মৃণালিনী (১৮৭৪)/দ্বিতীয় খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


পশুপতি।

 বঙ্গদেশে ধর্ম্মাধিকার পশুপতি অতি অসাধারণ ব্যক্তি তিনি দ্বিতীয় বঙ্গেশ্বর। রাজা বৃদ্ধ, বার্দ্ধক্যের ধর্ম্মানুসারে পরমতাবলম্বী এবং রাজকার্য্যে অযত্নবান্ হইয়াছিলেন, সুতরাং প্রধানামাত্য ধর্ম্মাধিকারের হস্তেই বঙ্গরাজ্যের প্রকৃত ভার অর্পিত হইয়াছিল। এবং সম্পদে অথবা ঐশ্বর্য্যে পশুপতি বঙ্গেশ্বরের সমকক্ষ ব্যক্তি হইয়া উঠিয়াছিলেন।

 পশুপতির বয়ঃক্রম পঞ্চত্রিংশৎ বৎসর হইবে। তিনি দেখিতে অতি সুপুরুষ। তাঁহার শরীর দীর্ঘ, বক্ষ বিশাল; সর্বাঙ্গ অস্থিমাংসের উপযুক্ত সংযোগে সুঠাম। তাঁহার বর্ণ তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ; ললাট অতি বিস্তৃত, মানসিক শক্তির মন্দির স্বরূপ। নাসিকা দীর্ঘ এবং উন্নত, চক্ষু ক্ষুদ্র কিন্তু অসাধারণ ঔজ্জ্বল্য-সম্পন্ন। মুখকান্তি জ্ঞান-গাম্ভীর্য্য-ব্যঞ্জক এবং অনুদিন বিষয়ানুষ্ঠানজনিত চিন্তার গুণে কিছু পরুষভাবপ্রকাশক। তাহা হইলে কি হয়, রাজসভাতলে তাঁহার ন্যায় সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ আর কেহই ছিল না। লোকে বলিত, বঙ্গদেশে তাদৃশ পণ্ডিত এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিও কেহ ছিল না।

 পশুপতি জাতিতে ব্রাহ্মণ কিন্তু তাঁহার জন্মভূমি কোথা তাহা কেহ বিশেষ জ্ঞাত ছিল না। কথিত ছিল যে তাঁহার পিতা শাস্ত্রব্যবসায়ী দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন।

 পশুপতি কেবল আপন বুদ্ধিবিদ্যার প্রভাবে গৌড় রাজ্যের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন।

 পশুপতি যৌবনকালে কাশীধামে পিতার নিকট থাকিয়া শাস্ত্রাধ্যয়ন করিতেন, তথায় কেশব নামে এক বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। হৈমবতী নামে কেশবের এক অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা ছিল। তাহার সহিত পশুপতির পরিণয় হয়। কিন্তু অদৃষ্ট বশতঃ বিবাহের রাত্রেই কেশব, সম্প্রদানের পর কন্যা লইয়া অদৃশ্য হইল। আর তাহার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। সেই পর্য্যন্ত পশুপতি পত্নীসহবাসে বঞ্চিত ছিলেন। কারণবশতঃ একাল পর্যন্ত দ্বিতীয় দ্বারপরিগ্রহ করেন নাই। তিনি এক্ষণে রাজপ্রাসাদ তুল্য উচ্চ অট্টালিকায় বাস করিতেন, কিন্তু বামানয়ন-নিঃসৃত জ্যোতিরভাবে সেই উচ্চ অট্টালিকা আজি অন্ধকারময়।

 আজি রাত্রে সেই উচ্চ অট্টালিকায় এক নিভৃত কক্ষে, পশুপতি একাকী দীপালোকে বসিয়া আছেন। এই কক্ষের পশ্চাতেই আম্রকানন। আম্রকাননে নিষ্ক্রান্ত হইবার জন্য একটি গুপ্তদ্বার আছে। সেই দ্বারে আসিয়া নিশীথকালে, মৃদু মৃদু কে আঘাত করিল। গৃহাভ্যন্তর হইতে পশুপতি দ্বার উদঘাটিত করিলেন। এক ব্যক্তি গৃহে প্রবেশ করিল। সে যবন জাতীয়। হেমচন্দ্র তাহাকেই বাতায়ন পথে দেখিয়াছিলেন। পশুপতি, তখন তাহাকে পৃথগাসনে উপবেশন করিতে বলিয়া বিশ্বাস জনক অভিজ্ঞান দেখিতে চাহিলেন। যবন অভিজ্ঞান দৃষ্ট করাইলেন।

