—চার—

 এমনি ক’রে দিন কাটে। ফি শনিবারে দলের লোকেরা পেভেলের বাড়িতে এসে মজলিস করে···আর এক-এক ধাপ ওপরে ওঠে···কিন্তু কোথায়, কতদূরে গিয়ে এ সিঁড়ি শেষ হয়েছে, কেউ তা জানে না। রোজ নয়া-নয়া লোক আসে, পেভেলের কামরায় আর তিলধারণের স্থান থাকেনা! ন্যাটাশাও আসে···তেমনি শ্রান্ত, ক্লান্ত কিন্তু যৌবনমদে তেম্‌নি জীবন্ত, পরিপূর্ণ। মা তার জন্য মোজা বোনেন, নিজের হাতে তার পায়ে পরিয়ে দিয়ে মাতৃস্নেহে তাকে অভিষিক্ত করেন। ন্যাটাশা প্রথমটা হাসে, তারপর হঠাৎ গম্ভীর হ’য়ে কি ভাবে। স্নিগ্ধ ধীর কণ্ঠে মাকে বলে, আমার এক ধাই···সেও আমায় এম্‌নি ভালবাসতো।···কী আশ্চর্য মা, কুলি-মজুরের এত দুঃখ-সংকুল অত্যাচারিত জীবন··· তবু তাদের মাঝে যেটুকু প্রাণ আছে, যতটুকু সাধুতা আছে, তা’ ওদের মধ্যে নেই—ব’লে হাত তু’লে সে দূরদূরান্তরের কাদের নির্দেশ করে।

 মা বললেন, কিন্তু, মা, কেন তুমি নিজের আত্মীয়স্বজন সুখ-সাধ সব ত্যাগ করে এসেছে?

 ম্লান হাস্যে ন্যাটাশা বলে, আত্মীয়স্বজন, সুখ-সাধ···কিছু নয় মা! শুধু মার কথা ভেবে কষ্ট হয়···তােমারই মতাে সে···মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তাঁকে দেখি।

 মা মাথা নেড়ে দুঃখিত কণ্ঠে বলেন, আহা, বাছা আমার!

 ন্যাটাশা কিন্তু জবাবে খিলখিল করে হেসে ওঠে, বলে, না, মা, দুঃখ কোথায়! মাঝে মাঝে এতাে আনন্দ, এতাে সুখ আমি পাই···বলতে বলতে তার মুখ প্রশান্ত হয়, তার নীল চোখে বিদ্যুৎ খেলে যায়। মার কাঁধে হাত রেখে স্বপ্নাবিষ্টের মতাে শান্ত, আন্তরিকতাপূর্ণ ভাষায় বলে, যদি জানতে, মা, যদি বুঝতে কী মহান্, কী আনন্দময় কাজ আমরা ক’রে যাচ্ছি—একদিন বুঝবে!

 মার যেন ঈর্ষা হয় ন্যাটাশার ওপর, বলেন, আমি বুড়ো, বােকা, কিইবা বুঝি।

 পেভেলের বক্তৃতা ক্রমশ বাড়ে। আলােচনার সুর ক্রমশ চড়তে থাকে···আর তার শরীর হয় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। সে যখন ন্যাটাশার সঙ্গে কথা কয়, মা দেখেন যেন তার কণ্ঠ মধুর, তার দৃষ্টি কোমল, তার সমস্ত চেহারা সহজ সরল হ’য়ে আসে। ন্যাটাশাকে পুত্রবধূরূপে কল্পনা করে মা অন্তরে অন্তরে পুলকিত হ’য়ে ভগবানকে বলেন, তাই করো ঠাকুর।

 আলােচনার সুর যখন সপ্তমে ওঠে, এণ্ড্রি সটান দাঁড়িয়ে তাদের কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

 তর্কাতর্কি বাঁধাবার প্রধান পাণ্ডা নিকোলাই। তার দলে শ্যামােয়লােভ, আইভান বুকিন এবং ফেদিয়া মেজিন। ইয়াকোভ, পেভেল, এণ্ড্রি অন্য দলে।

 মাঝে মাঝে ন্যাটাশার বদলে আসেন অ্যালেক্সি আইভানােভিচ। তার আলােচ্য বিষয় অতি সাধারণ—পারিবারিক জীবন-যাত্রা, ছেলেপিলে, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিস, রুটি ও মাংসের দাম, এইসব···প্রত্যেকটা জিনিসে তিনি দেখতে পান জাল-জুয়াচুরি, বিশৃঙ্খলা, বােকামি। মাঝে মাঝে তা’ নিয়ে ঠাট্টাও করেন, কিন্তু সবসময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখান, মানুষের জীবন এসবের ফলে কতাে অসহজ এবং অসুবিধাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

