মৃণালিনী/প্রথম খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।


গজহন্তা।

 কুতবউদ্দীন, দেওয়ানে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক বখ্‌তিয়ার খিলিজি এবং অন্যান্য বন্ধুবর্গ লইয়া কথোপকথনে নিযুক্ত ছিলেন, এমত সময়ে কয়েক জন সৈনিক পূর্ব্বপরিচিত হিন্দু যুবাকে সশস্ত্র ধৃত করিয়া আনয়ন করিল।

 রক্ষিগণ অনুমতি প্রাপ্ত হইয়া যুবাকে রাজপ্রতিনিধিসমক্ষে উপস্থিত করিলে, কুতবউদ্দীন বিশেষ মনোযোগ পূর্ব্বক তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। যুবকের অবয়বও নিরীক্ষণযোগ্য। তাঁহার বয়ঃক্রম পঞ্চবিংশতি বৎসরের ন্যূন। শরীর ঈষন্মাত্র দীর্ঘ, এবং অনতিস্থূল ও বলব্যঞ্জক। মস্তক যেরূপ পরিমিত হইলে, শরীরের উপযোগী হইত, তদপেক্ষা বৃহৎ, এবং তাহার গঠন অতি রমণীয়। ললাট প্রশস্ত বটে, কিন্তু অল্পবয়ঃপ্রযুক্ত অনতিবৃহৎ, তাহার মধ্য দেশে “রাজদণ্ড” নামে পরিচিত শিরা প্রকটিত। ভ্রূযুগ সূক্ষ্ম, তরলরোম; তত্তলস্থ অস্থি কিছু উন্নত। চক্ষুঃ বিশেষ আয়ত নহে, কিন্তু অসাধারণ ঔজ্জ্বল্য গুণে আয়ত বলিয়া বোধ হইত। নাসা মুখের উপযোগী; অত্যন্ত দীর্ঘ নহে, কিন্তু অগ্রভাগ সূক্ষ্ম। ওষ্ঠাধর ক্ষুদ্র; সর্ব্বদা পরস্পরে সংশ্লিষ্ট; পার্শ্বভাগে অস্পষ্ট মণ্ডলার্দ্ধ রেখায় বেষ্টিত। ওষ্ঠে ও চিবুকে কোমল নবীন রোমাবলি শোভা পাইতেছিল। অঙ্গের গঠন, বলসূচক হইলেও, কর্কশতা শূন্য। বর্ণ প্রায় সম্পূর্ণ গৌর। অঙ্গে কবচ, মস্তকে উষ্ণীষ, পৃষ্ঠে তূণীর লম্বিত; করে ধনুঃ; কটিবন্ধে অসি।

 কুতবউদ্দীন যুবাকে আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করিতেছেন, দেখিয়া যুবা ভ্রূকুটী করিলেন এবং কুতবকে কহিলেন, “আপনকার কি আজ্ঞা?”

 শুনিয়া কুতব হাসিলেন। বলিলেন, “তুমি কি শরত্যাগে আমার হস্তী বধ করিয়াছ?”

 যুবা। “করিয়াছি।”

 কু। “কেন তুমি আমার হাতী মারিলে?”

 যুবা। “না মারিলে হাতী আপনার সেনাপতিকে মারিত।”

 ইহা শুনিয়া বখ্‌তিয়ার খিলিজি বলিলেন, “হাতী আমার কি করিত?”

 যুবা। “চরণে দলিত করিত।”

 বখ্‌তিয়ার। “আমার কুঠার কি জন্য ছিল?”

 যুবা। “হস্তীকে পিপীলিকা দংশনের ক্লেশানুভব করাইবার জন্য।”

 কুতব উদ্দীনের ওষ্ঠাধরপ্রান্তে অল্পমাত্র হাস্য প্রকটিত হইল। সেনাপতি অপ্রতিভ হয়েন দেখিয়া কুতবউদ্দীন তখন কহিলেন,

 “তুমি হিন্দু, মুসলমানের বল জান না। সেনাপতি, অনায়াসে কুঠারাঘাতে হস্তিবধ করিত। তথাপি তুমি যে সেনাপতির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় তীরত্যাগ করিয়াছিলে—ইহাতে তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হইলাম। তোমাকে পুরস্কৃত করিব।” এই বলিয়া কুতবউদ্দীন কোষাধ্যক্ষের প্রতি যুবাকে শত মুদ্রা দিতে অনুমতি করিলেন।

 যুবা শুনিয়া কহিলেন, “যবন রাজপ্রতিনিধি! শুনিয়া লজ্জিত হইলাম। যবন সেনাপতির জীবনের মূল্য কি শত মুদ্রা?”