 পশুপতি সংস্কৃতে কহিলেন। “বুঝিলাম আপনি যবন সেনাপতির বিশ্বাসপত্র। সুতরাং আমারও বিশ্বাসপাত্র। আপনারই নাম মহম্মদ আলি? এক্ষণে সেনাপতির অভিপ্রায় কি প্রকাশ করুন।”

 যবন সংস্কৃতে উত্তর দিল। কিন্তু তাঁহার সংস্কৃতের তিনভাগ ফারসী, আর অবশিষ্ট চতুর্থ ভাগ যেরূপ সংস্কৃত তাহা ভারতবর্ষে কখন ব্যবহৃত হয় নাই। তাহা মহম্মদআলিরই সৃষ্ট সংস্কৃত। পশুপতি বহুকষ্টে তাহার অর্থ বোধ করিলেন। পাঠক মহাশয়ের সে কষ্টভোগের প্রয়োজন নাই, আমরা তাঁহার সুবোধার্থ সে নূতন সংস্কৃতের অনুবাদ করিয়া দিতেছি।

 যবন কহিল, “খিলিজি সাহেবের অভিপ্রায় আপনি অবগত আছেন। বিনা যুদ্ধে, বঙ্গবিজয় করিবেন তাঁহার ইচ্ছা হইয়াছে। কি হইলে আপনি এ রাজ্য তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিবেন?”

 পশুপতি কহিলেন, “আমি এ রাজ্য তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিব কি না তাহা অনিশ্চিত। স্বদেশবৈরিতা মহাপাপ। আমি এ কর্ম্ম কেন করিব?”

 য। “উত্তম। আমি চলিলাম। কিন্তু আপনি তবে কেন খিলিজির নিকট দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন?”

 প। “তাঁহার যুদ্ধের সাধ কতদূর পর্য্যন্ত তাহা জানিবার জন্য।”

 য। “তাই আমি আপনাকে জানাইয়া যাই। যুদ্ধেই তাঁহার আনন্দ।”

 প। “কি মনুষ্য যুদ্ধে, কি পশুযুদ্ধে? হস্তিযুদ্ধে কেমন আনন্দ?

 মহম্মদ আলি সকোপে কহিলেন “বঙ্গে যুদ্ধাভিপ্রায়ে আসা পশু যুদ্ধেই আসা। বুঝিলাম ব্যঙ্গ করিবার জন্যই আপনি সেনাপতিকে লোক পাঠাইতে বলিয়াছিলেন। আমরা যুদ্ধ জানি, ব্যঙ্গ জানি না। যাহা জানি তাহা করিব।”

 এই বলিয়া মহম্মদ আলি গমনেদ্যোগী হইল। পশুপতি কহিলেন,  “ক্ষণেক অপেক্ষা করুন। আর কিছু শুনিয়া যান। আমি যবন হস্তে এ রাজ্য সমর্পণ করিতে অসম্মত নহি। অক্ষমও নহি। আমিই বঙ্গের রাজা, সেন রাজা নাম মাত্র। কিন্তু সমুচিত মূল্য না পাইলে আপন রাজ্য কেন আপনাদিগকে দিব?”

 মহম্মদ আলি কহিলেন, “আপনি কি চাহেন?”

 প। “খিলিজি কি দিবেন?”

 ম। “আপনার যাহা আছে, তাহা সকলই থাকিবে— আপনার জীবন, ঐশ্বর্য্য, পদ সকলই থাকিবে। এই মাত্র।”

 প। “তবে আমি পাইলাম কি? এ সকলই ত আমার আছে—কি লোভে আমি এ গুরুতর পাপানুষ্ঠান করিব?”

