মিবার-গৌরব-কথা
পদ্মিনী।

 রাজপুতনা অতি মরুময় দেশ। এই মরু প্রদেশে প্রচণ্ড বিক্রমশালী বীর রাজপুত জাতির আবাস স্থান ছিল। দিগ্বিজয়ী মুসলমানগণ ভারতবর্যে পদার্পণ করিয়া এই দুধর্ষ জাতির সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হন। বীরত্ব, তেজস্বিতা, অসীমসাহসে ইঁহারা মুসলমানবীরগণ অপেক্ষা কোন অংশেই হীন ছিলেন না। বিভিন্ন বংশীয় রাজপুত নৃপতিদিগের মধ্যে মিবারের গিহ্লোটদিগের আসন এবং সম্মান সর্ব্বোপরি। বাস্তবিক ইঁহাদিগের বীরত্বকাহিনী এবং কীর্ত্তি কলাপ অতি অপূর্ব্ব! মুসলমানদিগের সহিত প্রতিদ্বন্দীতায়ও ইঁহারা সর্ব্বাগ্রগণ্য ছিলেন। দিল্লীতে যখনই কোন প্রতাপশালী সম্রাট আসীন হইয়াছেন তখনই তাঁহার সহিত মিবারের রাণার সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছে। মিবারের রাণাদিগের গর্ব্বিত মস্তক পদদলিত না করিতে পারিলে কেহই আপনার বিজয় গর্ব্বের সার্থকতা অনুভব করেন নাই। খিলিজি বংশীয় আলাউদ্দিন একজন প্রতাপশালী সমাট ছিলেন। তিনি যখন দিল্লীর সিংহাসনে আসীন তখন চিতোরের সিংহাসনে রাণা লক্ষ্মণ সিংহ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। অতি তরুণ বয়সে লক্ষ্মণ সিংহ চিতোরের সিংহাসনে অধিরোহণ করেন। সুতরাং তদীয় পিতৃব্য ভীমসিংহ সমুদায় রাজকার্য পরিচালন করিতেন। ভীমসিংহ সিংহলদ্বীপবাসী চৌহান বংশীয় হামিরশঙ্কের কন্যা রূপসী-শ্রেষ্ঠ পদ্মিনীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। পদ্মিনীর অসামান্য সৌন্দর্য্য যথার্থই তাঁহার নামের সার্থকতা প্রদান করিয়াছিল। পদ্মাসনা কমলাই পদ্মিনীর উপমা স্থল। বাস্তবিক পদ্মিনীর সমতুল্য অপরূপ রূপলাবণ্যবতী রমণী পৃথিবীতে অতি অল্পই জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। পদ্মিনীর রূপের খ্যাতি তখন ভারতের সর্ব্বত্রই বিদিত ছিল। অধিক দিন এ খ্যাতি দিল্লীশ্বর আলাউদ্দীনের অবিদিত রহিল না। ভারতের সর্ব্বোৎকৃষ্ট রত্নরাজি দিল্লীশ্বরের চরণে উৎসগীকৃত হইত। এই রমণী রত্ন, এই লোক ললামভূতা পদ্মিনী ধরাতলে মূর্ত্তিমতী এই দেবী-মূর্ত্তি ক্ষুদ্র নর ভীমসিংহের নয়ন পুত্তলি, এই চিন্তা দিল্লীশ্বরের হৃদয়ে বিষম ঈর্ষানল প্রজলিত করিল। তিনি এই দুর্লভ রমণীরত্ন অপহরণে কৃত সংকল্প হইলেন। অচিরে মিবারের রাণার বিরুদ্ধে রণঘোষণা করিয়া চিতোর নগরী আক্রমণ করিলেন। দিল্লীশ্বর বহুদিন চিতোর নগরী অবরোধ করিয়া রহিলেন, তথাপি