মৃণালিনী/চতুর্থ খণ্ড/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ।


অন্তিমকালে।

 পশুপতি স্বয়ং অষ্টভুজার অর্চনা করিতেন বটে―কিন্তু তথাপি তাঁহার নিত্য সেবার জন্য দুর্গাদাস নামে এক জন ব্রাহ্মণ নিযুক্ত ছিলেন। নগরবিপ্লবের পরদিবস দুর্গাদাস শ্রুত হইলেন যে পশুপতির গৃহ ভস্মীভূত হইয়া ভূমিসাৎ হইয়াছে। তখন ব্রাহ্মণ অষ্টভুজার মূর্ত্তি ভস্ম হইতে উদ্ধৃত করিয়া আপন গৃহে স্থাপন করিবার সঙ্কল্প করিলেন। যবনেরা নগর লুঠ করিয়া তৃপ্ত হইলে, বখ্‌তিয়ার খিলিজি অনর্থক নগরবাসীদিগের পীড়ন নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। সুতরাং এক্ষণে সাহস করিয়া বাঙ্গালিরা রাজপথে বাহির হইতেছিল। ইহা দেখিয়া দুর্গাদাস অপরাহ্নে অষ্টভুজার উদ্ধারে পশুপতির ভবনাভিমুখে যাত্রা করিলেন। পশুপতির ভবনে গমন করিয়া, যথায় দেবীর মন্দির ছিল, সেই প্রদেশে গেলেন। দেখিলেন অনেক ইষ্টকরাশি স্থানান্তরিত না করিলে, দেবীর প্রতিমা বহিষ্কৃত করিতে পারা যায় না। ইহা দেখিয়া দুর্গাদাস আপন পুত্রকে ডাকিয়া আনিলেন। ইষ্টক সকল অর্দ্ধ দ্রবীভূত হইয়া পরস্পর লিপ্ত হইয়াছিল―এবং এক্ষণ পর্য্যন্ত সন্তপ্ত ছিল। পিতাপুত্রে এক দীর্ঘিকা হইতে জলবহন করিয়া তপ্ত ইষ্টক সকল শীতল করিলেন, এবং বহু কষ্টে তন্মধ্য হইতে অষ্টভুজার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। যথাস্থানের ইষ্টকরাশি স্থানান্তরিত হইলে তন্মধ্য হইতে দেবীর প্রতিমা আবিষ্কৃতা হইল। কিন্তু প্রতিমার পাদমূলে―এ কি? সভয়ে পিতাপুত্র নিরীক্ষণ করিলেন যে মনুষ্যের মৃতদেহ রহিয়াছে। তখন উভয়ে মৃতদেহ উত্তোলন করিয়া দেখিলেন যে পশুপতির দেহ।

 বিস্ময়সূচক বাক্যের পর দুর্গাদাস কহিলেন, “যে প্রকারেই প্রভুর এ দশা হইয়া থাকুক, ব্রাহ্মণের এবঞ্চ প্রতিপালিতের কার্য্য আমাদিগের অবশ্য কর্তব্য। গঙ্গাতীরে এই দেহ লইয়া আমরা প্রভুর সৎকার করি চল।”

 এই বলিয়া দুই জনে প্রভুর দেহ বহন করিয়া গঙ্গাতীরে লইয়া গেলেন। তথায় পুত্রকে শবরক্ষায় নিযুক্ত করিয়া দুর্গাদাস নগরে কাষ্ঠাদি সৎকারের উপযোগী সামগ্রীর অনুসন্ধানে গমন করিলেন। এবং যথাসাধ্য সুগন্ধী কাষ্ঠ এবং অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করিয়া গঙ্গাতীরে প্রত্যাগমন করিলেন।

 তখন দুর্গাদাস পুত্রের আনুকূল্যে যথাশাস্ত্র দাহের পূর্ব্বগামিক্রিয়া সকল সমাপন করিয়া সুগন্ধী কাষ্ঠে চিতা রচনা করিলেন। এবং তদুপরি পশুপতির মৃতদেহ স্থাপন করিয়া অগ্নি প্রদান করিতে গেলেন।

