◄  ৫৩
৫৫  ►

৫৪

 পরদিন আপিসে যাবার আগে খাবার পরে শোবার ঘরে বিশ্রাম করতে এসেই মধুসুদন দেখলে ছবিটি নেই। অন্য দিনের মতো আজ শ্যামা পান নিয়ে মধুসূদনের সেবার জন্যে আগে থাকতে প্রস্তুত ছিল না। সে অনুপস্থিত। তাকে ডেকে পাঠানো হল। বেশ বোঝা গেল একটু কুণ্ঠিতভাবেই সে এল। মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “টেবিলের উপর ছবি ছিল, কী হল।”

 শ্যামা অত্যন্ত বিস্ময়ের ভান করে বললে, “ছবি! কার ছবি?”

 ভানের পরিমাণটা কিছু বেশি হয়ে পড়ল। সাধারণত পুরুষদের বুদ্ধিবৃত্তির পরে মেয়েদের অশ্রদ্ধা আছে বলেই এতটা সম্ভব হয়েছিল।

 মধুসূদন ক্রুদ্ধস্বরে বললে, “ছবিটা দেখ নি।”

 শ্যামা নিতান্ত ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললে, “না, দেখি নি তো।”

 মধুসূদন গর্জন করে বলে উঠল, “মিথ্যে কথা বলছ।”

 “মিথ্যে কথা কেন বলব, ছবি নিয়ে আমি করব কী।”

 “কোথায় রেখেছ বের করে নিয়ে এস বলছি! নইলে ভালাে হবে না।”

 “ওমা! কী আপদ! তােমার ছবি আমি কোথায় পাব যে বের করে আনব।”

 বেহারাকে ডাক পড়ল। মধু তাকে বললে, “মেজোবাবুকে ডেকে আন্।”

 নবীন এল। মধুসূদন বললে, “বড়ােবউকে আনিয়ে নাও।”

 শ্যামা মুখ বাঁকিয়ে কাঠের পুতুলের মতাে চুপ করে বসে রইল।

 নবীন খানিকক্ষণ পরে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, “দাদা, ওখানে একবার কি তােমার নিজে যাওয়া উচিত হবে না? তুমি আপনি গিয়ে যদি বল তা হলে বউরানী খুশি হবেন।”

 মধুসূদন গম্ভীরভাবে খানিকক্ষণ গুড়্‌গুড়ি টেনে বললে, “আচ্ছা, কাল রবিবার আছে, কাল যাব।”

 নবীন মােতির মার কাছে এসে বললে, “একটা কাজ করে ফেলেছি।”

 "আমার পরামর্শ না নিয়েই।”

 “পরামর্শ নেবার সময় ছিল না।”

 “তাহলে তাে দেখছি তােমাকে পস্তাতে হবে।”

 “অসম্ভব নয়। কুষ্টিতে আমার বুদ্ধিস্থানে আর কোনাে গ্রহ নেই, আছেন নিজের স্ত্রী। এইজন্য সর্বদা তােমাকে হাতের কাছে রেখেই চলি। ব্যাপারটা হচ্ছে এই—দাদা আজ হুকুম করলেন বউরানীকে আনানাে চাই। আমি ফস করে বলে বসলেম, তুমি নিজে গিয়ে যদি কথাটা তোল ভালাে হয়। দাদা কী মেজাজে ছিলেন রাজি হয়ে গেলেন। তার পর থেকেই ভাবছি এর ফলটা কী হবে।”

 “ভালো হবে না। বিপ্রদাসবাবুর যে-রকম ভাবখানা দেখলুম কী বলতে কী বলবেন, শেষকালে কুরুক্ষেত্রের লড়াই বেধে যাবে। এমন কাজ করলে কেন?”

 “প্রথম কারণ, বুদ্ধির কোঠা ঠিক সেই সময়টাতেই শূন্য ছিল, তুমি ছিলে অন্যত্র। দ্বিতীয় হচ্ছে, সেদিন বউরানী যখন বললেন, আমি যাব না, তার ভিতরকার মানেটা বুঝেছিলুম। তাঁর দাদা রুগ্ন শরীর নিয়ে কলকাতায় এলেন, তবু এক দিনের জন্যে মহারাজ দেখতে গেলেন না—এই অনাদরটা তাঁর মনে সব চেয়ে বেজেছিল।”

 শুনেই মোতির মা একটু চমকে উঠল, কথাটা কেন যে আগে তার মনে পড়ে নি এইটেই তার আশ্চর্য লাগল। আসলে নিজের অগোচরেও শ্বশুরবাড়ির মাহাত্ম্য নিয়ে ওর একটা অহংকার আছে। অন্য সাধারণ লোকের মতো মহারাজ মধুসূদনেরও কুটুম্বিতার দায়িত্ব আছে এ-কথা তার মন বলে না।

 সেদিনকার তর্কের অনুবৃত্তিস্বরূপে নবীন একটুখানি টিপ্পনী দিয়ে বললে, “নিজের বুদ্ধিতে কথাটা আমার হয়তো মনে আসত না, তুমিই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলে।”

 “কী রকম শুনি?”

 “ওই-যে সেদিন বললে, কুটুম্বিতার দায়িত্ব আত্মমর্যাদার দায়িত্বের চেয়েও বড়। তাই মনে করতে সাহস হল যে মহারাজার মতো অতবড় লোকের ও বিপ্রদাসবাবুকে দেখতে যাওয়া উচিত।”

 মোতির মা হার মানতে রাজি নয়, কথাটাকে উড়িয়ে দিলে, “কাজের সময় এত বাজে কথাও বলতে পার! কী করা উচিত এখন সেই কথাটা ভাবো দেখি।”

 “গোড়াতেই সকল কথার শেষ পর্যন্ত ভাবতে গেলে ঠকতে হয়। আশু ভাবা উচিত প্রথম কর্তব্যটা কী। সেটা হচ্ছে বিপ্রদাসবাবুকে দাদার দেখতে যাওয়া। দেখতে গিয়ে তার ফলে যা হতে পারে তার উপায় এখনই চিন্তা করতে বসলে তাতে চিন্তাশীলতার পরিচয় দেওয়া হবে, কিন্তু সেটা হবে অতিচিন্তাশীলতা।”

 “কী জানি আমার বোধ হচ্ছে মুশকিল বাধবে।”