মৃণালিনী/তৃতীয় খণ্ড/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ।


এত দিনের পর।

 হেমচন্দ্র মৃণালিনীকে হস্ত ধরিয়া তুলিলেন। উভয়ে উভয়ের সম্মুখীন হইয়া দাঁড়াইলেন।

 এত কাল পরে, দুই জনের সাক্ষাৎ হইল। যে দিন প্রদোযকালে, যমুনার উপকূলে, নৈদাঘানিলসন্তাড়িত বকুলতলে দাঁড়াইয়া, নীলাম্বুময়ীর চঞ্চম তরঙ্গশিরে নক্ষত্ররশ্মির প্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করিতে করিতে উভয়ে উভয়ের নিকট সজলনয়নে বিদায় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহার পর এই সাক্ষাৎ হইল। নিদাঘের পর বর্ষা গিয়াছে বর্ষার পর শরৎ যায়, কিন্তু ইহাদিগের হৃদয়মধ্যে যে কত দিন গিয়াছে তাহা কি ঋতু গণনায় গণিত হইতে পারে?

 সেই নিশীথ সময়ে, স্বচ্ছসলিলা বাপীতীরে, দুইজনে পরস্পর সম্মুখীন হইয়া দাঁড়াইলেন। চারিদিকে, সেই নিবীড় বন, ঘনবিন্যস্ত লতাস্রগ্‌বিশোভী বিশাল বিটপী সকল দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল; সম্মুখে নীলনীরদ খণ্ডবৎ দীর্ঘিকা শৈবাল-কুমুদ-কহলার সহিত বিস্তৃত রহিয়াছিল। শিরোপরে, চন্দ্র-নক্ষত্র-জলদ সহিত আকাশ আলোকে হাসিতেছিল। চন্দ্রালোক, আকাশে, বৃক্ষশিরে, লতাপল্লবে, বাপীসোপানে, নীলজলে, সর্ব্বত্র হাসিতেছিল। প্রকৃতি স্পন্দহীনা, ধৈর্যময়ী। সেই ধৈর্য্যময়ী প্রকৃতির প্রসাদ মধ্যে, মৃণালিনী, হেমচন্দ্র, মুখে মুখে দাঁড়াইলেন।

 ভাষার কি শব্দ ছিল না? তাহাদিগের মনে কি বলিবার কথা ছিল না? যদি মনে বলিবার কথা ছিল, ভাষার শব্দ ছিল, তবে কেন ইহারা কথা কহে না?

 মনুষ্যের একটী ব্যতীত মন নহে। তখন চক্ষেরে দেখাইতেই মন উন্মত্ত—কথা কহিবে কি প্রকারে? এমত সময়ে কেবল প্রণয়ীর নিকটে অবস্থিতিমাত্র, এত গুরুতর সুখ, যে হৃদয়মধ্যে অন্য সুখের স্থান থাকে না। যে সে সুখ ভোগ করিতে থাকে, সে আর কথার সুখ বাসনা করে না।

 সে সময়ে এত কথা বলিবার থাকে, যে কোন্ কথা আগে বলিব, তাহা কেহ স্থির করিতে পারে না।

 মনুষ্যভাষায় এমন কোন্ শব্দ আছে যে সে সময়ে প্রযুক্ত হইতে পারে?

 তাঁহারা পরস্পরের মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। হেমচন্দ্র, মৃণালিনীর সেই প্রেমময় মুখ আবার দেখিলেন—হৃষীকেশবাক্যে প্রত্যয় দূর হইতে লাগিল। সে গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ত প্রেমোক্তি লেখা আছে! হেমচন্দ্র তাঁহার লোচন প্রতি চাহিয়া রহিলেন, সেই অপূর্ব্ব আয়তনশালী—ইন্দীবরনিন্দিত, অন্তঃকরণের দর্পণরূপ চক্ষুঃপ্রতি চাহিয়া রহিলেন—তাহা হইতে কেবল প্রেমাশ্রুজল বহিতেছে!—সে চক্ষুঃ যাহার সে কি অবিশ্বাসিনী!

 হেমচন্দ্র প্রথমে কথা কহিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃণালিনি! কেমন আছ?”

 মৃণালিনী উত্তর করিতে পারিলেন না। এখনও তাঁহার চিত্তশান্ত হয় নাই; উত্তরের উপক্রম করিলেন; কিন্তু আবার চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল। কণ্ঠরুদ্ধ হইল; কথা সরিল না।

