মৃণালিনী/তৃতীয় খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।


মৃণালিনীর লিপি।

 মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়ে, তিনি রাগ করিয়া বলিয়া থাকিবেন, ‘উত্তম হইয়াছে।’ আমি তাঁহাকে বঞ্চনা করিয়া মথুরায় বিবাহ করিতে গিয়াছি, ইহা শুনিয়া তিনি কেনই বা রাগ না করিবেন?”

 গিরিজায়ারও তখন সংশয় জন্মিল। সে কহিল, “ইহা সম্ভব বটে।”

 তখন মৃণালিনী কহিলেন, “তুমি এ কথা বলিয়া ভাল কর নাই। ইহা সংশোধন কর্ত্তব্য; তুমি আহারাদি করিতে যাও। আমি ততক্ষণ একখানি পত্র লিখিয়া রাখিব। তুমি আহারান্তে সেই লিপি লইয়া তাঁহার নিকট যাইবে।”

 গিরিজায়া স্বীকৃত হইয়া সত্বরে আহারাদির জন্য গমন করিল। মৃণালিনী সংক্ষেপে পত্র লিখিলেন।

 লিখিলেন,

 “গিরিজায়া মিথ্যাবাদিনী। যে কারণে সে তোমার নিকট মৎসম্বন্ধে মিথ্যা বলিয়াছে তাহা জিজ্ঞাসা করিলে, সে স্বয়ং বিস্তারিত করিয়া কহিবে। আমি মথুরায় যাই নাই। যে রাত্রে তোমার অঙ্গুরীয় দেখিয়া যমুনাতটে আসিয়াছিলাম, সেই রাত্র অবধি আমার পক্ষে মথুরার পথ রুদ্ধ হইয়াছে। আমি মথুরায় না গিয়া তোমাকে দেখিতে নবদ্বীপে আসিয়াছি। নবদ্বীপে আসিয়াও যে এ পর্য্যন্ত তোমার সহিত সাক্ষাৎ করি নাই তাহার এক কারণ এই, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলে তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হইবে। আমার অভিলাষ তোমাকে দেখিব, তৎসিদ্ধিপক্ষে তোমাকে দেখা দেওয়ার আবশ্যক কি?”

 গিরিজায়া এই লিপি লইয়া পুনরপি হেমচন্দ্রের গৃহাভিমুখে যাত্রা করিল। সন্ধ্যাকালে, মনোরমার সহিত কথোপকথন সমাপ্তির পরে, হেমচন্দ্র গঙ্গদর্শনে যাইতেছিলেন, পথে গিরিজায়ার সহিত সাক্ষাৎ হইল। গিরিজায়া তাঁহার হস্তে লিপি দান করিল।

 হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি আবার কেন?”

 গি। “পত্র লইয়া আসিয়াছি।”

 হে। “পত্র কাহার?”

 গি। “মৃণালিনীর পত্র।”

 হেমচন্দ্র বিস্মিত হইলেন, “এ পত্র কি প্রকারে তোমার নিকট আসিল?”

 গি। “মৃণালিনী নবদ্বীপে আছেন। আমি মথুরার কথা আপনার নিকট মিথ্যা বলিয়াছি।”

 হে। “এই পত্র তাহার?”

 গি। “হাঁ তাহার স্বহস্তলিখিত।” হেমচন্দ্র লিপিখানি না পড়িয়া তাহা খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিন্ন ভিন্ন করিলেন। ছিন্ন খণ্ড সকল বনমধ্যে নিক্ষিপ্ত করিয়া কহিলেন,

 “তুমি যে মিথ্যাবাদিনী তাহা আমি ইতিপূর্ব্বেই শুনিতে পাইয়াছি। তুমি যে দুষ্টার পত্র লইয়া আসিয়াছ, সে যে বিবাহ করিতে যায় নাই, হৃষীকেশ কর্ত্তৃক গৃহবহিস্কৃতা হইয়াছে তাহা আমি ইতিপূর্ব্বেই শ্রুত হইয়াছি। আমি কুলটার পত্র পাঠ করিব না। তুমি আমার সম্মুখ হইতে দূর হও।”

 গিরিজায়া চমৎকৃতা হইয়া নিরুত্তরে হেমচন্দ্রের মুখপানে চাহিয়া রহিল।

 হেমচন্দ্র পথপার্শ্বস্থ এক ক্ষুদ্র বৃক্ষের শাখা ভগ্ন করিয়া হস্তে লইয়া কহিলেন, “দূর হও, নচেৎ বেত্রাঘাত করিব।”

