সুবোধের চিঠি বিলেত থেকে আসত নিয়মমতো। এখন মাঝে মাঝে ফাঁক পড়ে। কুমু ডাকের জন্যে ব্যর্থ হয়ে চেয়ে থাকে। বেহারা এবার চিঠি তারই হাতে দিল। বিপ্রদাস আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছে, কুমু ছুটে গিয়ে বললে, “দাদা, ছোড়দাদার চিঠি।”

 দাড়ি-কামানো সেরে কেদারায় বসে বিপ্রদাস একটু যেন ভয়ে ভয়েই চিঠি খুললে। পড়া হয়ে গেলে চিঠিখানা এমন করে হাতে চাপলে যেন সে একটা তীব্র ব্যথা।

 কুমুদিনী ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “ছোড়দাদার অসুখ করে নি তো?”

 “না, সে ভালােই আছে।”

 “চিঠিতে কী লিখেছেন বলো না দাদা।”

 “পড়াশুনাের কথা।”

 কিছুদিন থেকে বিপ্রদাস কুমুকে সুবােধের চিঠি পড়তে দেয় না। একটু-আধটু পড়ে শােনায়। এবার তাও নয়। চিঠিখানা চেয়ে নিতে কুমুর সাহস হল না, মনটা ছট্‌ফট্‌ করতে লাগল।

 সুবােধ প্রথম-প্রথম হিসেব করেই খরচ চালাত। বাড়ির দুঃখের কথা তখনও মনে তাজা ছিল। এখন সেটা যতই ছায়ার মতাে হয়ে এসেছে, খরচও ততই চলেছে বেড়ে। বলছে, বড়োকম চালে চলতে না পারলে এখানকার সামাজিক উচ্চশিখরের আবহাওয়ায় পৌঁছানাে যায় না। আর তা না গেলে বিলেতে আসাই ব্যর্থ হয়।

 দায়ে পড়ে দুই-একবার বিপ্রদাসকে তার-যােগে অতিরিক্ত টাকা পাঠাতে হয়েছে। এবার দাবি এসেছে হাজার পাউণ্ডের— জরুরি দরকার।

 বিপ্রদাস মাথায় হাত দিয়ে বললে, পাব কোথায়। গায়ের রক্ত জল করে কুমুর বিবাহের জন্যে টাকা জমাচ্ছি, শেষে কি সেই টাকায় টান পড়বে? কী হবে সুবােধের ব্যারিস্টার হয়ে, কুমুর ভবিষ্যৎ ফতুর করে যদি তার দাম দিতে হয়?

 সে-রাত্রে বিপ্রদাস বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। জানে না, কুমুদিনীর চোখেও ঘুম নেই। এক সময়ে যখন বড়াে অসহ্য হল কুমু ছুটে এসে বিপ্রদাসের হাত ধরে বললে, “সত্যি করে বলো দাদা, ছােড়দাদার কী হয়েছে? পায়ে পড়ি, আমার কাছে লুকিয়ােনা।”

 বিপ্রদাস বুঝলে গােপন করতে গেলে কুমুদিনীর আশঙ্কা আরও বেড়ে উঠবে। একটু চুপ করে থেকে বললে, “সুবােধ টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে, অত টাকা দেবার শক্তি আমার নেই।”

 কুমু বিপ্রদাসের হাত ধরে বললে, “দাদা, একটা কথা বলি, রাগ করবে না বলো।”

 “রাগ করবার মতাে কথা হলে রাগ না করে বাঁচব কী করে?”

 “না দাদা, ঠাট্টা নয়, শােনো আমার কথা— মায়ের গয়না তাে আমার জন্যে আছে— তাই নিয়ে—”

 “চুপ, চুপ, তাের গয়নায় কি আমরা হাত দিতে পারি?”

