মৃণালিনী/চতুর্থ খণ্ড/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।


পরামর্শ।

 হেমচন্দ্র মাধবাচার্য্যের বসতি স্থলে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে আচার্য্য জপে নিযুক্ত আছেন। হেমচন্দ্র প্রণাম করিয়া কহিলেন,

 “আমাদিগের সকল যত্ন বিফল হইল। এক্ষণে ভৃত্যের প্রতি আর কি আদেশকরেন? যবন কর্ত্তৃক বঙ্গ অধিকৃত হইয়ছে। বুঝি এ ভারত ভূমির অদৃষ্টে যবনের দাসত্ব বিধিলিপি! নচেৎ বিনা বিবাদে যবনেরা বঙ্গজয় করিল কি প্রকারে? যদি এখন এই দেহ পতন করিলে এক দিনের তরেও জন্মভূমি দস্যুহস্ত হইতে মুক্তা হয় তবে এইক্ষণে তাহা করিতে প্রস্তুত আছি। সেই অভিপ্রায়ে কালি রাত্রে রণাকাঙ্ক্ষায় নগর মধ্যে অগ্রসর হইয়াছিলাম—কিন্তু রণত দেখিলাম না। কেবল দেখিলাম যে এক পক্ষ আক্রমণ করিতেছে, অপর পক্ষ পলাইতেছে।”

 মাধবাচার্য্য কহিলেন, “বৎস! দুঃখিত হইও না। দৈবনির্দ্দেশ কখন বিফল হইবার নহে। আমি যখন গণনা করিয়াছি যে যবন পরাভূত হইবে, তখন নিশ্চয়ই জানিও যে তাহারা পরাভূত হইবে। যবনেরা নবদ্বীপ অধিকার করিয়াছে বটে, কিন্তু নবদ্বীপধিকার ত বঙ্গাধিকার নহে। প্রধান রাজা সিংহাসন ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিয়াছেন, কিন্তু এই বঙ্গভূমে অনেক করপ্রদ রাজা আছেন; তাঁহারা ত এখনও বিজিত হয়েন নাই। কে জানে যে সেই সকল রাজা সমবেত হইয়া প্রাণপণ করিলে, যবন বিজিত না হইবে?”  হেমচন্দ্র কহিলেন, “তাহার অল্পই সম্ভাবনা।”

 মাধবাচার্য্য কহিলেন, “জ্যোতিষী গণনা মিথ্যা হইবার নহে। অবশ্য সফল হইবে। তবে আমার এক ভ্রম হইয়া থাকিবে। পূর্ব্বদেশে যবন পরাভূত হইবে—ইহাতে আমরা বঙ্গেই যবন জয় করিবার প্রত্যাশা করিয়াছিলাম। কিন্তু বঙ্গ রাজ্য ত প্রকৃত পূর্ব্ব নহে—কামরূপই পূর্ব্ব। বোধ হয় তথায়ই আমাদিগের আশা ফলবতী হইবে।”

 হে। “কিন্তু এক্ষণে ত যবনের কামরূপ গমনের কোন সম্ভাবনা দেখি না।”

 মা। “এই যবনেরা ক্ষণকাল স্থির নহে। সুস্থির হইলেই কামরূপ আক্রমণ করিবে।”

 হে। “তাহাও মানিলাম। এবং ইহারা যে কামরূপ আক্রমণ করিলে পরাজিত হইবে তাহাও মানিলাম। কিন্তু তাহা হইলে আমার পিতৃরাজ্যোদ্ধারের কি সদুপায় হইল?”

 মা। “এই যবনেরা এ পর্য্যন্ত পুনঃ পুনঃ জয়লাভ করিয়া অজেয় বলিয়া রাজগণমধ্যে প্রতিপন্ন হইয়াছে। ভয়ে কেহ তাহাদিগের বিরোধী হইতে চাহে না। তাহারা এক বার মাত্র পরাজিত হইলে তাহাদিগের সে মহিমা আর থাকিবে না। তখন ভারতবর্ষীয় তাবৎ আর্য্যবংশীয় রাজারা ধৃতাস্ত্র হইয়া উঠিবেন। সকলে এক হইয়া অস্ত্র ধারণ করিলে যবনেরা কত দিন তিষ্ঠিবে?”

