রথযাত্রা ও অন্যান্য গল্প/বন্দী
বন্দী
চারিদিকে প্রাচীর, প্রাচীরের বাহিরে কিছু দেখিতে পাওয়া যায় না। মাথার উপর একখণ্ড আকাশ, আকাশে কখন পাখী উড়িয়া যায়, কখন মেঘ ভাসিয়া যায়, দিনের বেলা কিছুক্ষণ সূর্য্য দেখা দেয়, রাত্রে কিছু নক্ষত্র, জ্যোৎস্না রাত্রে কিছুক্ষণ চন্দ্র দেখিতে পাওয়া যায়। প্রাচীরবেষ্টিত স্বল্প স্থানের মধ্যে কয়েক শত মনুষ্য—সকলের এক বেশ, মোটা কাপড়ের হাঁটু পর্য্যন্ত পায়জামা, গায়ে সেই কাপড়ের পিরাণ, মাথায় সেই রকম টুপী। মোটা কাপড়, তাহাতে নীল ডোরা। সকলের গলায় একটা টিনের চাক্তি, তাহাতে একটা নম্বর খোদা। এই সকল লোকদের নাম নাই, শুধু নম্বর। যাহার যে নম্বর তাহাকে সেই নম্বর বলিয়া ডাকে।
ইহারা বন্দী, ইহাদের বাসস্থান কারাগার।
কতক লোকের পায়ে শৃঙ্খল, সকলের মাথার চুল ছোট করিয়া কাটা। কারাগারের মধ্যে আর একটা প্রাচীর, এক ভাগে বন্দীরা শয়ন করে, আর এক ভাগে কাজ করে। জাঁতায় আটা পিষিতেছে, ঘানিতে তেল বাহির করিতেছে। কোথাও শতরঞ্জি, গালিচা প্রস্তুত হইতেছে, কোথাও ছুতারের কাজ। পাকশালায় কয়েকজন বন্দী সকলের জন্য পাক করিতেছে, মোটা অপরিষ্কার চাউল, মোটা আটার রুটী, জলের মত ডাল, অর্দ্ধসিদ্ধ একটা তরকারি। সকল স্থানে কয়েদী ওয়ার্ডার, অপর কয়েদীদের কর্ম্ম পর্য্যবেক্ষণ করিতেছে।
প্রত্যূষে, অন্ধকার থাকিতে ঘণ্টা বাজে, বন্দীদিগকে তাড়াতাড়ি উঠিয়া, প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া কাজে যাইতে হয়, দ্বিপ্রহরে আহারের জন্য এক ঘণ্টা অবকাশ, আবার সন্ধ্যা পর্য্যন্ত কাজ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর এই রকম চলিয়াছে, কখন বিরাম নাই, কখন কোন পরিবর্ত্তন নাই।
মাঝে মাঝে যাহা নূতন কিছু হয় তাহাতে বন্দীদের ভয় হয়, আনন্দ হয় না। কখন কোন বন্দী আদেশ পালনে আপত্তি করে অথবা কর্ম্মে অবহেলা করে, শাস্তিস্বরূপ বেত্রাঘাতের আদেশ হয়। একটা কাঠের তিনকোণা ফ্রেমে অপরাধীর জামা খুলিয়া তাহাকে বাঁধে, আর একজন কয়েদী তাহাকে বেত মারে। জেলের অধ্যক্ষ ও ডাক্তার দাঁড়াইয়া থাকে, চারিদিকে কয়েদীরা ঘিরিয়া দাঁড়ায়। প্রথম কয়েক ঘা পড়িতে অপরাধী আর্ত্তনাদ করে, তাহার পর চীৎকার করিবার ক্ষমতা থাকে না, মাথা স্কন্ধে হেলিয়া পড়ে, কাতরোক্তি বন্ধ হইয়া আসে। যখন তাহাকে ছাড়িয়া দেয়, কিছুক্ষণ উঠিতে পারে না, তাহার পর হামাগুড়ি দিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া যায়।
রাত্রে প্রাচীরের উপর ভরা বন্দুক লইয়া, পায়চারি করিয়া প্রহরীরা পাহারা দেয়, মাঝে মাঝে হাঁকে, অল ওয়েল্! চারিদিক হইতে, চারিটা প্রাচীর হইতে সেই সাড়া আসে, অল ওয়েল্! কদাচ কখন, ভারি রাত্রে মহা কোলাহল উত্থিত হয়, দুমদাম বন্দুকের আওয়াজ, চারিদিকে ছুটাছুটি, চারিদিকে চীৎকার, কয়েদী ভাগা! কয়েদী ভাগা! বন্দীরা তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাহিরে আসিয়া কি হইয়াছে জানিতে চায়, অমনি বন্দুকধারী কয়েকজন প্রহরী তাহাদের পথরোধ করে, তাহাদিগকে শয়নকক্ষে প্রবেশ করিতে আদেশ করে। বন্দিগণ মেষের পালের মতন জড়সড় হইয়া কোন্ কয়েদী পলায়ন করিয়াছে তাহাই আলোচনা করে