 “আমি তাে পারি।”

 “না, তুইও পারিস নে। থাক সে-সব কথা, এখন ঘুমােতে যা।”

 কলকাতা শহরের সকাল, কাকের ডাক ও স্ক্যাভেঞ্জারের গাড়ির খড়খড়ানিতে রাত পােয়াল। দূরে কখনাে স্টীমারের, কখনাে তেলের কলের বাঁশি বাজে। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে একজন লােক মই কাঁধে জ্বরারি বটিকার বিজ্ঞাপন খাটিয়ে চলেছে; খালি-গাড়ির দুটো গােরু গাড়ােয়ানের দুই হাতের প্রবল তাড়ার উত্তেজনায় গাড়ি নিয়ে দ্রুতবেগে ধাবমান; কল থেকে জল নেবার প্রতিযােগিতায় এক হিন্দুস্থানি মেয়ের সঙ্গে উড়িয়া ব্রাহ্মণের ঠেলাঠেলি বকাবকি জমেছে। বিপ্রদাস বারান্দায় ব’সে; গুড়গুড়ির নলটা হাতে; মেজেতে পড়ে আছে না-পড়া খবরের কাগজ।

 কুমু এসে বললে, “দাদা, ‘না’ ব’লো না।”

 “আমার মতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবি তুই? তাের শাসনে রাতকে দিন, না-কে হাঁ করতে হবে?”

 “না, শােনাে বলি;—আমার গয়না নিয়ে তােমার ভাবনা ঘুচুক।”

 “সাধে তােকে বলি বুড়ী? তাের গয়না নিয়ে আমার ভাবনা ঘুচবে এমন কথা ভাবতে পারলি কোন্ বুদ্ধিতে?”

 “সে জানি নে, কিন্তু তােমার এই ভাবনা আমার সয় না।”

 “ভেবেই ভাবনা শেষ করতে হয় রে, তাকে ফাঁকি দিয়ে থামাতে গেলে বিপরীত ঘটে। একটু ধৈর্য ধর্, একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

 বিপ্রদাস সে-মেলে চিঠিতে লিখলে টাকা পাঠাতে হলে কুমুর পণের সম্বলে হাত দিতে হয়; সে অসম্ভব।

 যথাসময়ে উত্তর এল। সুবােধ লিখেছে, কুমুর পণের টাকা সে চায় না। সম্পত্তিতে তার নিজের অর্ধ অংশ বিক্রি করে যেন টাকা পাঠানাে হয়। সঙ্গে সঙ্গেই পাওআর অফ অ্যাটর্নি পাঠিয়েছে।

 এ-চিঠি বিপ্রদাসের বুকে বাণের মতাে বিঁধল। এতবড়ো নিষ্ঠুর চিঠি সুবােধ লিখল কী করে? তখনই বুড়ো দেওয়ানজিকে ডেকে পাঠালে। জিজ্ঞাসা করলে, “ভূষণ রায়রা করিমহাটি তালুক পত্তনি নিতে চেয়েছিল না? কত পণ দেবে?

 দেওয়ান বললে, “বিশ হাজার পর্যন্ত উঠতে পারে।”

 “ভূষণ রায়কে তলব দিয়ে পাঠাও। কথাবার্তা কইতে চাই।”

 বিপ্রদাস বংশের বড় ছেলে। তার জন্মকালে তার পিতামহ এই তালুক স্বতন্ত্র ভাবে তাকেই দান করেছেন। ভূষণ রায় মস্ত মহাজন, বিশ-পঁচিশ লাখ টাকার তেজারতি। জন্মস্থান করিমহাটিতে। এই জন্যে অনেক দিন থেকে নিজের গ্রাম পত্তনি নেবার চেষ্টা। অর্থসংকটে মাঝে মাঝে বিপ্রদাস রাজি হয় আর কি, কিন্তু প্রজারা কেঁদে পড়ে। বলে, ওকে আমরা কিছুতেই জমিদার বলে মানতে পারব না। তাই প্রস্তাবটা বারে বারে যায় ফেঁসে। এবার বিপ্রদাস মন কঠিন করে বসল। নিশ্চয় জানে সুবােধের টাকার দাবি এইখানেই শেষ হবে না। মনে মনে বললে, আমার তালুকের এই সেলামির টাকা রইল সুবােধের জন্যে, তার পর দেখা যাবে।

 দেওয়ান বিপ্রদাসের মুখের উপর জবাব দিতে সাহস করলে না।

 গােপনে কুমুকে গিয়ে বললে, “দিদি, তােমার কথা বড়োবাবু শােনেন। বারণ করো তাঁকে, এটা অন্যায় হচ্ছে।”