 ম। “আমাদের আনুকূল্য না করিলে কিছুই থাকিবেক না; যুদ্ধ করিলে, আপনার ঐশ্বর্য, পদ, জীবন পর্যন্ত অপহৃত হইবে।”

 প। “তাহা যুদ্ধ শেষ না হইলে বলা যায় না। আমরা যুদ্ধ করিতে একেবারে অনিচ্ছুক বিবেচনা করিবেন না। বিশেষ মগধে বিদ্রোহের উদ্যোগ হইতেছে তাহাও অবগত আছি। তন্নিবারণজন্য এক্ষণে খিলিজি ব্যস্ত, বঙ্গজয় চেষ্টা আপাততঃ কিছু দিন তাঁহাকে ত্যাগ করিতে হইবে তাহাও অবগত আছি। আমার প্রার্থিত পুরস্কার না দেন, না দিবেন, কিন্তু যুদ্ধ করাই যদি স্থির হয়, তবে আমাদিগের এই উত্তম সময়। যখন বেহারে বিদ্রোহিসেনা সজ্জিত হইবে, গৌড়েশ্বরের সেনাও তথায় গিয়া তাহাদিগের সহায়তা করিবে।”

 ম। “ক্ষতি কি? পিপীলিকা দংশনের উপর মক্ষিকা দংশন করিলে হস্তী মরে না। কিন্তু আপনার প্রার্থিত পুরস্কার কি, তাহা শুনিয়া যাইতে বাসনা করি।”

 প। “শ্রবণ করুন। আমি এক্ষণে প্রকৃত বঙ্গের ঈশ্বর, কিন্তু লোকে আমাকে বঙ্গেশ্বর বলে না। আমি স্বনামে রাজা হইতে বাসনা করি। সেন বংশ লোপ হইয়া পশুপতি বঙ্গাধিপতি হউক।”

 ম। “তাহাতে আমাদিগের কি উপকার করিলেন? আমাদিগকে কি দিবেন?”

 প। “রাজকর মাত্র। মুসলমানের অধীনে করপ্রদ মাত্র রাজা হইব।”

 ম। “ভাল; আপনি যদি প্রকৃত বঙ্গেশ্বর, রাজ্য যদি আপনার এরূপ করতলস্থ, তবে আমাদিগের সহিত আপনার কথা বার্ত্তার আবশ্যক কি? আমাদিগের সাহায্যের প্রয়োজন কি? আমাদিগকে কর দিবেন কেন?”

 প। “তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিব। ইহাতে কপটতা করিব না। প্রথমতঃ সেনরাজা আমার প্রভু; বয়সে বৃদ্ধ, আমাকে স্নেহ করেন। স্ববলে যদি আমি তাঁহাকে রাজ্যচ্যুত করি—তবে অত্যন্ত লোকনিন্দা। আপনারা কিঞ্চিন্মাত্র যুদ্ধোদ্যম দেখাইয়া, আমার আনুকূল্যে বিনা যুদ্ধে রাজধানী প্রবেশ পূর্ব্বক তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া আমাকে তদুপরি স্থাপিত করিলে সে নিন্দা হইবে না। দ্বিতীয়তঃ রাজ্য অনধিকারীর অধিকারগত হইলেই বিদ্রোহের সম্ভাবনা, আপনাদিগের সাহায্যে সে বিদ্রোহ সহজেই নিবারণ করিতে পারিব। তৃতীয়তঃ আমি স্বয়ং রাজা হইলে এক্ষণে সেন রাজার সহিত আপনাদিগের যে সম্বন্ধ, আমার সঙ্গেও সেই সম্বন্ধ থাকিবে। আপনাদিগের সহিত যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকিবে। যুদ্ধে আমি প্রস্তুত আছি—কিন্তু জয় পরাজয় দুইয়ের সম্ভাবনা। জয় হইলে আমার নূতন লাভ কিছুই হইবে না কিন্তু পরাজয়ে সর্বস্ব হানি। কিন্তু আপনাদিগের সহিত সন্ধি করিয়া রাজ্য গ্রহণ করিলে সে আশঙ্কা থাকিবে না। বিশেষতঃ সর্ব্বদা যুদ্ধোদ্যত থাকিতে হইলে নুতন রাজ সুশাসিত হয় না।”