 কুতবউদ্দীন কহিলেন, “তুমি রক্ষা না করিলে যে সেনাপতির জীবন বিনষ্ট হইত, এমত নহে। তথাপি সেনাপতির মর্য্যাদানুসারে দান উচিত বটে। তোমাকে সহস্র মুদ্রা দিতে অনুমতি করিলাম।”

 যুবা। “যবনের বদান্যতায় আমি সন্তুষ্ট হইলাম। আমিও আপনাকে প্রতিপুরস্কৃত করিব। যমুনাতীরে আমার বাসগৃহ, সেই পর্য্যন্ত আমার সঙ্গে এক জন লোক দিলে, আমি আপনার পুরস্কার পাঠাইব। যদি রত্ন অপেক্ষা মুদ্রায় আপনার আদর অধিক হয়, তবে আমার প্রদত্ত রত্ন বিক্রয় করিবেন। দিল্লীর শ্রেষ্ঠীরা তদ্বিনিময়ে আপনাকে লক্ষ মুদ্রা দিবে।”

 কুতবদ্দীন কহিলেন, “হইতে পারে, তুমি ধনী। এজন্য সহস্র মুদ্রা তোমার গ্রহণযোগ্য নহে। কিন্তু তোমার বাক্য সম্মানসূচক নহে—তুমি সদভিপ্রেত কার্য্যে উদ্যত হইয়াছিলে বলিয়া অনেক ক্ষমা করিয়াছি—অধিক ক্ষমা করিব না। আমি যে তোমার রাজার প্রতিনিধি, তাহা তুমি কি বিস্মৃত হইলে?”

 যুবা। “আমার রাজার প্রতিনিধি ম্লেচ্ছ নহে।”

 কুতবউদ্দীন সকোপ কটাক্ষে কহিলেন, “তবে কে তোমার রাজা? কোন্ দেশে তোমার বাস?”

 যুবা। “মগধে আমার বাস?”

 কুত। “মগধ এই বখ্‌তিয়ার কর্ত্তৃক যবনরাজ্যভুক্ত হইয়াছে।”

 যুবা। “মগধ দস্যু কর্ত্তৃক পীড়িত হইয়াছে।”

 কুত। “দস্যু কে?”

 যুবা। “বখ্‌তিয়ার খিলিজি।”

 কুতবউদ্দীনের চক্ষে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। কহিলেন “তোমার মৃত্যু উপস্থিত।”

 যুবা হাসিয়া কহিলেন, “দস্যুহস্তে?”

 কুত। “আমার আজ্ঞায় তোমার প্রাণদণ্ড হইবে। আমি যবন সম্রাটের প্রতিনিধি।”

 যুবা। “আপনি যবন দস্যুর ক্রীত দাস।”[১]

 কুতবউদ্দীন ক্রোধে কম্পিত হইলেন। কিন্তু নিঃসহায় যুবকের সাহস দেখিয়াও বিস্মিত হইলেন। কুতবউদ্দীন রক্ষিবর্গকে অজ্ঞা করিলেন, “ইহাকে বন্ধন করিয়া বধ কর।”

 বখ্‌তিয়ার খিলিজি, ইঙ্গিতে তাহাদিগকে নিষেধ করিলেন। পরে কুতবকে বিনয় করিয়া কহিলেন, “প্রভো! এই হিন্দু বাতুল। নচেৎ অনর্থক কেন মৃত্যু কামনা করিবে? ইহাকে বধ করায় অপৌরুষ।”

 যুবা বখ্‌তিয়ারের মনের ভাব বুঝিয়া হাসিলেন। বলিলেন,

 “খিলিজি সাহাব! বুঝিলাম আপনি অকৃতজ্ঞ নহেন। আমি হস্তিচরণ হইতে আপনাকে রক্ষা করিয়াছি বলিয়া আপনি আমার প্রাণরক্ষার জন্য যত্ন করিতেছেন। কিন্তু নিবৃত্ত হউন। আমি আপনার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় হস্তী বধ করি নাই। আপনাকে একদিন স্বহস্তে বধ করিব বলিয়া আপনাকে হস্তীর চরণ হইতে রক্ষা করিয়াছি।”