চিতোরের পতন হইল না। রাজপুত বীরগণ অতুল বিক্রমের সহিত নগর রক্ষা করিতে লাগিলেন। অবশেষে নিষ্ফল অবরোধে ত্যক্ত হইয়া আলাউদ্দীন ভাবিলেন অতি সহজে অভিষ্ট সিদ্ধি করিয়া লইবেন। দূতমুখে চিতোরের রাণার নিকট সংবাদ পাঠাইলেন “পদ্মিনী সুন্দরী লাভ করাই আমার উদ্দেশ্য—চিতোরবাসীর উপর আমার কোন অক্রোশই নাই। পদ্মিনী আমার হস্তে সমর্পিতা হইলেই আমি এ রাজ্য ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইব—আর কখন ইহার ত্রিসীমায় পদার্পণ করিব না” এই অশ্রুতপূর্ব্ব বাক্য শ্রবণে রাজপুত বীরগণ ঘৃণা ও জিঘাংসায় আত্মহারা হইলেন “কি এত বড় স্পর্দ্ধা যবন সম্রাটের! রাজপুতের গৃহক্ষ্মীলাভে তাঁহার আকাঙ্ক্ষা। রাজপুতের সম্মানই সর্ব্বস্ব। রাজপুত তুচ্ছ প্রাণের মমতা রাখে না—একথা কি আজিও যবনরাজের অবিদিত আছে?— চিতোর জনশুন্য শ্মশান হইবে, পদ্মিনী সতীর অপরূপ রূপলাবণ্য চিতানলে ভম্মীভূত হইবে তথাপি, এ পবিত্র নগরী শিশোদীয় কুলের মানসম্ভ্রম বিসর্জ্জন দিবে না—রাজ দূত। তুমি অবধ্য, নচেৎ তোমার পাপ জিহ্বা অনলে আহতি দিতাম। যাও তোমার মহিমান্বিত সম্রাটকে বল গিয়া, যতক্ষণ চিতোরে একটী মাত্র বীর জীবিত থাকিবে, ততক্ষণ চিতোরের দ্বার আবদ্ধ রহিবে।” রণাভিনয় উভয় পক্ষে ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ করিল। দীর্থ অবরোধ সহ্য করিয়া চিতোরবাসিগণ দুঃখ দুর্দ্দশার চরমসীমায় উপনীত হইল। আলাউদ্দীনের ভ্রান্তি তখনও বিদুরিত হয় নাই; তিনি ক্রুরবুদ্ধির আশ্রয় লইলেন। বিনীতভাবে দূতমুখে নিরেদন করিলেন, “পদ্মিনীলাভের আমার কোন ইচ্ছাই নাই —কেবল মাত্র তাঁহার রূপের খ্যাতি শুনিয়া একবার মাত্র দর্শন করিতে কৌতুহল জন্মিয়াছে। মুকুরে একবার মাত্র তাঁহার প্রতিমৃত্তি দর্শন করিয়া আপুকাম হইয়া স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্ত্তন করিব। আর চিতোরে পদার্পন করিব না।” রাজপুত বীরগণ এই অলীক বাক্যে ভ্রান্ত হইলেন। দুঃখ দুর্দ্দশারও একশেষ হইয়াছে—আর অধিকদিন এইরূপ অবস্থায় জীবনধারণ অসম্ভব। এই প্রস্তাবে দুর্দ্দশাপন্ন রাজপুত বীরগণ কিঞ্চিৎ বিচলিত হইলেন। মুকুরে প্রতিচ্ছায়া দর্শন করিলে রাজপুং কুল লক্ষ্মীর অবমাননার সম্ভাবনা নাই ইহাই সিদ্ধান্ত হইল। ভীমসিংহের বীরহৃদয় সহজে এ প্রস্তাবে সম্মত হইল না। তাঁহার সম্মান রক্ষার জন্য সহস্র সহস্র ব্যক্তি ঘোর দুঃখে পতিত হইয়াছে—তাঁহারই জন্য এত যুদ্ধ, এত বিগ্রহ, এত