মৃণালিনী/প্রথম খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

মৃণালিনী।


প্রথম খণ্ড।


প্রথম পরিচ্ছেদ।

রঙ্গভূমি।

 মহম্মদ ঘোরির প্রতিনিধি তুর্কস্থানীয় কুতুবউদ্দীন যুধিষ্ঠির ও পৃথ্বীরাজের সিংহাসনে উপবেশন করিয়াছেন। দিল্লী, কান্যকুব্জ, মগধাদি প্রাচীন সাম্রাজ্য সকল যবনকরকবলিত হইয়াছে। অশোক বা হর্ষবর্দ্ধন, বিক্রমাদিত্য বা শিলাদিত্য, ইহাঁদিগের পরিত্যক্ত ছত্রতলে যবনমুণ্ড আশ্রিত হইয়াছে। ক্ষত্রিয়, শূদ্র; নন্দবংশ, গুপ্তবংশ;—ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ; রাঠোর, তুয়ার; এ সকলে আর ভারতবর্ষের স্বামিত্ব লইয়া বিবাদ করে না। যবনের শ্বেত ছত্রে সকলের গৌরব ছায়ান্ধকারব্যাপ্ত করিয়াছে।

 বঙ্গীয় ৬০৬ অব্দে যবনকর্ত্তৃক মগধ জয় হইল। প্রভূত রত্ন-রাশি সঞ্চিত করিয়া বিজয়ী সেনাপতি বখ্‌তিয়ার খিলিজি, রাজ-প্রতিনিধির চরণে উপঢৌকন প্রদান করিলেন।

 কুতুবউদ্দীন প্রসন্ন হইয়া বখ্‌তিয়ার খিলিজিকে পূর্ব্বভারতের আধিপত্যে নিযুক্ত করিলেন। গৌরবে বখ্‌তিয়ার খিলিজি রাজপ্রতিনিধির সমকক্ষ হইয়া উঠিলেন।

 কেবল ইহাই নহে; বিজয়ীসেনাপতির সম্মানার্থ কুতবউদ্দীন মহাসমারোহ পূর্ব্বক উৎসবাদির জন্য দিনাবধারিত করিলেন।

 উৎসববাসর আগত হইল। প্রভাতাবধি, “রায় পিথোরার” প্রস্তরময় দুর্গের প্রাঙ্গনভূমি জনাকীর্ণ হইতে লাগিল। সশস্ত্রে, শত শত সিন্ধুনদপারবাসী শ্মশ্রুল যোদ্ধৃবর্গ রঙ্গাঙ্গনের চারিপার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইল; তাহাদিগের করস্থিত উন্নতফলক বর্ষার অগ্রভাগে প্রাতঃসূর্য্যকিরণ জ্বলিতে লাগিল। মালাসম্বন্ধ কুসুমদামের ন্যায় তাহাদিগের বিচিত্র উষ্ণীষশ্রেণী শোভা পাইতে লাগিল। তৎপশ্চাতে দাস, শিল্পী প্রভৃতি অপর মুসলমানেরা বিবিধ বেশভূষা করিয়া দণ্ডায়মান হইল। যে দুই এক জন হিন্দু কৌতূহলের একান্ত বশবর্ত্তী হইয়া সাহসে ভর করিয়া রঙ্গ দর্শনে আসিয়াছিল তাহারা তৎপশ্চাতে স্থান পাইল, অথবা স্থান পাইল না, কেন না যবনদিগের বেত্রাঘাতে ও পদাঘাতে পীড়িত এবং ভীত হইয়া অনেককে পলায়ন করিতে হইল।

 রাজপ্রতিনিধি স্বদলে সমাগত হইয়া রঙ্গাঙ্গনের শিরোভাগে দণ্ডায়মান হইলেন। তখন রহস্য আরম্ভ হইল। প্রথমে মল্লদিগের যুদ্ধ, পরে খড়্গী, শূলী, ধানুষ্কী, সশস্ত্র অশ্বারোহীর যুদ্ধ, হইতে লাগিল। পরে মত্ত সেনামাতঙ্গ সকল মাহুত সহিত আনীত হইয়া নানাবিধ ক্রীড়াকৌশল দেখাইতে লাগিল। দর্শকেরা মধ্যে মধ্যে একতানমনে ক্রীড়া সন্দর্শন করিতে লাগিলেন, মধ্যে মধ্যে আপন আপন মন্তব্য সকল পরস্পরের নিকট ব্যক্ত করিতে লাগিলেন। এক স্থানে কয়েকটী বর্ষীয়ান্ মুসলমান একত্র হইয়া বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিতেছিলেন।

 এক জন কহিল,

 “সত্য সত্যই কি পারিবে?”