 আর একটি মেয়েও প্রায়ই আসে শহর থেকে। নাম তার শশেংকা, লম্বা সুগঠিত দেহ, পাতলা গম্ভীর মুখ, সমস্ত অঙ্গ দিয়ে যেন একটা তেজ ফুটে বেরুচ্ছে, কী এক অজ্ঞাত রােষে যেন তার কালাে ভুরু কুঞ্চিত হ’য়ে ওঠে। যখন কথা বলে, পাতলা নাকের পাতা কাঁপতে থাকে, সে-ই প্রথম উচ্চারণ করলাে, আমরা সােশিয়ালিস্ট। রুদ্র, রুক্ষ তার কণ্ঠ।

 মা শুনেই নির্বাক আতংকে মেয়েটির দিকে চাইলেন, কিন্তু শশেংকা চক্ষু অর্ধ-মুদ্রিত করে দৃঢ়-কঠিন কণ্ঠে বললাে, এই নবজীবন গঠন-ব্রতে আমাদের সমগ্র শক্তি দান করতে হবে,—আর আমাদের একথাটা বুঝতে হবে যে, এ দানের কোনাে প্রতিদান আমরা পাবাে না।

 সােসিয়ালিস্ট কথাটার সঙ্গে মা পরিচিত। বাল্যে গল্প শুনতেন, চাষাদের দাসত্ব থেকে মুক্ত ক’রে দেওয়ায় জমিদাররা জারের ওপর রেগে গিয়ে পণ করেন, জারের মুণ্ডচ্ছেদ না ক’রে চুল ছাঁটবো না। এরাই নাকি সােশিয়ালিস্ট, এরাই তখন জারকে খুন করে। তবে? তাঁর ছেলে এবং এরা সব সেই সােশিয়ালিস্ট হ’ল কি ক’রে?

 সব চলে গেলে ছেলেকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, হাঁরে, তুই কি সােশিয়ালিস্ট?

 হাঁ, কেন বলতাে, মা?

 দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে চোখ নামিয়ে মা বললেন, পাভ্‌লুশা, তােরা জারের বিরুদ্ধে কেন? একজন জারকে তারা খুন করেছিলাে।

 পেভেল পায়চারি করতে করতে হেসে বললাে, কিন্তু আমরা ও করতে চাই না, মা। মাকে বহুক্ষণ ধরে ধীর গম্ভীর কণ্ঠে বােঝালো। মা তার মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে বলতে লাগলেন, পেভেল কোনাে খারাপ কাজ করবে না—করতে পারে না।

 কিন্তু শশেংকার ওপর মা তেমন খুশি নন। কথা প্রসঙ্গে এণ্ড্রিকে একদিন বললেন, শশেংকা কি কড়া মেয়ে, বাবা! খালি হুকুম, এ করাে, ও করো।

 এণ্ড্রি হেসে বললে, তুমি ঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছ, মা।

 পেভেল নীরস কণ্ঠে বললাে, কিন্তু সে মেয়ে ভালাে।

 এণ্ড্রি বললাে, একশােবার···শুধু সে এইটে বােঝে না যে···

 তারপরেই দু’জনের মধ্যে যে তর্কাতকি শুরু হল, মা তার খেই ধরতে পারলেন না।

 মা লক্ষ্য করতেন, শশেংকা পেভেলের সঙ্গে এত রূঢ় ব্যবহার করে, এমন-কি মাঝে মাঝে তিরস্কারও করে, তবু পেভেল কিছু বলে না, চুপ ক’রে থাকে, হাসে, ন্যাটাশার দিকে যেমন ক’রে চাইতাে তেমনি ক’রে তার দিকে চায়। এটা মা সইতে পারতেন না।

 মজলিসের বৈঠক ঘন ঘন, হপ্তায় দু’দিন করে চলতে লাগলাে। নতুন নতুন গানের আমদানি হল···সুরের মধ্য দিয়ে ফুটে বেরুতে লাগলাে এক দুর্দমনীয় শক্তি। নিকোলাই গম্ভীরভাবে বলতো, এবার রাস্তায় বেরিয়ে এ গান গাইবার সময় এসেছে।