 ম। “আপনি রাজনীতিজ্ঞের ন্যায় বিবেচনা করিয়াছেন। আপনার কথায় আমার সম্পূর্ণ প্রত্যয় জন্মিল। আমিও এইরূপ স্পষ্ট করিয়া খিলিজি সাহেবের অভিপ্রায় ব্যক্ত করি। তিনি এক্ষণে অনেক চিন্তায় ব্যস্ত আছেন যথার্থ—কিন্তু হিন্দুস্থানে যবনরাজ একেশ্বর হইবেন, অন্য রাজার নাম মাত্র আমরা রাখিব না। কিন্তু আপনাকে বঙ্গে শাসন কর্ত্তা করিব। যেমন দিল্লীতে মহম্মদ ঘোরির প্রতিনিধি কুতুবউদ্দীন, যেমন পূর্ব্বদেশে কুতুবউদ্দীনের প্রতিনিধি বখ‍্তিয়ার খিলিজি, তেমনি বঙ্গে আপনি বখ‍্তিয়ারের প্রতিনিধি হইবেন। আপনি ইহাতে স্বীকৃত আছেন কিনা?”

 পশুপতি কহিলেন, “আমি ইহাতে সম্মত হইলাম।”

 ম। “ভাল; কিন্তু আমার আর এক কথা জিজ্ঞাস্য আছে। আপনি যাহা অঙ্গীকার করিতেছেন তাহা সাধন করিতে আপনার ক্ষমতা কি?”

 প। “আমার অনুমতি ব্যতীত একটী পদাতিও যুদ্ধ করিবে না। রাজকোষ আমার অনুচরের হস্তে। আমার আদেশ ব্যতীত যুদ্ধোদ্যোগে একটী কপর্দ্দকও ব্যয়িত হইবে না। পঞ্চজন অনুচর লইয়া খিলিজিকে রাজপুর প্রবেশ করিতে বলিও; কেহ জিজ্ঞাসা করিবে না ‘কে তোমরা?”

 ম। “আরও এক কথা বাকি আছে। এই দেশে যবনের পরম শত্রু হেমচন্দ্র বাস করিতেছে। অদ্য রাত্রেই তাহার মুণ্ড যবন শিবিরে প্রেরণ করিতে হইবে।”

 প। “আপনারা আসিয়াই তাহা ছেদন করিবেন—আমি শরণাগত-হত্যা-পাপ কেন স্বীকার করিব?”

 ম। “আমাদিগ হইতে হইবে না। যবন সমাগম শুনিবামাত্র সে ব্যক্তি নগর ত্যাগ করিয়া পলাইবে। আজি সে নিশ্চিন্ত আছে। আজি লোক পাঠাইয়া তাহাকে বধ করুন।”

 প। “ভাল, ইহাও স্বীকার করিলাম।”

 ম। “আমরা সন্তুষ্ট হইলাম। আমি আপনার উত্তর লইয়া চলিলাম।”

 প। “যে আজ্ঞা। আর একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে।”

 ম। “কি, আজ্ঞা করুন।”

 প। “আমি ত রাজ্য আপনাদিগের হস্তে দিব। পরে যদি আপনারা আমাকে বহিষ্কৃত করেন।”

 ম। “আমরা আপনার কথায় নির্ভর করিয়া অল্প মাত্র সেনা লইয়া দূত পরিচয়ে পুরপ্রবেশ করিব। তাহাতে যদি আমরা স্বীকার মত কর্ম্ম না করি আপনি সহজেই আমাদিগকে বহিস্কৃত করিয়া দিবেন।”

 প। “আর যদি আপনারা অল্প সেনা লইয়া না আইসেন?”

 ম। “তবে যুদ্ধ করিবেন।” এই বলিয়া মহম্মদ আলি বিদায় হইল।