পলায়ন করিয়া কয়জন কয়েদী রক্ষা পায়? তখনি, না হয় কিছুদিন পরে, আবার ধরা পড়ে, পলায়নের অপরাধে শাস্তি বাড়িয়া যায়! কয়েদীদের নিজের কথা, জেলের ভিতর যেন পোষা পাখী, খাঁচা হইতে উড়িয়া গেলে যেন বাজ তাড়া করে। জেলের মধ্যে শুধু আটক, পলায়ন করিলে পিছন হইতে যেন বাঘ গর্জ্জন করিয়া ছুটিয়া আসে।
এই সকল নাম-হারা, নম্বরমারা বন্দীদের মধ্যে যাহার গলার চাক্তিতে ৩৫১ নম্বর খোদা, সে যেন কি-রকম কি-রকম। তাহার বয়স হইয়াছে, কিন্তু যত বয়স, দেখিতে তাহার অপেক্ষাও বৃদ্ধ। শীর্ণ, ক্ষীণমূর্ত্তি, চক্ষের দৃষ্টি ভয়চকিত, সর্ব্বদাই যেন সঙ্কুচিত, সশঙ্কিত ভাব। মুখে বড়-একটা কথা নাই, কলের মত ঘুরিয়া বেড়ায়, কলের মত কাজ করে। কেহ ডাকিতেই তাড়াতাড়ি আসিয়া মাথা নীচু করিয়া দাঁড়ায়। শ্বাপদকুলের মধ্যে মেষ পড়িলে তাহার যেমন দশা হয়, ইহার যেন সেই অবস্থা। কয়েদীদের অনেকেই দুর্ব্বত্ত, নির্ভীক, জেলের শাসনকে তৃণ জ্ঞান করে, নিজেদের মধ্যে আপন আপন দুষ্কর্ম্মের বড়াই করে, কারামুক্ত হইয়া আবার কি করিবে তাহার জল্পনা করে। তাহাদের মুখে সর্ব্বদাই হাসি, সর্ব্বদাই নিশ্চিন্ততা। ৩৫১ নম্বর যেন তাহাদের দলের কেহ নয়, যথাসাধ্য তাহাদের পাশ কাটায়, আলাদা নিত্য নির্দ্দিষ্ট কাজ করে। কোন কয়েদী তাহাকে কিছু আদেশ করিলে তাহাও করিত।
জেল হইবার পূর্ব্বে তাহার নাম ছিল কালীচরণ। লেখাপড়া জানিত না, গ্রামে কখন মোট বহিয়া, কখন চাষীর কাজ করিয়া কষ্টে দিনপাত করিত। উপার্জ্জনের লোভে সহরে গিয়াছিল। সহরের সব দেখিয়া অবাক হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এমন সময় একজন ভদ্রবেশী লোক তাহাকে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে হে তুমি? এখানে নতুন এসেচ, না?
কালীচরণ নমস্কার করিয়া বলিল,—হাঁ, বাবুমশায়, আমি দেশ থেকে এই সবে এসেচি।
—চাকরী করবে?
—আজ্ঞে, চাকরীর জন্যই এখানে আসা।
—তবে আমার সঙ্গে এস।
কালীচরণ তাহার সঙ্গে গেল। একটা ছোট গলির ভিতর একটি ছোট বাসাবাড়ী, আরও দুই-তিনজন লোক আছে, স্ত্রীলোক কেহ নাই। যে কালীচরণকে ডাকিয়া আনিয়াছিল সে বলিল,—দেখ, আমরা এই চারজন মেসে আছি, বেশী কাজকর্ম্ম নেই, তোমাকে খাওয়া-পরা আর পাঁচ টাকা মাইনে দেব। কি বল?
কালীচরণ যেন হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল। বাড়ীতে মাসে মাসে পাঁচ টাকা পাঠাইতে পারিলে আর ভাবনা কি? ঘরে তাহার স্ত্রী আর একটি ছোট মেয়ে। স্ত্রী হাটের দিন লাউ, কুমড়া, পটল বেচিয়া কিছু পায়। ঘরে চরকায় সূতা কাটিয়া তাঁতিকে বিক্রয় করে, কুঁড়েঘরের পাশে ফালির মতন এতটুকু জমি—তাহাতে ঝিঙ্গে, ধুঁতুল, লাউ, কুমড়া, লঙ্কা আজ্জায়; চাষীদের ধান কাটা হইলে ধানের বোঝা বহন করিয়া কিছু ধান পায়, ঢেঁশকেলে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া কিছু চাল পায়, ডাল ভাঙিয়া মাসকলাইয়ের খোসা খুদ পায়। আহ্লাদে আটখানা হইয়া কালীচরণ বলিল,—যে-আজ্ঞে, ঐ মাইনেই আমার কবুল।