 হে। “গুরুদেব! আপনি আশামাত্রের আশ্রয় লইতেছেন —আমিও তাহাই করিলাম। এক্ষণে আমি কি করিব-আজ্ঞা করুন।”

 মা। “আমিও তাহাই চিন্তা করিতেছিলাম। এ নগর মধ্যে তোমার আর অবস্থিতি করা অকর্ত্তব্য; কেন না যবনের” তোমার মৃত্যুসাধন সঙ্কল্প করিয়াছে। আমার আজ্ঞা তুমি অদ্যই এ নগর ত্যাগ করিবে।”

 হে। “কোথায় যাইব?”

 মা। “আমার সঙ্গে কামরূপ চল।”

 হেমচন্দ্র অধোবদন হইয়া, অপ্রতিভ হইয়া, মৃদু মৃদু কহিলেন, “মৃণালিনীকে কোথায় রাখিয়া যাইবেন?”

 মাধবাচার্য্য বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সে কি? আমি ভাবিয়াছিলাম যে তুমি কালিকার কথায় মৃণালিনীকে চিত্ত হইতে দূর করিয়াছিলে?”

 হেমচন্দ্র পূর্ব্বের ন্যায় মৃদুভাবে বলিলেন “মৃণালিনী অত্যজ্যা। তিনি আমার পরিণীতা পত্নী।”

 মাধবাচার্য্য চমৎকৃত হইলেন। রুষ্ট হইলেন। ক্ষোভ করিয়া কহিলেন, “আমি ইহার কিছু জানিলাম না?”

 হেমচন্দ্র তখন আদ্যোপান্ত তাহার বিবাহের বৃত্তান্ত বিবরিত করিলেন। শুনিয়া মাধবাচার্য্য কিছুক্ষণ মৌন হইয়া রহিলেন। কহিলেন, “যে স্ত্রী অসদাচারিণী, সে ত শাস্ত্রানুসারে ত্যজ্যা। মৃণালিনীর চরিত্র সম্বন্ধে যে সংশয় তাহা কালি প্রকাশ করিয়াছি।”

 তখন হেমচন্দ্র ব্যোমকেশের বৃত্তান্ত সকল প্রকাশ করিয়া বলিলেন। শুনিয়া মাধবাচার্য্য আনন্দ প্রকাশ করিলেন। কহিলেন,

 “বৎস! বড় প্রীতি পাইলাম। তোমার প্রিয়তমা এবঞ্চ গুণবতী ভার্য্যাকে তোমার নিকট হইতে বিযুক্ত করিয়া তোমাকে অনেক ক্লেশ দিয়াছি। এক্ষণে আশীর্ব্বাদ করিতেছি তোমরা দীর্ঘজীবী হইয়া বহুকাল একত্রে ধর্ম্মাচরণ কর। যদি তুমি এক্ষণে সস্ত্রীক হইয়াছ তবে তোমাকে আর আমি আমার  সঙ্গে কামরূপ যাইতে অনুরোধ করি না। আমি অগ্রে যাইতেছি। যখন সময় বুঝিবেন তখন তোমার নিকট কামরূপাধিপতি দূত প্রেরণ করিবেন। এক্ষণে তুমি বধূকে লইয়া মথুরায় গিয়া বাস কর—অথবা অন্য অভিপ্রেত স্থানে বাস করিও।”

 এইরূপ কথোপকথনের পর হেমচন্দ্র মাধবাচার্য্যের নিকট বিদায় হইলেন। মাধবাচার্য্য আশীর্ব্বাদ, আলিঙ্গন করিয়া সাশ্রুলোচনে তাঁহাকে বিদায় করিলেন।