 গিরিজায়া ভীতা হইয়া পলায়ন করিল। তাহার একটি গীত মনে আসিল, কিন্তু গায়িতে পারিল না।

 গিরিজায়া প্রত্যাগতা হইয়া হেমচন্দ্রের আচরণ মৃণালিনীর নিকট সবিশেষ বিবরিত করিল। এবার কিছু লুকাইল না। মৃণালিনী শুনিয়া কোন উত্তর করিলেন না। রোদনও করিলেন না। যেরূপ অবস্থায় শ্রবণ করিতেছিলেন, সেইরূপ অবস্থাতেই রহিলেন। দেখিয়া গিরিজায়া শঙ্কান্বিতা হইল—তখন মৃণালিনীর কথোপকথনের সময় নহে বুঝিয়া তথা হইতে সরিয়া গেল।

 গিরিজায় অগত্যা রত্নময়ীর নিকট গেল। কহিল “সই!”

 রত্ন। “কেন সই?”

 গিরি। “আমার বড় একটি দুঃখ হইয়াছে।”

 রত্ন। “কেন সই—তুমি সকল রসের রসমই—তোমার আবার দুঃখ কি সই।”

 গিরি। “দুঃখ এই সই—বৈকাল অবধি আমার গীত গায়িবার বড় ইচ্ছা হইয়াছে—গান থামে না—কিন্তু গান গায়িতে পারিতেছি না।”

 রত্ন। “কেন একি অলক্ষণ; কাঁকুড় গিলিতে গলায় বেঁধেছে না কি? নইলে তোমার গলা বন্ধ? নূন খেয়েছ বা।”

 গিরি। “তা না সই—মৃণালিনী কঁদিতেছে—পাছে আমি গীত গায়িলে রাগ করে?”

 রত্ন। “কেন, মৃণালিনী কঁদিতেছে কেন?”

 গিরি। “তা কি জানি, জিজ্ঞাসা করিলে বলিবে না। সে কাঁদিয়াই থাকে। আমি এখন গীত গায়িলে পাছে রাগ করে?”

 রত্ন। “তা করুক, তুমি এমন সাধে বঞ্চিত হবে কেন? চন্দ্রসূর্য্যের পথ বন্ধ হবে তবু তোমার গলাবন্ধ হবে না। তুমি এখানে না পার, পুকুর ধারে বসিয়া গাও।”

 গি। “বেশ বলেছ সই। তুমি শুন।”

 এই বলিয়া গিরিজায়া পাটনীর গৃহের অনতিদূরে যে এক সোপানবিশিষ্ট পুষ্করিণী ছিল, তথায় গিয়া সোপানোপরি উপবেশন করিল। শারদীয়া পূর্ণিমার প্রদীপ্ত কৌমুদীতে পুষ্করিণীর স্বচ্ছ নীলাম্বু অধিকতর নীলোজ্জ্বল হইয়া প্রভাসিত হইতেছিল। তদুপরি শ্বেত রক্ত কুমুদমালা অর্দ্ধ প্রস্ফুটিত হইয়া নীল জলে প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল; চারিদিকে বৃক্ষমালা নিঃশব্দে পরস্পরাশ্লিষ্ট হইয়া আকাশের সীমা নির্দ্দেশ করিতেছিল; ক্কচিৎ দুই একটি দীর্ঘশাখা উর্দ্ধোত্থিত হইয়া আকাশ পটে চিত্রিত হইয়া রহিয়াছিল। তলস্থ অন্ধকারপুঞ্জ মধ্য হইতে নবস্ফুট কুসুম সৌরভ আসিতেছিল। গিরিজায়া সোপানোপরি উপবেশন করিল। সে জানিত, যে তথা হইতে সঙ্গীত ধ্বনি মৃণালিনীর কর্ণগোচর হইবার সম্ভাবনা—কিন্তু ইহাও তাহার নিতান্ত অসাধ নহে—বরং তাহাই কতক উদ্দেশ্য। আর উদ্দেশ্য নিজ পরযন্ত্রণাকাতর বিকৃতচিত্তের ভাবব্যক্তি। গিরিজায়া ভিখারিণী বেশে কবি; স্বয়ং কখন কবিতা রচনা করুক বা না করুক, কবির স্বভাবসিদ্ধ চিত্তচাঞ্চল্যপরতা প্রাপ্ত হইয়াছিল। সুতরাং কবি। কে না জানে যে কবির মনঃসরোবরে বায়ু বহিলে বীচি বিক্ষিপ্ত হয়?