 হেমচন্দ্র আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কেন আসিয়াছ?”  মৃণালিনী তথাপি উত্তর করিতে পারিলেন না। হেমচন্দ্র তাঁহার হস্ত ধারণ করিয়া সোপানোপরি বসাইলেন, স্বয়ং নিকটে বসিলেন। মৃণালিনীর যে কিছু চিত্তের স্থিরতা ছিল, এই আদরে তাহা লোপ হইল। ক্রমে ক্রমে, তাঁহার মস্তক আপনি আসিয়া হেমচন্দ্রের স্কন্ধে স্থাপিত হইল, মণালিনী তাহা জানিমাও জানিতে পারিলেন না। কিন্তু আবার রোদন করিলেন— তাঁহার অশ্রুজলে হেমচন্দ্রের স্বন্ধ আর বক্ষঃ প্লাবিত হইল। এ সংসারে মৃণালিনী যত সুখ অনুভূত করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে কোন সুখই এই রোদনের তুল্য নহে।

 হেমচন্দ্র আবার কথা কহিলেন। “মৃণালিনি! আমি তোমার নিকট গুরুতর অপরাধ করিয়াছি। সে অপরাধ আমায় ক্ষমা করিও। আমি তোমার নামে কলঙ্করটনা শুনিয়া তাহা বিশ্বাস করিয়াছিলাম। বিশ্বাস করিবার কতক কারণও ঘটিয়াছিল—তাহা তুমি দূর করিতে পারিবে। যাহা আমি জিজ্ঞাসা করি তাহার পরিষ্কার উত্তর দাও।”

 মৃণালিনী হেমচন্দ্রের স্কন্ধ হইতে মস্তক না তুলিয়া কহিলেন “কি?”

 হেমচন্দ্র বলিলেন, “তুমি হৃষীকেশের গৃহত্যাগ করিলে কেন?”

 ঐ নাম শ্রবণমাত্র কুপিতা ফণিনীর ন্যায় মৃণালিনী মস্তকোত্তোলন করিলেন। কহিলেন, “হৃষীকেশ আমাকে গৃহ হইতে বিদায় করিয়া দিয়াছে।”

 হেমচন্দ্র ব্যথিত হইলেন—অল্প সন্দিহান হইলেন—কিঞ্চিৎ চিন্তা করিলেন। এই অবকাশে মৃণালিনী পুনরপি হেমচন্দ্রের স্কন্ধে মস্তক রাখিলেন। সে সুখাসনে শিরোরক্ষা এত সুখ, যে মৃণালিনী তাহাতে বঞ্চিত হইয়া থাকিতে পারিলেন না।  হেমচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন তোমাকে হৃষীকেশ গৃহবহিস্কৃত করিয়া দিল?”

 মৃণালিনী হেমচন্দ্রের হৃদয়মধ্যে মুখ লুকাইলেন। অতি মৃদুরবে কহিলেন, “তোমাকে কি বলিব! হৃষীকেশ আমাকে কুলটা বলিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে!”

 শ্রুতমাত্র তীরের ন্যায় হেমচন্দ্র দাঁড়াইয়া উঠিলেন। মৃণালিনীর মস্তক তাঁহার বক্ষশ্চ্যুত হইয়া সোপানে আহত হইল।

 “পাপীয়সি—নিজমুখে স্বীকৃত হইলি!” এই কথা দন্তমধ্য হইতে ব্যক্ত করিয়া হেমচন্দ্র বেগে প্রস্থান করিলেন। পথে গিরিজায়াকে দেখিলেন; গিরিজায়া, তাঁহার সজলজলদভীমমূর্ত্তি দেখিয়া চমকিয়া দাঁড়াইল। লিখিতে লজ্জা করিতেছে—কিন্তু না লিখিলে নয়। হেমচন্দ্র পদাঘাতে গিরিজায়াকে পথ হইতে অপসৃতা করিলেন। বলিলেন, “তুমি যাহার দূতী তাহাকে পদাঘাত করিলে আমার চরণ কলঙ্কিত হইত।” এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহে চলিয়া গেলেন।

 যাহার ধৈর্য্য নাই, যে ক্রোধের জন্মমাত্র অন্ধ হয়, সে সংসারের সকল সুখে বঞ্চিত। কবি কল্পনা করিয়াছেন, যে কেবল অধৈর্য্য মাত্র দোষে বীরশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্য্যের নিপাত হইয়াছিল। “অশ্বত্থামা হতঃ” এই শব্দ মাত্র শুনিয়া তিনি ধনুর্ব্বাণ ত্যাগ করিলেন। প্রান্তর দ্বারা সবিশেষ তত্ত্ব লইলেন না। হেমচন্দ্রের কেবল অধৈর্য্য নহে—অধৈর্য্য, অভিমান, ক্রোধ।

 শীতল সমীরণময়ী উষার পিঙ্গল মূর্ত্তি বাপীতীরবনে উদয় হইল। তখনও মৃণালিনী আহত মস্তক ধারণ করিয়া সোপানে বসিয়া আছেন। গিরিজায় জিজ্ঞাসা করিল,

 “ঠাকুরাণি, আঘাত কি গুরুতর বোধ হইতেছে?”

 মৃণালিনী কহিলেন, “কিসের আঘাত?”  গি। “মাতায়।”

 মৃ। “মাতায় আঘাত? আমার মনে হয় না।”