কালীচরণের চাকরী হইল। মনিবেরা তাহাকে এক জোড়া কাপড় আর একখানা গামছা কিনিয়া দিল। সে বাড়ীর কাজকর্ম্ম করে, বাজার-হাট করে, ফাই-ফরমাস খাটে। সকাল বেলা বাজার করিবার সময় মেসের একজন বাবু তাহার সঙ্গে যায়, বাজারে ঢুকিতেই তাহার হাতে একখানা দশ টাকার নোট দিয়া বলে,—আলুর দোকানে এই নোট খানা ভাঙিয়ে তুমি বাজার কর ত, আমি একটা কাজ সেরে আসি। কালীচরণ নোট ভাঙাইয়া বাজার করে কিন্তু বাবুর আর দেখা নাই। বাজার করিয়া কালীচরণ বাড়ী ফিরিয়া যাইত। বাজারের পয়সা হইতে চুরী করা তাহাকে দিয়া হইত না, তার একটা পাড়াগেঁয়ে কুসংস্কার ছিল যে, মাথার উপর ধর্ম্ম আছেন, অধর্ম্মের পয়সা ভোগে আসে না।
বাবুরা রোজ এক বাজারে যাইত না, কালীচরণকে সাত বাজার ঘুরিতে হইত, আর প্রতিদিন তাহাকে একখানা নূতন খসখসে নোট ভাঙাইতে হইত। খুচরা টাকা চাহিলে বাবুরা বলিত, তাহাদের নিজের অন্য খরচ আছে, দশ টাকার কমে হয় না। বাবুরা পালা করিয়া কালীচরণের সঙ্গে যাইত, এক বাজার ছাড়িয়া অন্য বাজারে ঘুরিত কিন্তু নোট ভাঙাইবার বেলা কালীচরণ একা, কোন বাবুর টিকিটি পর্য্যন্ত দেখা যাইত না।
কালীচরণের ক্রমে উন্নতি হইতে লাগিল। শুধু গায় নিতান্ত অসভ্য দেখায় বলিয়া বাবুরা তাহাকে পিরাণ কিনিয়া দিল, পায়ের জন্য পুরাতন জুতা দিল। সেই সঙ্গে বাজারের মাত্রাও বাড়িতে লাগিল। কোন দিন এক বাবু তাহার হাতে চারিখানা নোট গুঁজিয়া দিয়া, কাপড়ের দোকান দেখাইয়া দিয়া বলিত, ‘কালীচরণ, দশ টাকা জোড়া দু-জোড়া লালপেড়ে আর দু-জোড়া কালা পেড়ে দেশী ধুতি কিনে তুমি এই সামনের মোড়ে গিয়ে দাঁড়াও, আমি এই এলাম বলে।’
কালীচরণ কাপড় কিনিয়া মোড়ে আসিয়া দেখে বাবুর কোন চিহ্ন নাই। সে ধুতি কয়জোড়া বগল দাবা করিয়া বাসায় ফিরিয়া আসে।
একদিন একটা দোকানে কালীচরণ বাবুর হুকুম-মত কতকগুলা জিনিষ খরিদ করিয়া পাঁচখানা নোট বাহির করিয়া দিল। বাবু তাহাকে বলিয়াছিল, একজনের সঙ্গে দেখা করে’ আমি এখনি আসচি।
দোকানদার নোট পাঁচখানা হাতে করিয়া কালীচরণের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, ‘দোকানে রেজকি নেই, আমি একখানা নোট ভাঙিয়ে আনি।
দোকানের পিছনে এক পোদ্দারের দোকান। দোকানদার পোদ্দারকে বলিল,—এ গুলো একবার দেখ দেখি, আমার যেন কিরকম, কি-রকম ঠেক্চে।
পোদ্দার নোটগুলা হাতে করিয়া, উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া ঠাহর করিয়া দেখিল। বলিল,—এ জাল। বাজারে কিছুদিন থেকে জাল নোট চল্চে, শোন নি?
—শুনেচি বই কি। তাই ত আমার সন্দ হ’ল।
দোকানদার দোকানে ফিরিল না। মোড়ে গিয়া পাহারাওয়ালাকে ডাকিয়া আনিল। কালীচরণের বাবু মোড়ের কাছে দাঁড়াইয়া সিগারেট টানিতেছিল। দোকানদার পাহারাওয়ালাকে সঙ্গে করিয়া দোকানে লইয়া যাইতেছে দেখিয়া বাবু একটা ট্যাক্সি ডাকিয়া ভোঁ করিয়া চলিয়া গেল।
কালীচরণ দোকানে নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আছে। দোকানদারের সঙ্গে পাহারাওয়ালাকে দেখিয়া সে কিছুই বুঝিতে পারিল না। পাহারাওয়ালা নোট কয়খানা দেখাইয়া কালীচরণকে জিজ্ঞাসা করিল,—এ নোট তুমি কোথায় পাইলে?
কালীচরণ বিস্মিত হইয়া কহিল,—আমি নোট কোথায় পাইব? এ নোট বাবুর।
—বাবু কোথায়?
