মৃণালিনী/চতুর্থ খণ্ড/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।


মহম্মদআলির প্রায়শ্চিত্ত।

 যে রাত্রে রাজধানী যবনসেনা বিপ্লবে পীড়িত হইতেছিল, সেই রাত্রে পশুপতি একাকী কারাগারে অবরুদ্ধ ছিলেন। নিশাবশেষে সেনাবিপ্লব সমাপ্ত হইয়া গেল। মহম্মদআলি তখন তাঁহার সম্ভাষণে আসিলেন। পশুপতি কহিলেন,

 “যবন!—প্রিয় সম্ভাষণে আর আবশ্যক করে না। একবার তোমারই প্রিয়সম্ভাষণে বিশ্বাস করিয়া এই অবস্থাপন্ন হইয়াছি। বিধর্ম্মী যবনকে বিশ্বাস করার যে ফল তাহা প্রাপ্ত হইয়াছি। এক্ষণে আমি মৃত্যু শ্রেয়ঃকল্পনা করিয়া অন্য ভরসা ত্যাগ করিয়াছি। তোমাদিগের কোন প্রিয়সম্ভাষণ শুনিব না।”

 মহম্মদআলি কহিল। “আমি প্রভুর আজ্ঞা প্রতিপালন করি। প্রভুর আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে আসিয়াছি। আপনাকে যবন বেশ পরিধান করিতে হইবে।”

 পশুপতি কহিলেন, “সে বিষয়ে চিত্তস্থির করুন। আমি এক্ষণে মৃত্যু স্থির করিয়াছি। প্রাণত্যাগ করিতে স্বীকৃত আছি— কিন্তু যবন ধর্ম্ম অবলম্বন করিব না।”

 ম। “আপনাকে এক্ষণে যবনধর্ম্মাবলম্বন করিতে বলিতেছি না। কেবল মাত্র রাজ প্রতিনিধির তৃপ্তার্থ যবনের পরিচ্ছদ পরিধান করিতে বলিতেছি।”

 প। “ব্রাহ্মণ হইয়া কি জন্য স্নেচ্ছের বেশ করিব?”

 ম। “আপনি ইচ্ছাপূর্ব্বক না পরিলে, আপনাকে বলপূর্ব্বক পরাইব। অস্বীকারে লাভের ভাগ অপমান।”

 পশুপতি উত্তর করিলেন না। মহম্মদ আলি স্বহস্তে তাঁহাকে যবন বেশ পরাইলেন। কহিলেন, “আমার সঙ্গে আসুন।”

 প। “কোথায় যাইব?”

 ম। “আপনি বন্দী—জিজ্ঞাসার আবশ্যক কি?”

 মহম্মদ আলি তাঁহাকে সিংহদ্বারে লইয়া চলিলেন। যে ব্যক্তি পশুপতির রক্ষায় নিযুক্ত ছিল, সেও সঙ্গে সঙ্গে চলিল।

 দ্বারে প্রহরিগণের জিজ্ঞাসামতে মহম্মদ আলি আপন পরিচয় দিলেন; এক সঙ্কেত করিলেন। প্রহরিগণ তাঁহাদিগকে যাইতে দিল। সিংহদ্বার হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া তিন জনে কিছু দূর রাজপথ অতিবাহিত করিলেন। তখন যবনসেনা নগরমন্থন সমাপন করিয়া বিশ্রাম করিতেছিল। সুতরাং রাজপথে আর উপদ্রব ছিল না। মহম্মদ আলি কহিলেন,

 “ধর্ম্মাধিকার! আপনি আমাকে বিনা দোষে তিরস্কার করিয়াছেন। বখ্‌তিয়ার খিলিজির এরূপ অভিপ্রায় আমি কিছুই অবগত ছিলাম না। তাহা হইলে আমি কদাচ প্রবঞ্চকের বার্ত্তাবহ হইয়া আপনার নিকট যাইতাম না। যাহা হউক আপনি আমার কথায় প্রত্যয় করিয়া এরূপ দুর্দশাপন্ন হইয়াছেন। ইহার যথাসাধ্য প্রায়শ্চিত্ত করিলাম। গঙ্গাতীরে তরণী প্রস্তুতা আছে―আপনি যথেষ্ট স্থানে প্রস্থান করুন। আমি এইখান হইতে বিদায় হই।”

 পশুপতি বিস্ময়াপন্ন হইয়া অবাক্‌ হইয়া রহিলেন। মহম্মদআলি পুনরপি কহিতে লাগিলেন, “আপনি এই সাবশেষা রজনীমধ্যে এ নগরী ত্যাগ করিবেন। নচেৎ কল্য প্রাতে যবনের সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইলে প্রমাদ ঘটিবে। খিলিজির আজ্ঞার বিপরীতাচরণ করিলাম―ইহার সাক্ষী এই প্রহরী। সুতরাং আত্মরক্ষার জন্য ইহাকেও দেশান্তরিত করিলাম। ইহাকেও আপনার নৌকায় লইয়া যাইবেন।”

 এই বলিয়া মহম্মদআলি বিদায় হইলেন। পশুপতি কিয়ৎকাল বিস্ময়াপন্ন হইয়া থাকিয়া গঙ্গাতীরাভিমুখে চলিলেন।