মা/প্রথম খণ্ড/চোদ্দ
—চোদ্দ—
জীবন বয়ে চলে এমনি দ্রুত তালে। নিয়মিতভাবে মার ওখানে কর্মীরা মেলে, মতলব আঁটে, কাজ করে। মা কারখানায় ইস্তাহার ছড়ান,—ইস্তাহার বেরুবার পরদিন রক্ষীরা মাকে পরীক্ষা করে বিফলকাম হয়। মার আরব্ধ-ব্রতের প্রতি নিষ্ঠা বাড়ে।
নিকোলাইর কারখানার কাজ গেছে, এখন কাজ করে এক কাঠের গোলায়, আর রোজ মার ওখানে মজলিসে যোগ দেয়। সবাই চলে যাবার পরও সে থাকে। একা এণ্ড্রির মুখোমুখি প্রশ্ন করে, কিন্তু মানুষ যে আজ সর্বহারা, তার জন্য সব চেয়ে বেশি দায়ী কে—জার?
এণ্ড্রি বলে, দায়ী সেই, যে প্রথম উচ্চারণ করেছিল, ‘এই আমার জিনিস।’ কিন্তু সে লোকটা মারা গেছে বহু হাজার বছর— তার ওপর রাগ ঝাড়বার উপায় নেই।
কিন্তু ধনী আর তাদের মুরুব্বীরা— তাদের কথা কি বলছ? তারা কি নির্দোষ?
এণ্ড্রি তার জবাবে বহু যুক্তিপূর্ণ কথা বলে,—নিকোলাইর মন প্রসন্ন হয় না। সাধারণ মানুষও যে সব দোষের সঙ্গে জড়িত, একথাটা তার মন মানতে চায় না। একদিন সে বলে, দুনিয়া থেকে ঐ দুষ্ট আগাছাগুলোকে নির্দয়ভাবে চষে ফেলতে হ’বে আমাদের।
মা বলেন, আইছেও এম্নি কথা বলেছিল।
স্পাই আইছের নাম শুনে মুহূর্তে নিকোলাইর মন কঠিন হ’য়ে উঠলো। বললো, একজন দোষী ঐ। ব’লে চ’লে গেলো।
এণ্ড্রি বললো, সত্যিই আইছে বড় বেড়ে উঠেছে, মা। রাতদিন ও লোকদের ধরিয়ে দেবার মতলবে ঘরের আনাচে-কানাচে ঘুরছে। নিকোলাই একদিন ওকে ধ’রে আচ্ছা মতো দিয়ে দেবে। কর্তারা জনসাধারণের মন কী পর্যন্ত বিষিয়ে তুলেছে দেখ। নিকোলাইর মতো লোকেরা যখন অন্যায়ের অত্যাচারে ধৈর্য হারাবে, তখন কী ভীষণ ব্যাপার হবে! পৃথিবী হবে রক্ত-রঞ্জিত, আকাশেও যেয়ে সে রক্তের ছোপ লাগরে ৷
একদিন অকস্মাৎ পেভেল এসে হাজির হ’ল। মার বুক আনন্দে উদ্বেল হ’য়ে উঠলো। মা এণ্ড্রিকে ডাকলেন। তিন জনে প্রাণ খুলে কথা বলতে লাগলো। মা খাবার নিয়ে এলেন। খেতে খেতে এণ্ড্রি রাইবিনের কথা তুললো। পেভেল বললো, আমি থাকলে তাকে যেতে দিতুম না। কি সম্বল ক’রে বেরুলো সে?—অসন্তোষ এবং অজ্ঞানান্ধকার।
এণ্ড্রি হেসে বলে, চল্লিশ বছর অবিরত সংগ্রাম করার ফলে অন্তর যার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে তাকে বাগ মানানো সোজা নয়, বন্ধু।
পেভেল কঠিন সুরে বললো, কেন? তুমি কি মনে কর, জ্ঞান মানুষের মনের পুঞ্জীভূত ভ্রান্তি দূর করতে পারে না?
এণ্ড্রি অর্থপূর্ণ ভাষায় বললো, একলাফে একেবারে আকাশে উঠতে যেয়ো না, পেভেল, দুর্গের চূড়ায় ঘা খেয়ে ডানা ভেঙে যাবে।
তারপর চললো দুই বন্ধুতে বিতর্ক। মা তার এক বর্ণও বুঝতে পারলেন না, শুধু বুঝলেন, পেতেল চাষীদের কথা ভেবে তাদের জন্য নির্ধারিত পন্থার একচুল এদিক-ওদিক যেতে রাজি নয়। এণ্ড্রি চাষীদের পক্ষে, বলে, তাদেরও শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হ’বে। এর মধ্যে এণ্ড্রির মতটাই মার মনে লাগে। এমনি করে খাওয়া শেষ হয়, দিন কাটে।