— বাবু একজনের সঙ্গে দেখা করে’ হয়ত ফিরে আসচে। মোড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
পাহারাওয়ালা, দোকানদার, কালীচরণ বাহিরে আসিয়া চারিদিকে অনেক খুঁজিল, বাবুর কোথাও দেখা পাওয়া গেল না। পাহারাওয়ালা কালীচরণকে গলাধাক্কা দিয়া, গালি দিয়া থানায় লইয়া গেল। দোকানদার থানায় গিয়া লিখাইল, কালীচরণ দোকানে একা আসিয়াছিল, তাহার সঙ্গে কোন বাবু ছিল না।
পুলিশের লোক কালীচরণকে সঙ্গে করিয়া যখন বাবুদের বাসায় গেল, তখন বাসা খালি, পাখী উড়িয়া গিয়াছে। ঘরগুলায় চারিদিকে তচনচ্ হইয়া আছে, যাহারা ছিল তাহাদের বড় তাড়া, বর্গীর ভয়ে যেমন ঘর-দুয়ার ছাড়িয়া লোকে পলায়ন করিত সেই রকম পলায়ন করিয়াছে।
দেখিয়া শুনিয়া ইন্সপেক্টর বলিল,—এর সঙ্গে আরও লোক আছে, তারা সব ফেরার।
অনুসন্ধানে কালীচরণের যথার্থ পরিচয় পাইতে বিলম্ব হইল না। সে যেমন জানিত তাহাই বলিল,—কিন্তু সে কতটুকু? সাক্ষীর বেলা বিশ পঁচিশ জন দোকানদার, মুদী, পসারী তাহাকে সনাক্ত করিল। সকলেই এক বাক্যে বলিল,—এ ব্যক্তি নোট ছাড়া কখন টাকা আনিত না, সব নতুন নোট, আর পরে জানা গেল সব জাল।
ইন্সপেক্টর কালীচরণকে জুতার ঠোক্কর মারিয়া বলিল,—শালা, ঝানু, বোকা সেজেচ।
দায়রার বিচারে কালীচরণের সাত বৎসর মেয়াদ হইল।
সেই যে পুলিশ কালীচরণকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল সেই হইতে সে যেন কি রকম হইয়া গেল। থানায়, আদালতে, জেলে হাবা কালা জন্তুর মত হইয়া থাকিত, মুখে বড় একটা কথা নাই, চক্ষে শূন্যদৃষ্টি, কলের মত চলা-ফেরা করে, কলের মত খাটে। কাজে সে চটপটে কোনকালেই ছিল না, এখন যেন আরও অকর্ম্মণ্য হইয়া পড়িল। অন্য কয়েদী যে কাজ দু-ঘণ্টায় করে সে কাজ তাহার করিতে চার ঘণ্টা লাগে। দুই একবার জেলার তাহাকে শাস্তি দিল, কিন্তু বেত মারিতে ডাক্তার নিষেধ করিল, কারণ দেশের ম্যালেরিয়ায় তাহার শরীর খারাপ হইয়া গিয়াছিল। জেলার লক্ষ্য করিয়া দেখিল, ৩৫১ নম্বর কয়েদী কাজে ফাঁকি দেয় না, অলসও নয়, কিছু নিড়বিড়ে, কাজ করিতে সময় অধিক লাগে।
কাজ না থাকিলে কালীচরণ চারিদিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিত। চারিদিকে সেই চারিটা প্রাচীর, মাথার উপর সেই খানিকটা আকাশ। শব্দের মধ্যে কয়েদীদের পায়ের বেড়ীর শব্দ, জাঁতার ঘরঘরাণি, ওয়ার্ডারের ধমক, কয়েদীদের হাসি আর গল্প। এই প্রাচীর বেষ্টিত সঙ্কীর্ণ স্থানের বাহিরে আর কিছু আছে কি? বাহিরে কি লোকালয়, গ্রাম আছে, তাহার পাশে ধান ভরা ক্ষেত? পুকুরের পাড়ে কি মেয়েরা বাসন মাজে? মাজিবার সময় পিতলের চুড়ীতে কি ঠুন্ঠুন্ করিয়া শব্দ হয়? মাঠে কি ছেলেরা হাডু-ডু-ডু খেলা করে, বাঁশ গাছে বসিয়া কি ঘুঘু ডাকে? সন্ধ্যার সময় সেই যে কে গান গাহিতে গাহিতে চলিয়া যাইত সে কি এখনও তেমনি গান করে? এই সব ভাসা-ভাসা দিবাস্বপ্নের মধ্যে আর একটা স্বপ্ন যেন তাহার বুক চাপিয়া ধরিত। তাহার মেয়ে হিমী তাহার বড় নেওটা, সে কি বাপকে খোঁজ করে না? তাহার স্ত্রীর কেমন করিয়া চলে? ভাবিতে ভাবিতে তাহার দৃষ্টি আরও শূন্য হইয়া যায়, সূর্য্যের আলোক যেন তাহার চক্ষের সম্মুখে নিভিয়া যায়।
আর একজন কয়েদী তাহার পাশে আসিয়া, তাহাকে আঙুলের খোঁচা দিয়া বলিল,—কি রে, কি ভাব্চিস?
কালীচরণের একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়িল। বলিল,—কি আর ভাব্ব?
—এই দেশের কথা?
—তাই ভাবচি।
—চিরকাল এইখানে পচে’ মর্বি? আমরা ক’জন পালাব। তুই আমাদের সঙ্গে যাবি?
—কেমন করে’?