 কিন্তু অকস্মাৎ শ্মশানভূমে এ কাহার আবির্ভাব হইল? ব্রাহ্মণদ্বয় বিস্মিতলোচনে দেখিলেন যে, এক মলিন বসনা, রূক্ষকেশী, আলুলায়িতকুন্তলা, ভস্ম ধূলি সংসর্গে বিবর্ণা, উন্মাদিনী আসিয়া শ্মশানভূমে অবতরণ করিতেছে। রমণী ব্রাহ্মণদিগের নিকটবর্ত্তিনী হইলেন। দুর্গাদাস সভয়চিত্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে?”

 রমণী কহিলেন, “তোমরা কাহার সৎকার করিতেছ?”

 দুর্গাদাস কহিলেন, “মৃত ধর্ম্মাধিকার পশুপতির।”

 রমণী কহিলেন, “পশুপতির কি প্রকারে মৃত্যু হইল?”

 দুর্গাদাস কহিলেন, “প্রাতে নগরে জনরব শুনিয়াছিলাম যে তিনি যবন কর্ত্তৃক কারাবদ্ধ হইয়া কোন সুযোগে রাত্রিকালে পলায়ন করিয়াছিলেন। অদ্য তাঁহার অট্টালিকা ভস্মসাৎ হইয়াছে দেখিয়া ভস্মমধ্য হইতে অষ্টভুজার প্রতিমা উদ্ধার মানসে গিয়াছিলাম। তথায় গিয়া প্রভুর মৃতদেহ পাইলাম।”

 রমণী কোন উত্তর করিলেন না। গঙ্গাতীরে, সৈকতের উপর উপবেশন করিলেন। বহুক্ষণ নীরবে থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কে?” দুর্গাদাস কহিলেন, “আমরা ব্রাহ্মণ। ধর্ম্মাধিকারের অন্নে প্রতিপালিত হইয়াছিলাম। আপনি কে?”

 তরুণী কহিলেন, “আমি তাঁহার পত্নী।”

 দুর্গাদাস কহিলেন, “তাঁহার পত্নী বহুকাল নিরুদ্দিষ্টা। আপনি কি প্রকারে তাঁহার পত্নী?”

 যুবতী কহিলেন, “আমি সেই নিরুদ্দিষ্টা কেশবকন্যা। অনুমরণভয়ে পিতা আমাকে এতকাল লুক্কায়িত রাখিয়াছিলেন। আমি অদ্য কালপূর্ণে বিধিলিপি পূরাইবার জন্য আসিয়াছি।”

 শুনিয়া পিতাপুত্রে শিহরিয়া উঠিলেন। তাহাদিগকে নিরুত্তর দেখিয়া বিধবা বলিতে লাগিলেন, “এক্ষণে স্ত্রী জাতির কর্ত্তব্য কার্য্য করিব। তোমরা উদ্যোগ কর।”

 দুর্গাদাস তরুণীর অভিপ্রায় বুঝিলেন। পুত্রের মুখ চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বল?”

 পুত্র কিছু উত্তর করিল না। দুর্গাদাস তখন তরুণীকে কহিলেন, “মা, তুমি বালিকা―এ কঠিন কার্য্যে কেন প্রস্তুত হইতেছ?”