 অপর উত্তর করিল,

 “না পারিবে কেন? ঈশ্বর যাহাকে সদয় সে কি না পারে? রোস্তম পাহাড় বিদীর্ণ করিয়াছিল, তবে বখ্‌তিয়ার যুদ্ধে একটা হাতী মারিতে পারিবে না?”

 তৃতীয় ব্যক্তি কহিল, “তথাপি উহার ঐ ত বানরের ন্যায় শরীর, এ শরীর লইয়া মত্ত হস্তীর সঙ্গে যুদ্ধে সাহস করা, পাগলের কাজ।”

 প্রথম প্রস্তাবকর্ত্তা কহিল “বোধ হয় খিলিজিপুত্র এক্ষণে তাহা বুঝিয়াছে; সেই জন্য এখনও অগ্রসর হইতেছে না।”

 আর এক ব্যক্তি কহিল, “আরে, বুঝিতেছ না, বখ্‌তিয়ারের মৃত্যুর জন্য পাঁচ জনে ষড়্‌যন্ত্র করিয়া এই এক উপায় করিয়াছে। বেহার জয় করিয়া বখ্‌তিয়ারের বড় দম্ভ হইয়াছে। আর রাজপ্রসাদ সকলই তিনি একক ভোগ করিতেছেন। এই জন্য পাঁচ জনে বলিল যে বখ্‌তিয়ার অমানুষ বলবান্, চাহি কি মত্ত হাতী একা মারিতে পারে। কুতুবউদ্দীন তাহা দেখিতে চাহিলেন। বখ্‌তিয়ার দম্ভে লঘু হইতে পারিলেন না, সুতরাং অগত্যা স্বীকার করিয়াছেন।”

 এই বলিতে বলিতে রঙ্গাঙ্গন মধ্যে তুমুল কোলাহল ধ্বনি সংঘোষিত হইল। দ্রষ্টৃবর্গ সভয় চক্ষে দেখিলেন, পর্ব্বতাকার, শ্রাবণের দিগন্তব্যাপী জলদাকার, এক মত্ত মাতঙ্গ, মাহুত কর্ত্তৃক আনীত হইয়া, রঙ্গাঙ্গন মধ্যে দুলিতে দুলিতে প্রবেশ করিল। তাহার মুহুর্মুহুঃ শুণ্ডাস্ফালন, মুহুর্মুহুঃ বিপুল কর্ণতাড়ন, এবং বিশাল বঙ্কিম দন্তদ্বয়ের অমল-শ্বেত স্থির শোভা দেখিয়া দর্শকেরা সভয়ে পশ্চাদ্গত হইয়া দাঁড়াইলেন। পশ্চাদপসারী দর্শকদিগের বস্ত্র মর্ম্মরে, ভয়সূচক বাক্যে, এবং পদধ্বনিতে কিয়ৎক্ষণ রঙ্গাঙ্গন মধ্যে অস্ফুট কলরব হইতে লাগিল। অল্পক্ষণ মধ্যে সে কলরব নিবৃত্ত হইল। কৌতূহলের আতিশয্যে সেই জনাকীর্ণ স্থল একেবারে শব্দহীন হইল। সকলে রুদ্ধনিশ্বাসে বখ্তিয়ার খিলিজির রঙ্গপ্রবেশের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। তখন বখ্‌তিয়ার খিলিজিও রঙ্গমধ্যে প্রবেশ করিয়া গজরাজের সম্মুখীন হইয়া দেখা দিলেন। যাহারা পূর্ব্বে তাঁহাকে চিনিত না, তাহারা তাঁহাকে দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইল, অপিচ বিরক্ত হইল। তাঁহার শরীরে বীরলক্ষণ কিছুই ছিল না। তাঁহার দেহের আয়তন অতি ক্ষুদ্র, গঠন অতি কদর্য্য। শরীরের সকল স্থানই দোষবিশিষ্ট। তাঁহার বাহুযুগল বিশেষ কুরূপশালিত্বের কারণ হইয়াছিল। “আজানুলম্বিত বাহু” সুলক্ষণ হইলে হইতে পারে, কিন্তু দেখিতে কদর্য্য সন্দেহ নাই। বখ্‌তিয়ারের বাহুযুগল জানুর অধোভাগ পর্য্যন্ত লম্বিত সুতরাং আরণ্যনরের সহিত তাঁহার দৃশ্যগত সাদৃশ্য লক্ষিত হইত। তাঁহাকে দেখিয়া একজন মুসলমান আর একজনকে কহিল, “ইনিই বেহার জয় করিয়াছেন? এই শরীরে এত বল?”

