মৃণালিনী/তৃতীয় খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।


গিরিজায়ার সম্বাদ।

 গিরিজায়া যখন পাটনীর গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করে, তখন প্রাণান্তে হেমচন্দ্রের নবানুরাগের কথা মৃণালিনীর সাক্ষাতে ব্যক্ত করিবে না স্থির করিয়াছিল। মৃণালিনী তাহার আগমন প্রতীক্ষায় পিঞ্জরে বদ্ধ বিহঙ্গিনীর ন্যায় চঞ্চলা হইয়া রহিয়াছিলেন; গিরিজায়াকে দেখিবামাত্র কহিলেন, “বল গিরিজায়ে, কি দেখিলে? হেমচন্দ্র কেমন আছেন?”

 গিরি জায়া কহিল “ভাল আছেন?”

 মৃ। “কেন, অমন করিয়া বলিলে কেন? তোমার কণ্ঠস্বরে উৎসাহ নাই কেন? যেন দুঃখিত হইয়া বলিতেছ কেন?”

 গি। “কই কিছু না।”

 মৃ। “গিরিজায়া আমাকে প্রতারণা করিও না; হেমচন্দ্র কি আরোগ্যলাভ করেন নাই, তাহা হইলে আমাকে স্পষ্ট করিয়া বল। সন্দেহের অপেক্ষা প্রতীতি ভাল।”

 গিরিজায়া এবার সহাস্যে কহিল, “তুমি কেন অনর্থক ব্যস্ত হও। আমি নিশ্চিত বলিতেছি তাঁহার শরীরে কিছুই ক্লেশ নাই। তিনি উঠিয়া বেড়াইতেছেন।”

 মৃণালিনী ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “মনোরমার সহিত তাঁহার কোন কথা বার্ত্তা শুনিলে?”

 গি। “শুনিলাম।”

 মৃ। “কি শুনিলে?”

 গিরিজায়া তখন হেমচন্দ্র বিবরিত কথা সকল কহিলেন। কেবল হেমচন্দ্রের সগোচরে যে মনোরমা নিশা পর্য্যটন করিয়াছেন ও কাণে কাণে কথা বলিয়াছিলেন, এই দুইটা বিষয় গোপন করিলেন। মৃণালিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি হেমচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছ?”

 গিরিজায়া কিছু ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, “করিয়াছি।”

 মৃ। “তিনি কি কহিলেন?”

 গি। “তোমার কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।

 মৃ। “তুমি কি বলিলে?”

 গি। “আমি কহিলাম তুমি ভাল আছ।”

 মৃ। “আমি এখানে আসিয়াছি তাহা বলিয়াছ?”

 গি। “না।”

 মৃ। “গিরিজায়া, তুমি ইতস্ততঃ করিয়া উত্তর দিতেছ। তোমার মুখ শুস্ক। তুমি আমার মুখপানে চাহিতে পারিতেছ না। আমি নিশ্চিত বুঝিতেছি তুমি কোন অমঙ্গল সম্বাদ আমার নিকট গোপন করিতেছ। আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। যাহা থাকে অদৃষ্টে, আমি স্বয়ং হেমচন্দ্রকে দেখিতে যাইব। পার, আমার সঙ্গে আইস, নচেৎ আমি একাকিনী যাইব।”

 এই বলিয়া মৃণালিনী অবগুণ্ঠনে মুখাবৃত করিয়া বেগে রাজপথে আরোহণ করিয়া চলিলেন।

 গিরিজায়া তাঁহার পশ্চাদ্ধাবিতা হইল। কিছু দূর আসিয়া তাঁহার হস্ত ধরিয়া কহিল, “ঠাকুরাণি, ফের; আমি যাহা গোপন করিয়াছি তাহা প্রকাশ করিতেছি।”

 মৃণালিনী গিরিজায়ার সঙ্গে সঙ্গে গৃহে ফিরিয়া আসিলেন। তখন গিরিজায় যাহা যাহা গোপন করিয়াছিল তাহা সবিস্তারে প্রকাশিত করিল।

 য়ুনানীয়েরা প্রণয়েশ্বর ক্যুপিদ্‌কে অন্ধ বলিয়া কল্পনা করিত। তিনি কাণা হউন, কিন্তু তাঁহার সেবক সেবিকারা রাত্রি দিন চক্ষুঃ চাহিয়া থাকে। যে বলে যে প্রেমাসক্ত ব্যক্তি অন্ধ সে হস্তিমূর্খ। আমি যদি অন্যাপেক্ষা তোমাকে অধিক ভালবাসি, তাহাহইলে ইহা নিশ্চিত, যে অন্যে যাহা দেখিতে পায় তদপেক্ষা আমি তোমার অধিক গুণ দেখি। সুতরাং এখানে অন্যাপেক্ষা আমার দৃষ্টির তীব্রতা অধিক। তবে অন্ধ হইলাম কই?