 তরুণী ভ্রূভঙ্গী করিয়া কহিলেন, “ব্রাহ্মণ হইয়া অধর্ম্মে প্রবৃত্তি দিতেছ কেন?―ইহার উদ্যোগ কর।”

 তখন ব্রাহ্মণ আয়োজনজন্য নগরে পুনর্ব্বার চলিলেন। গমনকালে বিধবা দুর্গাদাসকে কহিলেন, “তুমি, নগরে যাইতেছ। নগরপ্রান্তে রাজার উপবনবাটিকায় হেমচন্দ্র নামে বিদেশী রাজপুত্র বাস করেন। তাঁহাকে বলিও মনোরমা গঙ্গাতীরে চিতারোহণ করিতেছে―তিনি আসিয়া একবার তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া যাউন, তাঁহার নিকট ইহলোকে মনোরমার এইমাত্র ভিক্ষা।”

 হেমচন্দ্র যখন ব্রাহ্মণমুখে শুনিলেন, যে মনোরমা পশুপতির পত্নী পরিচয়ে তাঁহার অনুমৃতা হইতেছেন, তখন তিনি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। অতি ব্যস্তে দুর্গাদাসের সমভিব্যাহারে গঙ্গাতীরে আসিলেন। তথায় মনোরমার অতি মলিনা, উন্মাদিনী মূর্ত্তি, তাহার স্থির গম্ভীর, এখনও অনিন্দ্য-সুন্দর, মুখকান্তি দেখিয়া তাঁহার চক্ষের জল আপনি বহিতে লাগিল। তিনি বলিলেন “মনোরমে! ভগিনি! এ কি এ?”

 তখন মনোরমা, জ্যোৎস্নাপ্রদীপ্ত সরোবর তুল্য স্থির মূর্ত্তিতে মৃদু-গম্ভীর স্বরে, কহিলেন, “ভ্রাতঃ যে জন্য আমার জীবন, তাহা আজি চরমপ্রাপ্ত হইয়াছে। অদ্য আমি আমার স্বামীর সঙ্গে গমন করিব।”

 মনোরমা সংক্ষেপে অন্যের অশ্রাব্য স্বরে হেমচন্দ্রের নিকট পূর্ব্বকথার পরিচয় দিয়া বলিলেন,

 “আমার স্বামী অপরিমিত ধনসঞ্চয় করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। আমি এক্ষণে সে ধনের অধিকারিণী। আমি তাহা তোমাকে দান করিতেছি। তুমি তাহা গ্রহণ করিও। নচেৎ পাপিষ্ঠ যবনে তাহা ভোগ করিবে। তাহার অল্পাংশ ব্যয় করিয়া জনার্দ্দন শর্ম্মাকে কাশীধামে স্থাপন করিবে। জনার্দ্দনকে অধিক ধন দিও না। তাহা হইলে যবনে অপহরণ করিবে। আমার দাহান্তে তুমি আমার স্বামীর গৃহে গিয়া অর্থের অনুসন্ধান করিও। আমি যে স্থান বলিয়া দিতেছি সেই স্থান খনন করিলেই তাহা পাইবে। আমি ভিন্ন সে স্থান আর কেহই জানে না।” এই বলিয়া মনোরমা যথায় অর্থ আছে তাহা বর্ণিত করিলেন।

 তখন মনোরমা আবার হেমচন্দ্রের নিকট বিদায় হইলেন। জনার্দ্দনকে ও তাঁহার পত্নীকে উদ্দেশে প্রণাম করিয়া হেমচন্দ্রের দ্বারা তাঁহাদিগের নিকট কত স্নেহসূচক কথা বলিয়া পাঠাইলেন।

 পরে ব্রাহ্মণেরা মনোরমাকে যথা শাস্ত্র এই ভীষণ ব্রতে বৃতা করাইলেন। এবং শাস্ত্রীয় আচারান্তে, মনোরমা ব্রাহ্মণের আনীত নূতন বস্ত্র পরিধান করিলেন। দিব্য বসন পরিধান করিয়া, দিব্য পুষ্পমালা কণ্ঠে পরিয়া, পশুপতির প্রজ্বলিত চিতা প্রদক্ষিণ পূর্ব্বক, তদুপরি আরোহণ করিলেন। এবং সহাস্য আননে সেই প্রজ্বলিত হুতাশন রাশির মধ্যে উপবেশন করিয়া, নিদাঘসন্তপ্ত-কুসুম-কলিকার ন্যায় অনলতাপে প্রাণত্যাগ করিলেন।

―――