 একজন অস্ত্রধারী হিন্দুযুবা নিকটে দাঁড়াইয়াছিল। সে কহিল,

 “পবননন্দন হনু কলিকালে মর্কট রূপ ধারণ করিয়াছেন।”

 যবন কহিল, “তুই কি বলিস রে কাফের?”

 হিন্দু পুনরপি কহিল, “পবননন্দন কলিতে মর্কট রূপ ধারণ করিয়াছেন।”

 যবন কহিল, “আমি তোর কথা বুঝিতে পারিতেছি না, তুই তীর ধনু লইয়া এখানে আসিয়াছিস কেন?”

 হিন্দু কহিল, “আমি বাল্যকালে তীর ধনু লইয়া খেলা করিতাম। সেই অবধি অভ্যাস দোষে তীর ধনু আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে।”

 যবন কহিল, “হিন্দুদিগের সে অভ্যাস দোষ ক্রমে ঘুচিতেছে। এ খেলায় আর এখন কাফেরের সুখ নাই। সুভান এল্লা! একি?”

 এই বলিয়া যবন রঙ্গভূমি প্রতি অনিমেষ লোচনে চাহিয়া রহিল। বখ্‌তিয়ার নিজ দীর্ঘভুজে এক শাণিত কুঠার ধারণ করিয়া বারণরাজের সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিলেন। কিন্তু বারণ তাঁহাকে লক্ষ্য না করিয়া, ইতস্ততঃ সমযোগ্য প্রতিযোগীর অন্বেষণ করিতে লাগিল। ক্ষুদ্রকায় একজন মনুষ্য যে তাহার রণাকাঙ্ক্ষী হইয়া দাঁড়াইয়াছে ইহা তাহার হস্তিবুদ্ধিতে উপজিল না। বখ্‌তিয়ার মাহুতকে অনুজ্ঞা করিলেন, যে হস্তীকে তাড়াইয়া আমার উপর দাও। মাহুত গজশরীরে চরণাঙ্গুলি সঞ্চালন দ্বারা সঙ্কেত করিয়া বখ্‌তিয়ারকে দেখাইয়া দিল। তখন হস্তী ঊর্দ্ধশুণ্ডে বখ্‌তিয়ারকে আক্রমণ করিল। বখ্‌তিয়ার নিমেষ মধ্যে করিশুণ্ডপ্রক্ষেপ হইতে ব্যবহিত হইয়া শুণ্ডোপরে তীব্র কুঠারাঘাত করিল। যূথপতি ব্যথায় ভীষণ চীৎকার করিয়া উঠিল। এবং ক্রোধে পতনশীল পর্ব্বতবৎ বেগে প্রহারকারীর প্রতি ধাবমান হইল; কুঠারাঘাতে সে বেগ রোধের কোন সম্ভাবনা রহিল না। দ্রষ্টৃবর্গ সকলে দেখিল, যে পলকমধ্যে বখ্‌তিয়ার কর্দ্দম পিণ্ডবৎ দলিত হইবেন। সকলে বাহূত্তোলন করিয়া “পলাও পলাও” শব্দ করিতে লাগিল। কিন্তু বখ্‌তিয়ার মগধ জয় করিয়া আসিয়া রঙ্গভূমে পলায়নতৎপর হইবেন কি প্রকারে? তিনি, তদপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়ঃ বিবেচনা করিয়া হস্তি-পদতলে প্রাণত্যাগ মনে মনে স্বীকার করিলেন।

 করিরাজ আত্মবেগভরে তাঁহার পৃষ্ঠের উপরে আসিয়া পড়িয়াছিল; একেবারে বখ্‌তিয়ারকে দলিত করিবার মানসে, নিজ বিশাল চরণ উত্তোলন করিল কিন্তু তাহা বখ্‌তিয়ারের স্কন্ধে স্থাপিত হইতে না হইতেই ক্ষয়িতমূল অট্টালিকার ন্যায়, সশব্দে রজ-উৎকীর্ণ করিয়া অকস্মাৎ যূথপতি ভূতলে পড়িয়া গেল। অমনি তাহার মৃত্যু হইল।

