা মৃতের পায় মাথা লুটিয়ে দিলে।
পরদিন অন্ত্যেষ্টির আয়োজন হ’ল। আইভানোভিচ, শোফি, মা চায়ের টেবিলে বসে গম্ভীরভাবে ইয়েগরের কথা আলোচনা করছেন। হঠাৎ আবির্ভূত হল শশেংকা, অন্ধকারের বুকে একটা দীপ্ত মশালের মতো। আনন্দ-উজ্জ্বল তার মূর্তি।
ইয়েগরের মৃত্যুর কথা সে জানেনা। এইদিন তার এই আনন্দকে অন্যায় মনে ক’রে সবাই বেশ একটু বিরক্ত হয়ে বললো, আমরা ইয়েগরের কথা বলছিলাম।···
শশেংকা বললো, ইয়েগর?··· চমৎকার লোক। নয়? বিনয়ী··· নিঃসন্দিগ্ধ··· দুঃখজয়ী ··চির-কৌতুকোচ্ছল···রসিক··· সুকর্মী···বিপ্লবচিত্র অঙ্কনে সিদ্ধহস্ত, বিদ্রোহ-দর্শন রচনায় সুদক্ষ। কী সোজা সরল ভাষায় মিথ্যা এবং অত্যাচারকে সে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলে···ভীষণের সঙ্গে কৌতুক মিশিয়ে কী অপূর্ব কৌশলে বাস্তবকে করে তোলে আরো ভীষণ, আরো হৃদয়গ্রাহী। আমি তার কাছে ঋণী···তার হাসিমুখ, তার কৌতুক, বিশেষ ক’রে সন্দেহক্ষণে তার সেই আশ্বাসবাণী···তা’ আমি কখনো ভুলবোনা···আমি তাকে ভালবাসি।
শোফি বললো, সেই ইয়েগর আজ মৃত।
মৃত!···শশেংকা চমকে উঠলো। তারপর বললো, ইয়েগর মৃত··· একথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত।
আইভানোভিচ মৃদুহাস্যে বললো, কিন্তু এ সত্য কথা, সে মরেছে।
শশেংকা ঘরের এদিক-ওদিক পাইচারি করে হঠাৎ সোজা দাঁড়িয়ে আশ্চর্য এক সুরে বলে উঠলো, মরেছে অর্থ কি? কি মরেছে? ইয়েগরের ওপর আমার ভক্তি? তার প্রতি আমার প্রেম? আমার বন্ধুত্ব? তার প্রতিভা? তার বীরত্ব? তার কর্ম? মরেছে এই সব? মরেনি, মরতে পারে না। তার যত কিছু ভালো, আমি জানি, তা আমার কাছে কখনো মরবেনা! একটা মানুষকে ‘মরেছে’ বলে বিদায় করে দিতে আমাদের একটুও দেরি হয় না— তাই আমরা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে ষাই যে মানুষ কখনো মরেনা, যদি না আমরা ইচ্ছে করে বিস্মৃত হই, তার মনুষ্যত্বের গৌরব, সত্য এবং সুখকল্পে তার আত্মত্যাগী চেষ্টা,—ভুলে যাই, জীবন্ত যাদের প্রাণ তাদের মধ্যে সকল জিনিস সর্বকালে চিরজীবী হয়ে থাকে। চিরজীবী, চির-ভাস্বর আত্মাকে তার দেহের সঙ্গে সঙ্গে এতো তাড়াতাড়ি মাটি-চাপা দিয়োনা, বন্ধু...
কথা প্রসঙ্গে পেভেলের কথা উঠলো। শশা বললো, সে সঙ্গীদের চিন্তাতেই সদা-বিব্রত। বলে কি জানো? সঙ্গীদের জেল-পালানোর বন্দোবস্ত করা দরকার এবং তা নাকি খুবই সোজা।
শোফি বললো, তুমি মনে কর, শশা, সত্যি সম্ভব এ?
মা চায়ের কাপ টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে কেঁপে উঠলেন। শশার মুখ বিবর্ণ, ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। তারপর হেসে বললেন, পেভেল এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ—আর সে যা বলে তা যদি ঠিক হয়, তবে চেষ্টা করা আমাদের উচিত, আমাদের কর্তব্য।
শ্রোতাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শশা বেশ একটু আহত হয়ে বললো, তোমরা ভাবছ, আমার এতে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ আছে!
শোফি বললো, সে কি শশা?
পাংশুমুখে শশা বললো, হাঁ, তোমরা যদি এর বিবেচনা করার ভার নাও, তাহ’লে আমি কোনো কথা কইবো না।
আইভানোভিচ বললো, পালানো সম্ভব হ’লে সে সম্বন্ধে দু’মত থাকতে পারে না; কিন্তু সবার আগে আমাদের জানা চাই, বন্দী বন্ধুরা এ চান কিনা!
মা দীর্ঘ-নিশ্বাস ফেলে বললেন, তারা কি মুক্তি চাইবেনা, এওকি সম্ভব?
আইভানোভিচ বললো, পরশু পেভেলের সঙ্গে দেখা ক’রে একটা চিঠি দিয়ো... তাদের মত আমরা জানি আগে...
মা বললেন, তা পারবো।
শশা উঠে চলে গেলো ধীর মন্থর পদে...শুষ্ক চোখে।
মা কান্নার সুরে বলে উঠলেন, একটিবার, একটি দিনের জন্য যদি ওদের দু’হাত এক করতে পারতুম!