রক্তপাত! চিন্তাজর্জ্জরিত ও অনন্যোপায় হইয়া ভীমসিংহ এই হীন প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। আলাউদ্দীনের ক্রর হৃদয় এ সংবাদ শ্রবণে আনন্দে আত্মহারা হইল। নির্দ্ধারিত দিবসে আলাউদ্দীন সদলে রাণার প্রাসাদে উপস্থিত হইলেন। দিল্লীর মহাপ্রতাপান্বিত সমাট আজ মিবারের রাণার গৃহে অতিথি। আতিথ্য সংকারের কোন ক্রটিই হইল না। রাজপুতের ভদ্রতা ও সৌজন্য দর্শনে আলাউদ্দীন মুগ্ধ হইলেন। এবং বীনয়নভ্রবচনে বারম্বার আপনার অপরাধ স্বীকার করিলেন। বিদায় গ্রহণের পূর্ব্বে পদ্মিনীর প্রতিচ্ছায়া একবার মাত্র দর্পনে প্রতিবিম্বিত হইল। মনে হইল যেন কোন স্বর্গীয় আলোকচ্ছটা মুকুরের মধ্য দিয়া বিদ্যুতের মত চলিয়া গেল! মুগ্নেত্র আলাউদ্দীন তুষিত নেত্রে চাহিয়া রহিলেন! চকিতে সমুদায় অদর্শন হইল! দর্শন মাত্রই আলাউদ্দীনের দুর্দ্দমনীয় আকাঙ্ষা হৃদয় মধ্যে শতধা প্রবল হইল। পদ্মিনী লাভ বিষয়ে দৃঢ় সঙ্কল্প হইলেন! ভীমসিংহকে ভদ্র ভাষায় আপ্যায়িত করিলেন। সরল হৃদয় রাজপুতবীর দুর্গের দ্বারদেশ পর্য্যন্ত অতিথির অনুগমন করিলেন। দুর্গের দ্বারদেশে পদার্পন করিবামাত্র আলাউদ্দীনের সঙ্কেতে ভীমসিংহ বন্দী হইলেন। ভীমসিংহকে বন্দী করিয়া আলাউদ্দীন সংবাদ পাঠাইলেন, “পদ্মিনীকে না পাইলে ভীমসিংহের এবং চিতোরের রক্ষা নাই।” এ বার্ত্তা শ্রবণে চিতোরপুরী ক্রন্দন করিয়া উঠিল! বীরগণ দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করিয়া উঠিলেন। কিন্তু বৃথা অক্রোশ! ভীমসিংহ দুর্দ্দান্ত আলাউদ্দীনের হস্তে বন্দী! বীরগণ কিংকর্ত্তব্যবিমৃঢ় হইলেন! এই সময়ে পদ্মিনীর নিকট হইতে সংবাদ আসিল “আমি আমার সমুদায় সঙ্গিনী ও পরিচারিকা সমভিব্যাহারে আলাউদ্দীনের নিকট আত্মসমর্পণ করিব-এ বার্ত্তা শীঘ্র শত্রু শিবিরে প্রেরণ কর।” সহরবাসী এই অশ্রুতপূর্ব্ব বাণী শ্রবণে স্তম্ভিত বিস্মিত হইল বটে, কিন্তু অনুভব করিল নিশ্চিত ইহার অভ্যন্তরে কোন গুঢ় রহস্য লুক্কায়িত আছে।

 পদ্মিনী সতী তাঁহার পরমাত্মীয় বীরবর গোরা এবং তদীয় ভ্রাতুষ্পুত্র বাদলের সহিত গুপ্তকক্ষে মন্ত্রণা করিয়া, সপ্তশত পট্টাবৃত শিবিকা প্রস্তুত করিতে আদেশ করি লেন। আলাউদ্দীনের নিকট সংবাদ গেল, রাজমহিষী পদ্মিনীর সঙ্গিনী ও দাসীগণ তাঁহার সহিত চিরনির্ব্বাসিতা হইতে প্রস্তুত। সাতশত শিবিকায় তাঁহারা আগমন করিবেন কেহ যেন তাঁহাদের পথে উপস্থিত না থাকে এবং পদ্মিনী দেবী