 গিরিজায়। প্রথমে ধীরে ধীরে, মৃদু মৃদু, গীত আরম্ভ করিল—যেন নবশিক্ষিত বিহঙ্গিনী প্রথমোদ্যমে স্পষ্ট গান করিতে পারিতেছে না। ক্রমে তাহার স্বর স্পষ্টতালাভ করিতে লাগিল—ক্রমে ক্রমে উচ্চতর হইতে লাগিল, শেষে সেই সর্ব্বাঙ্গ সম্পূর্ণ তানলয়বিশিষ্ট কমনীয় কণ্ঠধ্বনি, পুষ্করিণী, উপবন, আকাশ প্লাবিত করিয়া, স্বর্গচ্যুত স্বরসরিত্তরঙ্গ স্বরূপ মৃণালিনীর কর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল। গিরিজায়া গায়িল।

পরাণ না গেলো।
যো দিন দেখনু সই যমুনা কি তীরে,
গায়ত নাচত সুন্দর ধীরে ধীরে,
ওঁহি পর পিয় সই, কাহে বারি তীরে,
জীবন না গেলো?
ফিরে ঘর আয়নু, না কহনু বোলি,
তিতায়নু আঁখিনীরে আপনা আঁচোলি,
যব কাঁদনু লাগি সই, কাহে না পরাণি,
তই ক্ষণ না গেলো?
শুননু শ্রবণ পথে মধুর বাজে,
রাধে রাধে রাধে রাধে বিপিন মাঝে,
যব শুননু লাগি সই, সো মধুর বোলি,
জীবন না গেলো?
ধায়নু পিয়সই, সোহি উপকূলে,
লুটায় কাঁদি সই শ্যাম পদ মূলে,
সোহি পদ মূলে রই, কাহেলো হামারি,
মরণ না ভেল?

 গিরিজায়া গায়িতে গায়িতে দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে চন্দ্রের কিরণোপরে মনুষ্যের ছায়া পড়িয়াছে। ফিরিয়া দেখিলেন, মৃণালিনী দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহার মুখ প্রতি চাহিয়া দেখিলেন, মৃণালিনী কাঁদিতেছেন।

 গিরিজায়া দেখিয়া হর্ষান্বিত হইলেন,—তিনি বুঝিতে পারিলেন যে যখন মৃণালিনীর চক্ষে জল আসিয়াছে—তখন তাঁহার ক্লেশের কিছু শমতা হইয়াছে। ইহা সকলে বুঝে না—মনে করে “কই, ইহার চক্ষে ত জল দেখিলাম না? তবে ইহার কিসের দুঃখ?” যদি ইহা সকলে বুঝিত, সংসারের কত মর্ম্মপীড়াই না জানি নিবারণ হইত।

 কিয়ৎক্ষণ উভয়েই নীরব হইয়া রহিলেন। মৃণালিনী কিছু বলিতে পারেন না গিরিজায়াও কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারেন পরে মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া, আর একবার তোমাকে যাইতে হইবে।”

 গি। “আবার সে পাষণ্ডের নিকট যাইব কেন?”

 মৃ। “পাষণ্ড বলিও না। হেমচন্দ্র ভ্রান্ত হইয়া থাকিবেন—এ সংসারে অভ্রান্ত কে? কিন্তু হেমচন্দ্র পাষণ্ড নহেন। আমি স্বয়ং তাঁহার নিকট এখনই যাইব—তুমি সঙ্গে চল। তুমি আমাকে ভগিনীর অধিক স্নেহ কর—তুমি আমার জন্য না করিয়াছ কি? তুমি কখন আমাকে অকারণে মনঃপীড়া দিবে না— কখন আমার নিকট এ সকল কথা মিথ্যা করিয়া বলিবে না, ইহা আমি নিশ্চিত জানি। কিন্তু তাই বলিয়া, আমার হেমচন্দ্র আমাকে বিনাপরাধে ত্যাগ করিলেন ইহা তাঁহার মুখে না শুনিয়া কি প্রকারে অন্তঃকরণকে স্থির করিতে পারি? যদি তাঁহার নিজমুখে শুনি যে তিনি মৃণালিনীকে কুলটা ভাবিয়া ত্যাগ করিলেন, তবে এ প্রাণ বিসর্জ্জন করিতে পারিব।”

 গি। “প্রাণ বিসর্জ্জন! সে কি মৃণালিনি?”

 মৃণালিনী কোন উত্তর করিলেন না। গিরিজায়ার স্কন্ধে বাহু রোপণ করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। গিরিজায়াও রোদন করিল।

 ক্ষণেক পরে গিরিজায়া মৃণালিনীর হস্ত ধীরে ধীরে নিজ স্কন্ধচ্যুত করিয়া চলিলেন।