 বিপ্রদাসকে বাড়ির সকলেই ভালােবাসে। কারও জন্যে বড়ােরাবু যে নিজের স্বত্ব নষ্ট করবে এ ওদের গায়ে সয় না।

 বেলা হয়ে যায়। বিপ্রদাস ওই তালুকের কাগজ পত্র নিয়ে ঘাঁটছে। এখনও স্নানাহার হয় নি। কুমু বারে বারে তাকে ডেকে পাঠাচ্ছে। শুকনাে মুখ করে এক সময়ে অন্দরে এল। যেন বাজে-ছোঁয়া পাতা ঝলসানাে গাছের মতাে। কুমুর বুকে শেল বিঁধল।

 স্নানাহার হয়ে গেলে পর বিপ্রদাস আলবােলার নল-হাতে খাটের বিছানায় পা ছড়িয়ে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসল যখন, কুমু তার শিয়রের কাছে বসে ধীরে ধীরে তার চুলের মধ্যে হাত বুলােত বুলােত বললে, “দাদা, তােমার তালুক তুমি পত্তনি দিতে পারবে না।”

 “তােকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূতে পেয়েছে নাকি? সব কথাতেই জুলুম?”

 “না দাদা, কথা চাপা দিও না।”

 তখন বিপ্রদাস আর থাকতে পারলে না, সােজা হয়ে উঠে বসে কুমুকে শিয়রের কাছ থেকে সরিয়ে সামনে বসালে। রুদ্ধ স্বরটাকে পরিষ্কার করবার জন্যে একটুখানি কেশে নিয়ে বললে, “সুবােধ কী লিখেছে জানিস? এই দেখ্।”

 এই বলে জামার পকেট থেকে তার চিঠি বের করে কুমুর হাতে দিলে। কুমু সমস্তটা পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বললে, “মাগাে, ছােড়দাদা এমন চিঠিও লিখতে পারলে?”

 বিপ্রদাস বললে, “ওর নিজের সম্পত্তি আর আমার সম্পত্তিতে ও যখন আজ ভেদ করে দেখতে পেরেছে, তখন আমার তালুক আমি কি আর আলাদা রাখতে পারি? আজ ওর বাপ নেই, বিপদের সময়ে আমি ওকে দেব না তাে কে দেবে?”

 এর উপর কুমু আর কথা কইতে পারলে না, নীরবে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বিপ্রদাস তাকিয়ায় আবার ঠেস দিয়ে চোখ বুজে রইল।

 অনেকক্ষণ দাদার পায়ে হাত বুলিয়ে অবশেষে কুমু বললে, “দাদা, মায়ের ধন তাে এখন মায়েরই আছে, তাঁর সেই গয়না থাকতে তুমি কেন—”

 বিপ্রদাস আবার চমকে উঠে বসে বললে, “কুমু, এটা তুই কিছুতে বুঝলি নে, তাের গয়না নিয়ে সুবােধ আজ যদি বিলেতে থিয়েটার-কনসার্ট দেখে বেড়াতে পারে তাহলে আমি কি তাকে কোনােদিন ক্ষমা করতে পারব,—না, সে কোনােদিন মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে? তাকে এত শাস্তি কেন দিবি?”

 কুমু চুপ করে রইল, কোনাে উপায় সে খুঁজে পেল না। তখন, অনেকবার যেমন ভেবেছে তেমনি করেই ভাবতে লাগল,—অসম্ভব কিছু ঘটে না কি? আকাশের কোনাে গ্রহ, কোনাে নক্ষত্র এক মুহূর্তে সমস্ত বাধা সরিয়ে দিতে পারে না? কিন্তু শুভলক্ষণ দেখা দিয়েছে যে, কিছুদিন থেকে বার বার তার বাঁ চোখ নাচছে। এর পূর্বে জীবনে আরও অনেকবার বাঁ চোখ নেচেছে, তা নিয়ে কিছু ভাববার দরকার হয় নি। এবারে লক্ষণটাকে মনে-মনে ধরে পড়ল। যেন তার প্রতিশ্রুতি তাকে রাখতেই হবে—শুভলক্ষণের সত্যভঙ্গ যেন না হয়।