—কেমন করে’ পালাতে হয় জানিস্ নে? পাঁচিল টপ্কে, আবার কেমন করে’। জমাদার আস্চে, এখন আর কথা হবে না, রাত্রে বল্ব।
রাত্রে তাহারা ফিস্ ফিস্ করিয়া পলায়ন করিবার পরামর্শ করিতে লাগিল। কালীচণকে লইয়া পাঁচজন। সব কথা শুনিয়া কালীচরণ বলিল,—তোরা যা, আমার পালাবার ক্ষমতা নেই।
একজন অন্ধকারে কালীচরণের গলা টিপিয়া ধরিল, বলিল,—সব কথা জেনে আমাদের ধরিয়ে দিবি, না? তোকে খুন করে’ আমরা ফাঁসি যাব।
গলা ছাড়িয়া দিলে কালীচরণ হাঁপাইয়া বলিল,—আমাকে দিয়া কোন কথা প্রকাশ হবে না, আমি যেন কোন কথা শুনিনি।
আর চারজন কয়েদী দিন কতক পরে পলায়ন করিল বটে, কিন্তু একজন তখনি প্রহরীর গুলিতে মরিল, বাকি তিনজন কিছুদিন পরে ধরা পড়িল। জেল হইতে পলায়ন করিবার অপরাধে তাহাদের আরও তিন বৎসর করিয়া কারাদণ্ড হইল, পায়ে দিনরাত বেড়ী, অপর কয়েদীদের সঙ্গে মিশিতে পাইত না।
বৎসর দুই জেলে কাটাইবার পর ৩৫১ নম্বর দয়েদী জেলারের কপাচক্ষে পড়িল। চোর ডাকত বদমায়েস লইয়াই জেলে নিত্য কর্ম্ম, কিন্তু ৩৫১ নম্বর সে দলের নয়, ইহার সাজা হওয়া সম্বন্ধে একটা কিছু গলদ আছে! জেলার খাতা খুলিয়া মকদ্দমার সংক্ষিপ্ত নোট পড়িল। ৩৫১ নম্বরকে ডাকিয়া পাঠাইল। সে ঘরে আর কেহ ছিল না।
জেলার বলিল,—কালীচরণ!
কালীচরণ থতমত খাইয়া উত্তর দিতেই ভুলিয়া গেল। এতদিন পরে আবার তাহাকে নাম ধরিয়া ডাকে! এখানে ত কাহারও নাম নাই, যে যার নাম জেলের ফটকের বাহিরে রাখিয়া আসে। তাহাকে নাম ধরিয়া ডাকিতেই যেন জেলের প্রাচীরের ইটের গাঁথনি কোথায় মিলাইয়া গেল, যেন আনন্দ-কোলাহলপূর্ণ মুক্ত সংসার তাহার মনশ্চক্ষে প্রতিভাত হইল, কারাগারের বন্ধন টুটিয়া গেল।
জেলার আবার ডাকিল,—কালীচরণ!
কালীচরণ চমকিয়া বলিয়া উঠিয়া বলিল,—হুজুর, আমার কসুর মাপ হয়, কেমন অন্যমনস্ক হয়েছিলাম।
জেলারের চক্ষু কোমল, মুখে অল্প হাসি। যে ভ্রূকুটি ও গর্জ্জনে কয়েদীদের প্রাণ শুকাইত তাহার কোন চিহ্ন নাই। জেলার বলিল,—জাল নোট ভাঙাইবার জন্য তোমার সাজা হইয়াছিল?
—হাঁ, হুজুর।
—অনেক দোকানে ভাঙাইতে?
—হাঁ, হুজুর।
—তুমি জানিতে সেগুলা জাল নোট?
—না, হুজুর।
—আসল আর জাল নোট চিন্তে পার?
—না হুজুর, আমি মুখ্খু মানুষ।
—নোট তুমি কোথায় পেতে?
—যে বাবুদের কাছে চাকরী করতাম তারা ভাঙাতে দিত।
—তারা কোথায়?
—তারা পালিয়ে গিয়েচে।
জেলার খানিকক্ষণ কালীচরণের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহার পর কহিল,— আচ্ছা, এখন তুমি যাও।
কালীচরণ নিজের কাজে চলিয়া গেল। সেই দিন হইতে জেলারের আদেশ-মত কালীচরণকে কোন কঠিন কাজে নিযুক্ত করা হইত না। আরও কিছুদিন পরে কালীচরণ ওয়ার্ডার হইল। কয়েদীরা সকলে দেখিল, জেলার কালীচরণকে অনুগ্রহ করে, তাহাকে কোন রকম শাসন করে না, কখনো দুর্ব্বাক্য বলে না, অনেক সময় নিজের আপিস ঘরে তাহাকে ডাকিয়া লইয়া গিয়া কথাবার্ত্তা কয়।
একা থাকিলেই কালীচরণ অন্যমনস্ক হইত। জেলের বাহিরে মুক্ত সংসার কি রকম দেখিতে তাহা কল্পনা করিবার চেষ্টা করিত। এক এক সময় পূর্ব্বকথা স্বপ্ন মনে হইত, এই কারাগারই যেন বাস্তব, আর সব মিথ্যা। গ্রামের কথা যেন বহুকালের বাল্য-স্বপ্ন, মায়াপুরের ইন্দ্রজাল। সত্য সত্যই কি এমন স্থান থাকিতে পারে? এমন মুক্ত আকাশ, এমন মধুর বাতাস, আম বাগানে এমন বিহঙ্গকাকলী? শিশুদের ভাঙা ভাঙা কথা, বৃদ্ধদের আগেকার কালের কথা, কালীচরণ কখনও কি শুনিয়াছিল? শীতকালে মাথার উপর দিয়া হাঁসের দল উড়িয়া যাইত, নদীর মাঝখানে বালুকার চরে বসিয়া বুনো হাঁস রৌদ্র পোহাইত, মাল বোঝাই-করা নৌকা ভাসিয়া যাইত, মাঝি হাল ধরিয়া আপনার মনে গান গাহিত। গ্রামে রাধাবল্লভ জীউর মন্দিরে সন্ধ্যা-আরতির সময় কি-রকম কাঁসর ঘণ্টা বাজে! সহরের কথা একটা দারুণ দুঃস্বপ্নের ন্যায় মনে হইত, সবই যেন জাল, সবই প্রবঞ্চনা, মানুষ মানুষের শত্রু। সে-কথা মনে হইলে তাহার বুকের ভিতর কাঁপিয়া উঠিত।