 যাহারা সবিশেষ দেখিতে না পাইল, তাহারা বিবেচনা করিল যে বখ্‌তিয়ার খিলিজি কোন কৌশলে হস্তির বধসাধন করিয়াছেন। তৎক্ষণাৎ মুসলমান মণ্ডল মধ্যে ঘোরতর জয়ধ্বনি হইতে লাগিল। কিন্তু অন্যে দেখিতে পাইল যে হস্তীর গ্রীবার উপর একটী তীর বিদ্ধ রহিয়াছে। কুতবউদ্দীন বিস্মিত হইয়া সবিশেষ জানিবার জন্য মৃতগজের নিকট আসিলেন, এবং স্বীয় অস্ত্রবিদ্যার প্রভাবে বুঝিতে পারিলেন যে এই শরবেধই হস্তীর মৃত্যুর একমাত্র কারণ। বুঝিলেন যে শর, অসাধারণ বাহুবলে নিক্ষিপ্ত হইয়া স্থূল হস্তিচর্ম্মে, তৎপরে হস্তিগ্রীবার বিপুল মাংসরাশি ভেদ করিয়া মস্তিষ্ক বিদ্ধ করিয়াছে। শরনিক্ষেপকারীর আরও এক অপূর্ব্ব নৈপুণ্যলক্ষণ দেখিলেন। গ্রীবার যে স্থানে মস্তিষ্ক এবং মেরুদও মধ্যস্থ মজ্জার সংযোগ হইয়াছে[১] সেই স্থানেই তীর বিদ্ধ হইয়াছে। তথায় সূচিমাত্র প্রবিষ্ট হইলে জীবের প্রাণ বিনষ্ট হয়—পলকমাত্রও বিলম্ব হয়। এই স্থানে শর বিদ্ধ না হইলে কখনই বখ্‌তিয়ারের রক্ষা সিদ্ধ হইত না। কুতবউদ্দীন, আরও দেখিলেন তীরের গঠন সাধারণ হইতে ভিন্ন। তাহার ফলক অতি দীর্ঘ, সূক্ষ্ম, এবং একটী বিশেষ চিহ্নে অঙ্কিত। তিনি সিদ্ধান্ত করিলেন, যে, যে ব্যক্তি এই শর ত্যাগ করিয়াছিল, সে অসাধরণ বাহুবলশালী; তাহার শিক্ষা বিচিত্র, এবং হস্ত অতি লঘুগতি।

 কুতবউদ্দীন গজঘাতী প্রহরণ হস্তে গ্রহণ করিয়া দর্শকমণ্ডলীকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন যে “এ তীর কে ত্যাগ করিয়াছিল?”

 কেহ উত্তর দিল না। কুতুবউদ্দীন পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন “এ তীর কে ত্যাগ করিয়াছিল?”

 যে যবন জনেক হিন্দুশস্ত্রধারীকে তাড়না করিয়াছিল, সে এইবার কহিল, “জাঁহাপনা! এক জন কাফের এই স্থানেই দাঁড়াইয়া তীর মারিয়াছিল দেখিয়াছি, কিন্তু তাহাকে আর দেখিতেছি না।”

 কুতব-উদ্দীন ভ্রূকুটী করিয়া কিয়ৎক্ষণ বিমনা হইয়া রহিলেন। পরে কহিলেন, “বখ্‌তিয়ার খিলিজি মত্তহস্তী যুদ্ধে বধ করিয়াছেন, তোমরা তাঁহার প্রশংসা কর। কোন কাফের তাঁহার গৌরবের লাঘব জন্মাইবার অভিলাষে, অথবা তাঁহার প্রাণসংহার জন্য এই তীর ক্ষেপ করিয়া থাকিবে। আমি তাহার সন্ধান করিয়া সমুচিত দণ্ডবিধান করিব। তোমরা সকলে গৃহে গিয়া আজিকার দিন আনন্দে যাপন করিও।”

 ইহা শুনিয়া দর্শকগণ ধন্যবাদ পূর্ব্বক স্ব স্ব স্থানে গমন করিতে উদ্‌যুক্ত হইল। ইত্যবসরে কুতবউদ্দীন একজন পারিষদকে হস্তস্থিত তীর প্রদান করিয়া তাহার কর্ণে কর্ণে উপদেশ দিলেন; “যাহার নিকট এইরূপ তীর দেখিবে তাহাকে আমার নিকট লইয়া আসিবে। অনেকে সন্ধান কর।”


  1. Medulla Oblongata. পাঠক মহাশয় “ব্রাইড্ অব্ লেমরমূরে” এইরূপ একটী বৃত্তান্ত মনে পড়িতে পারে।