 মাঝে মাঝে তারা আনন্দে বিহ্বল হ’য়ে পড়ে বিদেশী শ্রমিক ভাইদের জয়-যাত্রার সংবাদে। তাদের নামে জয়ধ্বনি করে, তাদের অভিনন্দিত ক’রে চিঠি পাঠায়, দুনিয়ায় যেখানে যত শ্রমিক আছে, তাদের সঙ্গে নিজেদের অচ্ছেদ্য বন্ধনে বদ্ধ মনে করে, তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করে।

 মার চিত্তও ধীরে ধীরে এইভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে! এণ্ড্রিকে সম্বােধন করে একদিন তিনি বলেন, কি মজার লােক তােমরা! কোথাকার কোন্ অর্মেণিয়ান, ইহুদী, অস্ট্রিয়ান···সব তোমাদের কমরেড···সবাইকে বল তােমরা বন্ধু···সবার জন্য দুঃখ কর, সবার সুখে উৎফুল্ল হও।

 এণ্ড্রি বললাে, সবার জন্যই আমরা দাঁড়িয়েছি, মা! এই দুনিয়াটা আমাদের শ্রমিকদের···আমাদের কাছে কোন জাতি নেই, কোন বর্ণ নেই—আমাদের কাছে আছে শুধু মিত্র এবং শত্রু। দুনিয়ার নিখিল শ্রমিক আমাদের কমরেড। ধনী এবং কর্তারদল আমাদের দুশমন···দুনিয়ার দিকে যখন চেয়ে দেখি, শ্রমিক আমরা কতো অসংখ্য, কী বিপুল আমাদের প্রাণশক্তি, তখন হৃদয় আনন্দে নেচে ওঠে, সুখে উদ্বেল হয়, বুকের মধ্যে উৎসবের বাঁশি বাজতে থাকে। ঐ ফরাসী শ্রমিক, জার্মান শ্রমিক, ইতালিয়ান শ্রমিক···জীবনের দিকে যখন চায়, ওরাও এম্‌নিভাবে উদ্বুদ্ধ হয়। একই মায়ের সন্ততি আমরা, বিশ্বের সকল দেশের সকল শ্রমিকের ভ্রাতৃবন্ধনে আমাদের নবজন্ম। এই বন্ধন ক্রমশ প্রবল হচ্ছে, সূর্যের মতাে আমাদের দীপ্ত করে তুলছে—এ যেন ন্যায় গগনে সমুদিত নবসূর্য এবং এ গগন শ্রমিক হৃদয়েরই অভ্যন্তরে। সে ৩৪ যেই হক্ না, যা-ই তার নাম হ’ক্, সােসিয়ালিস্ট মাত্রেই আমাদের ভাই—আজ, চিরদিন, যুগ-যুগান্ত ধ’রে।

 মা তাদের শক্তি-দীপ্ত আননের দিকে চেয়ে অনুভব করেন, সত্যি সত্যিই বিশ্বাকাশে তার চোখের আড়ালে এক নব দীপ্তোজ্জ্বল জ্যোতির আবির্ভাব হয়েছে···আকাশের সূর্যের মতােই যা মহান।

 এমনি করে তাদের চাঞ্চল্য বেড়ে চলে। পেভেল মাঝে মাঝে বলে, একটা কাগজ বের করা দরকার।

 নিকোলাই বলে, আমাদের নিয়ে কানা-ঘুষাে চলছে পাড়ায়। এখনই সরে পড়া ভাল।

 এণ্ড্রি জবাব দেয়, কেন এতাে ধরা পড়ার ভয়!

 মা এণ্ড্রিকে ভালবেসে ফেলেছেন নিজের ছেলের মতাে। কাজেই তিনিই একদিন প্রস্তাব করলেন পেভেলের কাছে, এণ্ড্রি এখানেই থাকুক না। তা’হলে আর তােদের ওর বাড়ি ছুটাছুটি ক’রে হয়রান হ’তে হয় না।

 পেভেল বললে, ঝঞ্ঝাট বাড়িয়ে লাভ কি, মা।

 ঝঞ্ঝাট···তাতো চিরটা জনমই পুইয়ে এসেছি···অমন ভালাে ছেলের জন্য পােহানো তাে বরঞ্চ সার্থক!

 পেভেল বললাে, তাই হ’ক মা, এণ্ড্রি এলে আমি সুখীই হ’ব।

 কাজেই এণ্ড্রি এসে মার আর একটি ছেলে হ’য়ে বসলাে।