মৃণালিনী/চতুর্থ খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।


বিনা সূতার হার।

 পশুপতি উচ্চ-অট্টালিকায় বহু ভৃত্য সমভিব্যাহারে বাস করিতেন বটে, কিন্তু তাঁহার পুরী কানন হইতে অন্ধকার। গৃহ যাহাতে আলো হয়, স্ত্রী পুত্র পরিবার—এ সকলই তাঁহার গৃহে ছিল না।

 অদ্য শান্তশীলের সহিত কথোপকথনের পর পশুপতির সেই সকল কথা মনে পড়িল। মনে ভাবিলেন, “এত কালের পর বুঝি এ অন্ধ কার পুরী আলো হইল—যদি জগদম্বা অনুকূলা হয়েন তবে মনোরমা এ অন্ধকার ঘুচাইবে।”

 এই রূপ ভাবিতে ভাবিতে পশুপতি, শয়নের পূর্ব্বে অষ্টভূজাকে নিয়মিত প্রণামবন্দনাদির জন্য দেবীমন্দিরে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে তথায় মনোরমা বসিয়া আছেন।

 পশুপতি কহিলেন “মনোরমা কখন আসিলে?”

 মনোরমা পূজাবশিষ্ট পুষ্পগুলিন লইয়া বিনাসূত্রে মালা গাঁথিতে ছিলেন। কথার কোন উত্তর দিলেন না। পশুপতি কহিলেন, “আমার সঙ্গে কথা কও। যতক্ষণ তুমি থাক ততক্ষণ সকল যন্ত্রণা বিস্মৃত হই।”

 মনোরমা মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিলেন। পশুপতির মুখ প্রতি চাহিয়া রহিলেন, ক্ষণেক পরে কহিলেন, “আমি তোমাকে কি বলিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু তাহা আমার মনে হইতেছে॥”

 পশুপতি কহিলেন, “তুমি মনে কর। আমি অপেক্ষা করিতেছি।”

 পশুপতি বসিয়া রহিলেন, মনোরমা মালা গাঁথিতে লাগিলেন।

 অনেকক্ষণ পরে পশুপতি কহিলেন, আমারও কিছু বলিবার আছে। মনোযোগ দিয়া শুন। আমি এ বয়স্ পর্য্যন্ত কেবল বিদ্যোপার্জ্জন করিয়াছি—বিষয়ালোচনা করিয়াছি, অর্থেপার্জ্জন করিয়াছি; সংসার ধর্ম্ম করি নাই। যাহাতে অনুরাগ তাহাই করিয়াছি, দারপরিগ্রহে বিরাগ, এজন্য তাহা করি নাই। কিন্তু যে পর্য্যন্ত তুমি আমার নয়নপথে আসিয়াছ সেই পর্য্যন্ত মনোরমা লাভ আমার এক মাত্র ধ্যান স্বরূপ হইয়াছে। সেই লাভের জন্য এই নিদারুণ ব্রতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। যদি জগদীশ্বরী অনুগ্রহ করেন তবে দুই চারি দিনের মধ্যে রাজ্য লাভ করিব এবং তোমার পাণিগ্রহণ করিব। ইহাতে তোমার বৈধব্যজনিত যে বিঘ্ন, শাস্ত্রীয় প্রমাণের দ্বারা আমি তাহার নিরাকরণ করিতে পারিব। কিন্তু তাহাতে দ্বিতীয় বিঘ্ন এই যে তুমি কুলীন কন্যা, জনার্দ্দন শর্ম্মা কুলীন শ্রেষ্ঠ, আমি শ্রোত্রীয়।”

 মনোরমা এ সকল কথায় কর্ণপাত করিতেছিলেন কি না সংশয়। পশুপতি দেখিলেন যে মনোরমা চিত্ত হারাইয়াছেন। পশুপতি, সরল, অবিকৃতা, বালিকা মনোরমাকে ভাল বাসিতেন,—প্রৌঢ়া তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী মনোরমাকে ভয় করিতেন। কিন্তু অদ্য ভাবান্তরে সন্তুষ্ট হইলেন না। তথাপি পুনরুদ্যম করিয়া পশুপতি কহিলেন, “কিন্তু কুলরীতি ত শাস্ত্রমূলক নহে, কুলনাশে ধর্ম্মনাশ বা জাতিভ্রংশ হয় না। তাঁহার অজ্ঞাতে যদি তোমাকে বিবাহ করিতে পারি, তবে ক্ষতিই কি? তুমি সম্মত হইলেই তাহা পারি। পরে তোমার পিতামহ জানিতে পারিলে বিবাহ ত ফিরিবে না।”

 মনোরমা কোন উত্তর করিলেন না। তিনি সকল শ্রবণ করিয়াছিলেন কি না সন্দেহ। একটি কৃষ্ণবর্ণ মার্জ্জার তাঁহার নিকটে আসিয়া বসিয়াছিল, তিনি সেই বিনাসূত্রের মালা তাহার গলদেশে পরাইতে ছিলেন। পরাইতে মালা খুলিয়া গেল। মনোরমা তখন আপন মস্তকহইতে কেশগুচ্ছ ছিন্ন করিয়া তৎসূত্রে আবার মালা গাঁথিতে লাগিলেন।

 পশুপতি উত্তর না পাইয়া, নিঃশব্দে মালা-কুসুমমধ্যে মনোরমার অনুপম অঙ্গুলির গতি মুগ্ধলোচনে দেখিতে লাগিলেন।