একদিন সন্ধ্যার পর কয়েকজন নূতন কয়েদী আসিল। অপর কয়েদীরা তখন শয়ন করিতে গিয়াছে। প্রাতে উঠিয়া কালীচরণ জেলারের আপিসে গেল। সেখানে সে নিত্য টেবিল ঝাড়িয়া, ঘর ঝাঁট দিয়া ঘর পরিষ্কার করিত, জেলার আসিলে পর অপর কাজে যাইত। কাজ তাহাকে বিশেষ কিছু করিতে হইত না, অন্য কয়েদীদের কাজ দেখিত। ধমক-ধামক বড় একটা দিত না।
কালীচরণ দেখিল, তেলের ঘানিতে দুইজন নূতন কয়েদী ঘানি টানিতেছে। তাহাদিগকে দেখিয়া কালীচরণ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল। তাহার চক্ষু স্থির হইল, ওষ্ঠাধর কম্পিত হইল। কয়েদী দুইজনের গলার চাক্তিতে নম্বর ৪০৫ আর ৪০৬। কয়েদী দুইজন কালীচরণকে দেখিয়া হাসিতে লাগিল। একজন বলিল,—এই যে কালীচরণ! তোমাকে অনেক দিন দেখতে না পেয়ে আমাদের মন কেমন কর্ছিল, তাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেচি।
কালীচরণ নিঃস্পন্দ, একটি কথাও কহিতে পারিল না। অজগরের চক্ষে পড়িলে পাখী যেমন আড়ষ্ট হইয়া যায়, কালীচরণ সেই রকম আড়ষ্ট হইয়া, দাঁড়াইয়া রহিল।
দ্বিতীয় নূতন কয়েদী হাসিয়া সুর করিয়া কহিল,—চিরদিন কখনও সমান না যায়, কখনও বাবুয়ানা, কখনও ঘানিটানা।
কালীচরণ প্রস্তরমূর্ত্তির ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, এমন সময় জেলার আসিয়া উপস্থিত। সে তীক্ষ্ণকটাক্ষে একবার কালীচরণের দিকে আর একবার নূতন কয়েদীদের দিকে চাহিয়া দেখিল। কালীচরণকে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি এদের চেন?
—হাঁ, হুজুর।
—কে এরা?
—যে বাবুদের কাছে আমি চাকরী করতাম আর যারা আমাকে নোট ভাঙাতে দিত তাদের মধ্যে এই দু’ জন।
জেলারের ভ্রু কুঞ্চিত হইয়া চক্ষু ছুঁচের মত হইল। কয়েদী দুইজনকে যেন চক্ষের দৃষ্টিতে বিদ্ধ করিয়া অতি মৃদুস্বরে বলিল, তোমরা এই নিরপরাধী ব্যক্তিকে ফাঁসাইয়াছিলে?
পুরাতন কয়েদীরা জানিত যে, জেগারের তর্জ্জন-গর্জ্জনকে যত না ভয়, সে চিবাইয়া চিবাইয়া মৃদু মৃদু কথা কহিলে তাহার অপেক্ষা অধিক ভয়। এই দুইজন কয়েদী সবে শ্রীঘরে শুভাগমন করিয়াছে, তাহারা সে-কথা কেমন করিয়া জানিবে? একজন দাঁত বাহির করিয়া রহস্য করিয়া বলিল,—এমন হয়েই থাকে, উদোর বোঝা অনেক সময় বুদোর ঘাড়ে পড়ে।
জেলার আরও মৃদুস্বরে বলিল,—নরকে যাবার আগেই নরক কাকে বলে তোমরা জান্তে পারবে।
জেলার চলিয়া গেল, কালীচরণও সেই সঙ্গে গেল।
৪০৫ আর ৪০৬ নম্বর কয়েদীর নরক-যন্ত্রণা আরম্ভ হইতে বড় বিলম্ব হইল না। তাহারা জাল নোট তৈরী করা ছাড়া কখন কোন পরিশ্রম করে নাই, কখন কাহারও আদেশে কোন কর্ম্ম করে নাই, কখন কোনরূপ ক্লেশ স্বীকার করে নাই। জেলের কদন্ন আহার করিতে তাহাদের রুচি হইত না, জেলের কঠোর শাসনে তাহাদের রাগ হইত। তাহার উপর হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর জেলারের তীব্র দৃষ্টি। জেলার যখন-তখন আসিয়া তাহাদের কাজ দেখিত, অলস বলিয়া তাহাদিগকে তিরস্কার করিত। পাঁচ সাতদিন যাইতেই একদিন কয়েদী দুইজন জেলারের মুখের উপর জবাব করিল। জেলারও তাহাই চায়। প্রত্যেক কয়েদীকে ত্রিশ ঘা বেতের আদেশ হইল।
ডাক্তার আসিয়া কয়েদী দুইজনকে দেখিল। দিব্য হৃষ্টপুষ্ট নীরোগ শরীর, ডাক্তার বেত মারিতে অনুমতি দিল।
জেলার কালীচরণকে ডাকাইয়া পাঠাইল। ৪০৫ নম্বর কয়েদীর কাপড় খুলিয়া তাহাকে ত্রিকোণ কাঠের ফ্রেমে বাঁধিবার উদ্যোগ করিতেছে। পাশে দশ বার গাছা আটি-বাঁধা লম্বা বেত পড়িয়া রহিয়াছে। জেলার কালীচরণকে বলিল,—তুমি ইহাকে বেত মার।
কালীচরণের মুখ শুকাইয়া গেল, তাহার চক্ষু কপালে উঠিল। সে ঢোক গিলিয়া বলিল,—হুজুর, আমি পারব না।
জেলার গর্জ্জন করিয়া উঠিল,—কী! আমার হুকুম শুনবে না?
—হুজুর, হুকুম শোনাই ত আমার কাজ, কিন্তু ওকে আমি বেত মারতে পারব না।
—হুকুম না মানলে তোমাকে বেত খেতে হবে।
—তাই খাব হুজুর, বলিয়া কালীচরণ গায়ের জামা খুলিতে লাগিল।
জেলার হাত তুলিয়া তাহাকে নিষেধ করিল। ঠোঁট কামড়াইয়া বলিল,—আচ্ছা, তোমাকে মারতে হবে না, তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে থাক।
কালীচরণ দাঁড়াইয়া রহিল।
জেলার আর একজন বলবান কয়েদীকে বেত মারিতে আদেশ করিল। ৪০৫ নম্বর কয়েদী প্রথম কয়েক ঘা বেত খাইয়া আর্ত্তস্বরে চীৎকার করিতে লাগিল, তাহার পর শুধু গোঙানি। ৪০৬ নম্বর দাঁড়াইয়া ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতেছিল। কালীচরণ মুখ ফিরাইল। দুইজনকে বেত মারা হইলে পর জেলার কালীচরণকে ডাকিয়া নিজের ঘরে লইয়া গেল। জিজ্ঞাসা করিল,—ঐ দু-জনের জন্য তোমার জেল হয়েচে, তুমি ওদের বেত মারতে অস্বীকার করলে কেন?
—হুজুর, আমার যা হবার তা হয়েচে। ওদের মেরে আমি ত আর জেল থেকে খালাস পাব না। ওরা অধর্ম্ম করেচে, তেমনি সাজাও পেয়েচে। আমি ওদের গায়ে হাত তুল্লে আমার পাপ হবে।
জেলার কালীচরণের মুখের দিকে চাহিয়া খানিকক্ষণ ভাবিল। কালীচরণ মূর্খ, অশিক্ষিত, অকারণে বন্দী হইয়াছে, অথচ যাহারা তাহাকে এরূপ বিপদে ফেলিয়াছে তাহাদের প্রতি ক্রোধ নাই, প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি নাই। জেলার কালীচরণের কাঁধে হাত দিয়া বলিল,—তুমি যদি তোমার শত্রুদিগকে ক্ষমা করিতে চাও, তা হলে আমি আর তাদের পীড়ন করব না।
কালীচরণ বলিল,—হাঁ হুজুর, সেই ভাল। মাথার উপর ধর্ম্ম আছেন, তিনি বিচার করবেন। অধর্ম্ম সইবে কেন?
৪০৫ আর ৪০৬ নম্বর কয়েদী সারিয়া উঠিয়া আবার যখন কাজ করিতে আরম্ভ করিল, সেই সময় জেলার একদিন তাহাদিগকে বলিল, আমি তোমাদের আচ্ছা করে’ জব্দ করতাম, কালীচরণের জন্য তোমরা রক্ষা পেলে। সে তোমাদের পিঠে নিজে বেত মারেনি, এখনও তোমাদের দয়া করে। যদি আবার সাজা পেতে না চাও তা হ’লে কালীচরণকে খুসী রাখবে।
সেই দিন হইতে এই দুইজন কয়েদী কালীচরণের খোসামোদ করিত।
জেলার ইহাতেই ক্ষান্ত হইল না। কয়েদী দুইজনকে দিয়া কালীচরণের সম্বন্ধে প্রকৃত ঘটনা লিখাইল। তাহারা স্বীকার করিল, কালীচরণ সম্পূর্ণ নিরপরাধী, যেসকল নোট তাহাকে ভাঙাইতে দেওয়া হইত, সেগুলা যে জাল তাহা তাহার জানিবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। সে সবে গ্রাম হইতে আসিয়াছিল, দরিদ্র, নিরক্ষর, নোট কখন চক্ষে দেখিয়াছিল কি না, তাহাই সন্দেহ। সেই সঙ্গে জেলার লিখিল, কালীচরণের স্বভাব-চরিত্র সে উত্তমরূপে লক্ষ্য করিয়াছিল। সে নিরীহ, ভালমানুষ, কিছুই জানে না, তাহাকে যে-কেহ স্বচ্ছন্দে ঠকাইতে পারে।
কালীচরণের মুক্তির জন্য জেলার যে সময় লিখিতে আরম্ভ করিল, তখন কারাবাস পাঁচ বৎসর পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। ছয় মাসে নয় মাসে কখন কালীচরণের নামে একখানা চিঠি আসিত। তাহার স্ত্রী গ্রামের কাহাকেও দিয়া লিখাইত। জেলার কালীচরণকে পড়াইয়া শুনাইত, উত্তরও সে লিখিয়া দিত। এই সময় পত্র আসিল কালীচরণের কন্যা বসন্ত রোগে মারা পড়িয়াছে। কালীচরণ বজ্রাহতের ন্যায় বসিয়া পড়িল। জেলার তাহাকে দুই চারিটা সান্ত্বনাবাক্য বলিল। কালীচরণের চক্ষে জল পড়িল না, শূন্য, শুষ্ক, উত্তপ্ত চক্ষে চাহিয়া রহিল। তাহার হৃদয়ের কোমল সরসতা, অশ্রুর উৎস যেন দগ্ধ হইয়। গেল। ধীরে ধীরে উঠিয়া চলিয়া গেল।
ইহার পূর্ব্বেও কালীচরণ অধিক কথা কহিত না, অপর কয়েদীদের সঙ্গে বড়-একটা গল্প-গুজব করিত না, কিন্তু এই বিপদের পর সে যেন মূকের মত হইয়া গেল, তাহার মুখে কথা শুনিতেই পাওয়া যাইত না। কেহ কিছু বলিলে একটা কথার উত্তর দিত বা সেখান হইতে চলিয়া যাইত। কাজ যেটুকু করিতে হয় করিত, কিন্তু কাজে অমনোযোগী হইলে জেলার তাহাকে কিছু বলিত না।
কয়েক মাস পরে একদিন জেলার তাহাকে ডাকিয়া বলিল, কালীচরণ, আমার কাছে পত্র আসিয়াছে, যে, তোমার মকদ্দমার সমস্ত সমস্ত কাগজ সরকার হইতে তলব হইয়াছে। বোধ হয় শীঘ্রই তোমার খালাসের হুকুম হইবে। কালীচরণের মুখে আনন্দের কোন চিহ্ন নাই। কহিল,—হুজুর, আমার এখন সব জায়গায়ই সমান।
এক সপ্তাহ পরে কালীচরণের গ্রাম হইতে পত্র আসিল যে, সর্পাঘাতে তাহার স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছে। এ সংবাদেও তাহার চক্ষে জল আসিল না। সে পাষাণ-মূর্ত্তির মত স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
আরও একমাস কাটিয়া গেল। সন্ধ্যার সময় জেলার কালীচরণকে বলিল,—তোমার খালাসের হুকুম হয়েচে, কাল সকালে তুমি খালাস পাবে।
কালীচরণ বলিল,—হুজুর, আমি কোথায় যাব? আমার ত যাবার কোথাও জায়গা নেই।
জেলার দুঃখ প্রকাশ করিল, কহিল,—তোমার যে বিপদ হয়েচে তার তো কোন উপায় নাই। বাড়ী গিয়ে ভগবানকে ডেকো।
—তিনি তো এখানেও আছেন।
পর দিবস প্রাতঃকালে কালীচরণের মুক্তি হইল। কাজের হিসাবে কিছু সামান্য টাকা তাহার পাওনা ছিল, সেই সঙ্গে জেলার আর পাঁচটি টাকা দিল।
জেলের প্রকাণ্ড ফটক পার হইয়া কালীচরণ বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। আকাশপ্রান্তে মাঠের মাঝখান দিয়া সূর্য্যোদয় হইতেছে। সম্মুখে রাজপথ, পথের দুইধারে বড় বড় অশ্বত্থ ও বট গাছ, গাছে পাখীর কোলাহল, প্রভাত-বায়ুতে বৃক্ষপত্রে মর্ম্মর শব্দ। দূরে ধানের ক্ষেতে ধান পাকিয়াছে, ধানের শীষ রাশি রাশি স্বর্ণশলাকার ন্যায় ক্ষেত আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে।
অন্ধকারে ঘরের দেয়াল যেমন মাথায় লাগে, প্রভাত-আলোকে মুক্ত আকাশ যেন সেই রকম কালীচরণের মাথায় লাগিল। তাহার হাঁপ ধরিল, বৃহৎ সংসার-অরণ্যে দিশেহারা হইয়া পড়িল। সে কোথায় যাইবে? তাহার গন্তব্য স্থান কোথায়? কে তাহার পথ চাহিয়া আছে? সে কাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইবে? কারাগারের চারিটা প্রাচীরের গণ্ডী বরং ছিল ভাল। সংসার যে বৃহৎ কারাগার, ইহাতে পথহারা হইয়া ঘুরিতে হয়। এ মেয়াদ কবে ফুরাইবে, এ কারাগার হইতে কবে মুক্তি হইবে?