 রাজপ্রতিনিধি এবং সেনাপতি উভয়ে উভয়ের মুখাবলোকন করিলেন। খিলিজি কহিলেন,

 “তুমি নিশ্চিত বাতুল। আপনি প্রাণ হারাইতে বসিয়াছ, অন্যে রক্ষা করিতে গেলে, তাহারও প্রতিবন্ধক হইতেছ। ভাল আমাকে স্বহস্তে বধ করিবার এত সাধ কেন?”

 যুবা। “কেন? তুমি আমার পিতৃরাজ্যাপহরণ করিয়াছ। আমি মগধরাজপুত্র। যুদ্ধকালে হেমচন্দ্র মগধে থাকিলে তাহা যবন দস্যু জয় করিতে পারিত না। অপহারী দস্যুর প্রতি রাজদণ্ড বিধান করিব।”

 বখ্‌তিয়ার কহিলেন, “এখন বাঁচিলে ত?”

 কুতবউদ্দীন কহিলেন, “তোমার যে পরিচয় দিতেছ এবং তোমার যেরূপ স্পর্দ্ধা তাহাতে তোমাকে ছাড়িয়া দিতে পারি না। তুমি এক্ষণে কারাগারে বাস করিবে। পশ্চাৎ তোমার প্রতি দণ্ডাজ্ঞা প্রচার হইবে। রক্ষিগণ, এখন ইহাকে কারাগারে লইয়া যাও।”

 রক্ষিগণ হেমচন্দ্রকে বেষ্টিত করিয়া লইয়া চলিল। কুতবউদ্দীন তখন বখ্‌তিয়ারকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন,

 “সাহাব! এই হিন্দুকে কি ভাবিতেছেন?”

 বখ্‌তিয়ার কহিলেন, “অগ্নিস্ফুলিঙ্গ স্বরূপ। যদি কখন হিন্দুসেনা পুনর্ব্বার সমবেত হয়, তবে এ ব্যক্তি সকলকে অগ্নিময় করিবে।”

 কুত। “সুতরাং অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পূর্ব্বেই নির্ব্বাণ করা কর্ত্তব্য।”

 উভয়ে এই রূপ কথোপকথন হইতেছিল ইত্যবসরে দুর্গমধ্যে তুমুল কোলাহল হইতে লাগিল। ক্ষণপরে পুররক্ষিগণ আসিয়া সম্বাদ দিল, যে বন্দী পলাইয়াছে।

 কুতবউদ্দীন ভ্রূভঙ্গ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি প্রকারে পলাইল?”

 রক্ষিগণ কহিল, “দুর্গমধ্যে একজন যবন একটা অশ্ব লইয়া ফিরাইতেছিল। আমরা বিবেচনা করিলাম যে কোন সৈনিকের অশ্ব। আমরা ঘোটকের নিকট দিয়া যাইতেছিলাম। তাহার নিকটে আসিবামাত্র বন্দী চকিতের ন্যায় লম্ফ দিয়া অশ্বপৃষ্ঠে উঠিল। এবং অশ্বে কষাঘাত করিয়া বায়ুবেগে দুর্গ দ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইল।”

 কুত। “তোমরা পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলে না কেন?”

 রক্ষি। “আমরা অশ্ব আনিতে আনিতে সে দৃষ্টিপথের অতীত হইল।”

 কুত। “তীর মারিলে না কেন?”

 রক্ষি। “মারিয়াছিলাম। তাহার কবচে ঠেকিয়া তীর সকল মাটিতে পড়িল।”

 কুত। “যে যবন অশ্ব লইয়া ফিরাইতেছিল সে কোথা?”

 রক্ষি। “প্রথমে আমরা বন্দীর প্রতিই মনোনিবেশ করিয়াছিলাম। পশ্চাৎ অশ্বপালের সন্ধান করায় তাহাকে দেখিতে পাইলাম না।”


  1. কুতবউদ্দীন আদৌ ক্রীতদাস ছিলেন।