অর্দ্ধঘণ্টাকাল পতির সহিত আলাপ করিয়া চিরবিদায় গ্রহণ করিবেন। কিছুতে ইহার অন্যথা না হয়। আলাউদ্দীন উৎফুল্ল হৃদয়ে এই সমুদায় প্রস্তাবে স্বীকৃত হইলেন। নির্দ্দিষ্ট দিনে সপ্তশত পট্টাবৃত শিবিকার সম্মুখভাগে বিচিত্র শিবিকায় পদ্মিনী আরোহণ করিয়া আলাউদ্দীনের শিবিরাভিমুখে চলিলেন। ক্রমে ক্রমে সে সমুদায় শিবিকা শিবিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিল। অর্দ্ধঘণ্টাকাল অতীত হইল, আলাউদ্দীন অসহিষ্ণু হইয়া উঠিলেন—এরূপ দীর্ঘ বিদায় গ্রহণে তাঁহার ধৈর্য্যচ্যুতি হইল। তখন সদলে পত্মিনীর শিবিকার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন! কি সর্ব্বনাশ! কোথায বা পদ্মিনী, কোথায় বা ভীমসিংহ, এ যে যমদূতাকৃতি ভীষণ রাজপুত বীরগণ নিষোষিত অসি হস্তে দণ্ডায়মান! বীরবর গোরা সকলের অগ্রভাগে। ক্ষুদ্ধ সিংহের ন্যায় আলাউদ্দীন গর্জ্জন করিয়া উঠিলেন! রাজপুত বীরগণও ঘোরনাদে সম্মুখ সমরে প্রাণ দিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। প্রত্যেক শিবিকায় একজন করিয়া রাজপুতবীর ও বাহক ছয়জন যোদ্ধা ছিল! আজ এই সমুদায় রাজপুতবীর ভীমসিংহের উদ্ধার ও পদ্মিনীর ধর্ম্মরক্ষার জন্য জীবনাহুতি দিতে বদ্ধপরিকর! বীরবর গোরা অতুল বীরত্ব দেখাইয়া শত্রুহস্তে প্রাণ বিসর্জ্জন করিলেন। তাঁহার ভ্রাতৃষ্পুত্র দ্বাদশবর্ষীয় বালক বাদল তাঁহার বীরত্বকাহিনী বহন করিয়া চিতোরে প্রত্যাবৃত হইল। ভীমসিংহের উদ্ধার ও পদ্মিনীর সম্মান রক্ষা করিয়া বীরগণ জীবন বিসর্জ্জন করিলেন বটে, কিন্তু আলাউদ্দীন চিতোরের সর্ব্বনাশ করিলেন। চিতোর রক্ষা করা অসম্ভব জানিয়া বীরগণ সম্মুখ সমরে জীবন দিলেন। পদ্মিনীপ্রমুখ চিতোরবাসিনীগণ জহরব্রতের অনুষ্ঠান করিয়া জলন্ত চিতানলে জীবনাহতি দিলেন। আলাউদ্দীন বিজযয়স্ফীত গর্ব্বে অসি হস্তে চিতোরে প্রবেশ করিলেন। বিস্ময় বিস্কারিত নেত্রে দেখিলেন, চিতোর জনমানবহীন এক ভীষণ শ্মশান-চারি দিকে চিতাগ্নি হহ করিয়া জলিতেছে। চিতোরের নয়নানন্দ দায়িনী রমণীকুল তখন সে চিতাশয্যায় শয়ান। আলাউদ্দীন বলিয়া উঠিলেন ওনযনানন্দদায়িনী লোকললামভূতা পদ্মমুখী পদ্মিনী কই—;” আর কই? সে অতুল রূপরাশি, চিতানলে ভস্মীভৃত হইয়াছে! দিল্লীশ্বর কি মনস্তাপ, কি নিস্ফল আশা, কি ক্ষুদ্ধ চিত্তের অক্রোশ-বহন করিয়া ভগ্নহবদয়ে বিশাল বাহিনী লইয়া দিল্লীতে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন।